সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০১৪

সাতচল্লিশের আগস্ট : ৬৭ বছর পর


ভাষা, অঞ্চল, জাতিসত্তাভিত্তিক আন্দোলন-সংগ্রাম-রাজনীতি নতুন নয়। সেই রাজনীতিকে নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা-উত্তেজনাও নতুন বিষয় নয়। এই আগস্ট মাসেই আমরা বলতে পারি, আজ থেকে ৬৭ বছর আগের ১৯৪৭ সালের কথা। তখন বাংলা ও ভারত তীব্র উত্তেজনা ও ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।
ইতিহাসের ভাষ্য মতে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত ভাগ হয়ে স্বাধীন হিন্দুস্তান (ইন্ডিয়া/ভারত) ও স্বাধীন পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা লাভ করে। বদলে যেতে থাকে উপমহাদেশের রাজনীতির ধারা। পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে যে, ঔপনিবেশিকতাবাদের কবল থেকে মুক্তির সূচনাকাল ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬৭ বছরে আমরা অর্জন করেছি সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতায় স্বাধীনতার স্বাদ আছে। আছে উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির আন্দ ও উল্লাস। আবার সেই রাজনৈতিক পথচলায় নেপথ্যে ছায়া বিছিয়ে রেখেছে আধিপত্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ-আগ্রাসনবাদের জ্বালা। ১৯৪৭ সালের আদি ভাগাভাগির ঐতিহাসিক বিবরণ উপমহাদেশের বিদ্যমান আধিপত্যবাদী-সম্প্রসারণবাদী-আগ্রাসনবাদী আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রবণতা অনুধাবনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়ক।
মজার ব্যাপার হলো, ১৯৪৭ সালে ভারত ও বাংলা ভাগ মেনে নিলেও ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গকে ভঙ্গ করে ঢাকায় রাজধানী করে ‘পূর্ববঙ্গ আসাম প্রদেশ’ গঠিত হয়, তখন কলকাতার হিন্দুরা বাংলা-মাতাকে ভাগ করা হচ্ছে বলে তীব্র বাঙালি তথা হিন্দু জাতীয়তাবাদী কার্যক্রম গ্রহণ করে এবং ঢাকা থেকে আবার রাজধানী কলকাতায় ফিরিয়ে নেয়। অথচ ঢাকায় রাজধানী থাকাকালে পূর্ব তথা আজকের বাংলাদেশের প্রভূত উপকার হয়েছিল। সেটা আর হতে পারেনি। অথচ ১৯৪৭ সালে সেই ভাগই তারা মেনে নিল। তখন আর তারা বাংলা-মাতা বা ভারত-মাতাকে ভাগ করতে দ্বিধা করেনি। অতএব ১৯৪৭ সালের বাংলা ও ভারত ভাগের রাজনীতির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করা ঐতিহাসিক কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।ইতিহাসের পাতা থেকে আরো জানা যায়, বাংলার সম্পদ ভাগাভাগির সভাটি ১৯৪৭ সালের ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত হলেও এক মাস আগেই ২০ জুন তারিখে প্রাদেশিক আইনসভায় বাংলা প্রদেশের বিভক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যায়। নাজিমুদ্দিন যে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হবেন, সেটাও নির্ধারিত হয়ে যায়। অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের শেষ ও বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী দাঙ্গা ও রক্তপাতে বিদীর্ণ কলকাতাকে রক্ষা করতে পারেননি। ন্যায্যতার ভিত্তিতে কলকাতা পূর্ববঙ্গের অংশ হতে যাচ্ছে দেখে ইতিহাসের নির্মমতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অংশ নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায় মহানগরীটিকে মুসলিমশূন্য করে ফেলে। এই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে নতুন মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন প্রচ-ভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। সে সময়ে তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে, পার্টিশনের সমগ্র প্রচেষ্টাই ভ-ুল হয়ে যাবে যদি কলকাতার দাঙ্গা আরো বৃদ্ধি পায় ও ছড়িয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের সরকারকে কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করার ব্যাপারে বিপত্তি সৃষ্টি করা হবে। কলকাতা কেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ চাচ্ছিলেন যে, রক্তপাত ও অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গে আলাদা ও স্বাধীন প্রদেশ গঠনকে আটকে দিতে। বিচক্ষণতার সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিন তখন দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন ঢাকায় গিয়ে স্বাধীন ও নতুন প্রদেশের সূচনাকে ত্বরান্বিত করতে। কিন্তু তার এ উদ্যোগকে প্রবলভাবে সমালোচনা করেন সোহরাওয়ার্দীপন্থীরা। সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ কর্মী ও তৎকালীন তরুণ রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : “নাজিমুদ্দিন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়েই ঘোষণা করলেন, ঢাকা রাজধানী হবে এবং তিনি দলবলসহ ঢাকায় চলে গেলেন। একবারও চিন্তা করলেন না, পশ্চিমবাংলার হতভাগ্য মুসলমানদের কথা। এমনকি আমরা যে সমস্ত জিনিসপত্র কলকাতা থেকে ভাগ করে আনব তার দিকেও ভ্রƒক্ষেপ করলেন না। ফলে আমাদের যা প্রাপ্য, তা-ও পেলাম না। সরকারি কর্মচারীরা ঝগড়া-গোলমাল করে কিছু কিছু মালপত্র স্টিমার ও ট্রেনে তুলতে পেরেছিলেন, তা-ই সম্বল। কলকাতায় বসে যদি ভাগবাটোয়ারা হতো তাহলে কোনো জিনিসের অভাব হতো না। নাজিমুদ্দিন সাহেব মুসলিম লীগ বা অন্য কারো সাথে পরামর্শ না করেই ঘোষণা করলেন ঢাকাকে রাজধানী করা হবে। তাতেই আমাদের কলকাতার ওপর আর কোনো দাবি রইলো না।”
সোহরাওয়ার্দীপন্থীরা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দাঙ্গায় অংশ নিয়ে কলকাতার ওপর পূর্ববাংলার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। নাজিমুদ্দিনপন্থীরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উত্তেজনার পথ পরিহার করে কলকাতাকে ফেলে রেখেই ঢাকাকেন্দ্রিক অবশিষ্ট পূর্ববঙ্গকে পশ্চিমের হাত থেকে বাঁচাতে চলে আসেন। কোন পন্থা সঠিক ছিল, একমাত্র ভবিষ্যৎই সেটা স্পষ্টভাবে বলতে পারবে। তবে বাঙালি মুসলমানের স্বার্থ ও সম্পদের অধিকার তৎকালীন ‘উগ্র হিন্দু/ভারতপন্থী বাঙালি-জাতীয়তাবাদীরা’ মেনে নেয়নি। পাকিস্তানের প্রাপ্য (পূর্ব ও পশ্চিম মিলিয়ে) সম্পদ ফেরত দেয়ার দাবিতে গান্ধীকে পর্যন্ত অনশন করতে হয়। কিন্তু তাদেরও কোনো কাজ হয়নি। ভারত পাকিস্তানের ন্যায্য হিস্যার অনেক কিছুই দেয়নি। বাংলাদেশ তাই ঐতিহাসিকভাবেই ভারতের কাছেও অনেক কিছুই পায়। সাতচল্লিশের ভাগাভাগির সময় প্রবল ‘উগ্র হিন্দু/ভারতপন্থী বাঙালি-জাতীয়তাবাদীদের চরম সন্ত্রাস ও আক্রমণের কারণে সংরক্ষণ করা যায়নি ন্যাযসঙ্গত প্রাপ্তি ও অধিকার। কলকাতাসহ পূর্ববঙ্গের জন্য নির্ধারিত ভূমি, সম্পদ, সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করা যায়নি।
‘উগ্র হিন্দু/ভারতপন্থী বাঙালি-জাতীয়তাবাদী’ শক্তির মহড়া সাতচল্লিশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। যে বলদর্পী দাপট এখনো উপমহাদেশের দেশগুলো এবং এর কোটি কোটি মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে। উর্দুভাষীরাও সাতচল্লিশের ভাগাভাগির শিকারে পরিণত হওয়া একটি সম্প্রদায়, যারা সাধারণভাবে বিহারি নামে পরিচিত। অথচ ভাষা-অঞ্চল-রক্ত-বংশভিত্তিক উগ্র-জাতীয়তাবাদ ইসলামের আন্তর্জাতিকতা বা ‘উম্মাহ কনসেপ্ট বা ধারণা’র মূলে আঘাতকারী, সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব-সম্প্রীতি বিনষ্টকারী একটি মতবাদ এ কথা অনেকেই, এমনকি ইসলাম নিয়ে যারা ভাবনা-চিন্তা করেন এবং সাধারণ মুসলমানরাও মাঝে মাঝে ভুলে যান। ভুলে যান বলেই এখনই উগ্রতার রাজনীতির রক্তারক্তি দেখতে পাওয়া যায়। এখনও যে উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে, সমাজ ও সংস্কৃতির মূলে পুঁতে রাখা জাতিগত-সাম্প্রদায়িকতা বিরাজমান, সে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
কারণ সম্প্রতি আবার দেখা গেল, উর্দুভাষী-বিহারি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে নিবর্তনমূলক রাজনীতি শুরু হয়েছে। এর ফলে কুর্মিটোলা ক্যাম্পে হামলা ও ১০ জনকে হত্যার ঘটনায় আতঙ্ক কাটেনি বিহারিদের। ঘটনার পর থেকে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের দায়ী করে বিচার দাবি করেন তারা। কিন্তু তাদের কোনো মামলা করতে দেয়া হয়নি। উল্টো তাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা করে হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন চলছে ক্ষতিগ্রস্ত বিহারিদের সঙ্গে জোরপূর্বক সমঝোতার চেষ্টা। এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশের পর নির্যাতিত বিহারিদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। সবকিছু মিলিয়ে আতঙ্কিত নিহতদের স্বজনরা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, হুমকিদাতারা সরকারি দলের সন্ত্রাসী। তারা মিরপুর-পল্লবী এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী। তারা যে কোনো সময় তাদের ক্ষতি করতে পারে বলে বিহারিদের আশঙ্কা। যে কারণে এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার দাবি করতেও সাহস পাচ্ছেন না তারা। গত সপ্তাহে ক্ষতিগ্রস্ত বিহারি পরিবারের তিনজনকে হুমকি দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের কাছে কোনো তথ্য দিলে তাদের এলাকা ছাড়া করা হবে বলে হুমকিদাতারা হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকির কারণে আতঙ্কিত বিহারিরা মুখ খুলতে নারাজ। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়ে কুর্মিটোলা ক্যাম্পে হামলাকারীদের অগ্নিসংযোগে নিহত ৯ জনের পরিবারের কর্তা ইয়াসিন আলী জানান, এ নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না তিনি। বলেন, আমি দেশবাসীর কাছে আর আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। দেশবাসী এর বিচার করুক। আমি নিরীহ মানুষ। আমি কার কাছে বিচার চাইবো! আমি আমার মেয়েটাকে নিয়ে এখন ব্যস্ত আছি।
সাতচল্লিশের উগ্রতা, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক হানাহানি, দুর্বলের প্রতি অবিচার ও জুলুম এবং ন্যায্য অধিকার না দেয়ার যে রাজনৈতিক নীতি ‘উগ্র হিন্দু/ভারতপন্থী বাঙালি-জাতীয়তাবাদীরা’ গ্রহণ করেছিল, এখনো সেই রীতি-নীতি ধরেই অনেকেই রাজনীতি করছে এবং মজলুমের বুকের ওপর বসে রক্তের হোলি খেলছে। কে জানে, কবে এই হিংসার রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটবে? নাকি হিংসা আরো হিংসার জন্ম দেবে?
১৯৪৭ সালের অর্ধশতাধিক বছর পরেও উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মতবাদ, ভিন্ন আদর্শ, ভিন্ন জাতীয়তার মানুষের রক্ত-মৃত্যু দেখে ইতিহাসের কাছে জানতে ইচ্ছা করে, কবে এই হিংসার রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটবে? নাকি হিংসা আরো হিংসার জন্ম দেবে? আজ না হলেও একদিন নিশ্চয়ই ইতিহাস এ প্রশ্নের উত্তর জানাবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads