বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৪

পুড়ছে জীবন ভাঙছে সংসার : কী ভাবছেন সমাজ বিজ্ঞানীরা?


বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহরে একান্নবর্তী পরিবার এখন আর চোখে পড়ে না। এক সময়ের ঐতিহ্যের যৌথ পরিবার এখন যেন রূপ কথার গল্প। কালের পরিক্রমায় সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবার প্রথা; সঙ্কটে আছে ছোট পরিবারগুলোও! মূলত যৌথ পরিবারগুলোর কাঠামোগত ঐতিহ্য হচ্ছে আর্থিক সমৃদ্ধি। তাই এসব পরিবারে ধন-সম্পদের অভাব না থাকলেও সময়ের কারণে পারিবারিক মত ভিন্নতা ও অভিন্ন ক্ষমতার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ফলে যৌথ পরিবারগুলো হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ সভ্যতা থেকে।
এক সময় চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর-দক্ষিণ জেলার বিভিন্ন থানায় যৌথ পরিবারের সুনাম সমৃদ্ধি লোকমুখে শুনা যেত! বিশেষ করে রাউজান উপজেলায় অনেক বড় বড় যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। এ উপজেলায় এখনও অনেক যৌথ পরিবার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। রাউজান ও চট্টগ্রামের অনেক যৌথ পরিবারে ঐক্যের মধ্যে অনৈক্য তৈরি করেছে রাজনীতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার কারণে আবার এসব যৌথ পরিবারে ব্যবসায়িক বিরোধও কম নয়। ফলে ব্যবসার সম্প্রসারণ ও রাজনৈতিক অভিলাস থেকে অনেক পরিবারের ভাঙন তৈরি হচ্ছে বলে জানা গেছে। একই ছাদের নিচে অনেকগুলোর পরিবার একসাথে বসবাসের আনন্দ সীমাহীন হলেও সময়ের কারণে এ সীমাহীন আনন্দকে পেছনে ফেলে অসীম ক্ষমতার মোহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে নতুন পরিবার গঠনে প্রবল ইচ্ছে শক্তির কাছে হার মানছে জীবনের নানা প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বংশ বিস্তার তথা পরিবার গঠনে বিবাহবন্ধনের বিকল্প নেই। সব ধর্মে বিবাহবন্ধনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। শৃঙ্খল জীবনের জন্য বিবাহবন্ধন অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই মানুষ মানব সভ্যতার ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। মহাসমারোহে ঢাক-ঢোল, বাদ্যবাজনা বাজিয়ে বিচিত্র আয়োজনে যেসব বিয়ে হচ্ছে, বর্তমান সময়ে সেসব বিয়ে তেমনটা টেকসই হচ্ছে না। পারিবারিকজীবনে সন্দেহ অবিশ্বাস ও পারস্পরিক মতৈক্যের অভাবে সংসারজীবনে জ্বলছে অশান্তির আগুন। সংসারজীবনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ফেসবুক সমাচার। অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় মোবাইল-ফেসবুকের কারণে পরকীয়ার ঘটনা বাড়ছে। সরল মনের নারীরা পরকীয়ার ফাঁদে পড়ছে অহরহ। যে কারণে বুকভরা আশা আর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘর বাঁধলেও ধরা দিচ্ছে না সুখপাখি। তাই সুখের সংসারে মেহেদীর রঙ মোছার আগেই অনেকের সংসার ভেঙে যাচ্ছে..। এ যেন কাঁদছে বর-বধূ, পুড়ছে জীবন, ভাঙছে সংসার। গত এক দশকে তালাকের ধরনও বদলে গেছে। আগে ৭০ শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটতো স্বামী কর্তৃক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তালাকের ঘটনা নারীরা পুরুষের চেয়ে দশগুণ এগিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে ৮০ শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটছে স্ত্রী কর্তৃক! আজব হলেও গুজব নয়। বাস্তব সত্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২ সালে ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে ৭৬৭২টি আর ২০১৩ সালে ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে ৮২১৪টি। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডির্ভোসের ঘটনা ঘটেছে ৬১০টি। তার মধ্যে ৪২৬টি ডির্ভোসের ঘটনা ঘটেছে স্ত্রী কর্তৃক। ঢাকার পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় তালাকের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় তালাকের ঘটনা ঘটেছে ২৮৮১টি; ২০১১ সালে ৩৪০০টি; ২০১২ সালে ২৪৪২টি এবং ২০১৩ সালে তালাকের ঘটনা ঘটে ৩৪৫৪টি। চলতি বছরে তালাকের ঘটনা বিগত বছরের রেকর্ডগুলো অতিক্রম করবে বলে জানা গেছে। তালাকের ঘটনা আজব হলেও গুজব নয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, উত্তরা ও মহাখালীতে ডিভোর্সের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। সর্বশেষ চলতি বছরের ৬ মাসের মধ্যে রাজধানী ঢাকার ২ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৬০০০-এর মতো ডির্ভোসের ঘটনা ঘটেছে। পিছিয়ে নেই বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামও। ভেঙে যাওয়া সংসারের ডির্ভোসের কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ সংসার ভাঙার পেছনে নেপথ্য নায়কের ভূমিকায় মোবাইল ফোন! ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, স্কাইপি ইত্যাদি কারণে পরিবারে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। সংসার ছাড়তে রাজি হলেও মোবাইল ছাড়তে কেউই রাজি নয়! যেন মোবাইলই সবকিছু। দাম্পত্য জীবনের নানা সঙ্কট আর ডির্ভোসের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জানি না সমাজ বিজ্ঞানীরা কী ভাবছেন? দেশের অস্থির রাজনীতি ও ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনে সুশীল সমাজের কথা ভাবতে ভাবতে সমাজ বিজ্ঞানীরাও জীবন সংসারের কথা ভুলে গেছেন।
এটা সত্য যে, জীবন সংসারে তালাকের প্রয়োজন দেখা দেয় অনেক সময়। তাই বলে তালাকের উৎসব তৈরি হবেÑ এটা ভাবা যায় না। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে তালাকের ঘটনায় মনে হচ্ছে যেন বিবাহবিচ্ছেদের উৎসব তৈরি হয়েছে দেশে! আইনের কিছু দুর্বলতার কারণেও বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে। কথায় কথায় তালাকের ঘটনাগুলো সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে বলতে পারি, যে হারে তালাকের ঘটনা বাড়ছে তা সমাজ সভ্যতার জন্য ভয়ঙ্কর অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। এখনই বিবাহবিচ্ছেদের মাত্রাতিরিক্ত ঘটনা রোধ করা না গেলে ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হবেÑ এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথায় কথায় তালাক দেয়া ঘটনা হিন্দী নাটকের সিরিয়ালকেও হার মানাচ্ছে। কচুপাতার ওপর পানির ন্যায় সম্পর্কগুলো মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে... তা কি মানা যায়? সমাজে তালাকের ঘটনা বাড়লেও সমাজ বিজ্ঞানী ও তথাকথিত সমাজ দরদীদের কোনো মাথাব্যথার কারণ দেখা যাচ্ছে না; বরং অনেক ক্ষেত্রে উসকে দিচ্ছে তালাককে। দেশের টেলিভিশন মিডিয়ায় নাটক টেলিফিল্মেও বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বড় করে দেখানো হচ্ছে! ডির্ভোসসংক্রান্ত নাটক একাধিক চ্যানেলে প্রচার হচ্ছে। তালাক সময়ের প্রয়োজনে একটি অধিকারও বটে। যখন জীবন সংসার অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, কোনো অবস্থায় যখন সংসার ঠিকিয়ে রাখা যায় না, তখনই তালাকের প্রয়োজন পড়ে। তালাক ইসলাম ধর্মের স্বীকৃত। কিন্তু সর্বনিকৃষ্ট। তাই তালাককে ইসলাম ধর্মে অনুৎসাহিত করা হয়েছে।
কেন ঘটছে পারিবারিক কলহ?
ইট-পাথরের শহরে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দিজীবনে মানুষের মন ও মননের পরিবর্তন হচ্ছে। শহরে অসংখ্য ভবনে একই ছাদের নিচে একাধিক পরিবারের অবস্থান হলেও কেউ কারো খোঁজ রাখে না। কেবল চেহারাটা চেনা চেনা। কেউ কারো নাম পরিচয়ও জিজ্ঞেস করে না, অথচ একই ছাদের নিচে বসবাস। এসব পরিবারের বিনোদন বলতে স্যাটেলাইট দুনিয়া টিভি ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত মানুষের জীবনজুড়ে বাড়ছে হিন্দি নাটকের দীর্ঘ সিরিয়াল। এসব হিন্দী নাটক ও ইন্টারনেট প্রীতি মোড় ঘুছিয়ে দিচ্ছে অনেক জীবনযাত্রাকে। ফলে হিন্দি নাটকের মতো দীর্ঘ হচ্ছে পরিবারের পারিবারিক কলহও; যে কারণে ভাঙছে সংসার, পুড়ছে জীবন। বাড়ছে আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনাও।
অধিকার অনাধিকার চর্চা, পারিবারিক কলহের কারণে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি সহিংস হয়ে পড়ছে। স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন আর স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যার ঘটনা বাড়ছে। পারিবারিক কলহে তালাক, খুন-হত্যার ঘটনা এখন আর শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; একেবারে গ্রামের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। এ অবস্থার পরিত্রাণ দরকার। তাই ভাবতে হবে এখনই সমাজপতিদের।
নাজিম উদ্দিন চৌধুরী এ্যানেল

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads