রবিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৪

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে


নানা কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের নানা দেশেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে জোরালো বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তান এক্ষেত্রে অগ্রণী। দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে নিষ্পেষিত পাকিস্তানের রাজনীতিবিদগণ অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। এ দাবি এমনই এক সময় এলো, যখন দক্ষিণ এশিযার রাজনীতি আসলেই সুপ্ত সমস্যার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারতে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশে জনদাবি তীব্রতা পাচ্ছে। আর পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি উত্থাপিত হয়েছে।
সত্যিই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক আবহাওয়া আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে পাকিস্তান। এমনিতেই নানা কারণে পাকিস্তানকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই। সৃষ্টির আগে থেকেই ফৌজি শাসকরা দেশটির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে তছনছ করে দিয়েছে। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বদলে দেখতে পাওয়া যায় সামরিক শাসনের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রের কালোছায়া। মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টিও পাকিস্তানে শূন্যের কোটায়। মানুষ বসবাস করছে চরম আতঙ্কে। যত্রতত্র ফুটছে প্রাণঘাতী বোমা। অকাতরে মরছে মানুষ। সেই পাকিস্তান এখন আবার রাজনৈতিক কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এবারের রাজনৈতিক সংঘাত নওয়াজ বনাম ইমরানের। খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসেছে ইমরান খানের  নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। এতে কিছুটা হলেও পাকিস্তানের অশান্ত রাজনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে উত্তরণে সংলাপের প্রক্রিয়া চলমান থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পিটিআই’র নেতা শাহ মেহমুদ কুরেশি। দুই পক্ষের বৈঠকের পর তিনি বলেন, সংলাপের প্রথম দফায় পিটিআই প্রতিনিধিবর্গ ৬ দফা দাবি সংবলিত একটি সনদ সরকারের প্রতিনিধিবর্গের কাছে পেশ করেছেন। আজ উভয় পক্ষই নিজেদের আপত্তির বিষয়গুলো মনোযোগ সহকারে শুনেছেন এবং আবার বৈঠকে বসবোা। রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি, নওয়াজ শরীফের উচিত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের পর পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ দলের অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করা। কারণ, ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল না এবং ক্ষমতাসীন দল ভোট-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল বলে অভিযোগ পিটিআইয়ের। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং নির্বাচনী সংস্কার ও নির্বাচন কমিশনে পরিবর্তন দাবি করেছে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন দলটি। পাকিস্তানী তেহরিক-ই-ইনসাফের ৩৪ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের প্রত্যেকে পদত্যাগ করেছেন। জাতীয় পরিষদ স্পিকারের কার্যালয়ে পিটিআই নেতা শাহ মেহমুদ কুরেশি, আরিফ আলভি ও শিরিন মাজারি, দলের চেয়ারম্যান ইমরান খানসহ সবার পদত্যাগপত্র জমা দেন। এদিকে, অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছেন ইমরান খান। সবাই এ ব্যাপারে একমত যে,  ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। বাংলাদেশের মতোই পাকিস্তানেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে যে, অনুন্নত গণতন্ত্রের দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না। হয় সেখানে ক্ষমতাসীন দল, নয় সামরিক বাহিনী অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ ও শক্তি প্রয়োগ করে গণরায়কে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটিকেই তাদের সমস্যা সমাধানের পথ বলে মনে করছেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে না যে, এই দাবি ক্ষমতাসীন নওয়াজ শরীফকে আকৃষ্ট করতে পারবে। ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক উত্তাপ ও অনিশ্চয়তা কতোদিন স্থায়ী হয়, এটা এই মুহূর্তে বলা দুষ্কর। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার স্বার্থে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের আশু সমাধান কামনা করি। আমরা আশা করি, অচিরেই দেশটির হানাহানি, রক্তপাত ও পারস্পরিক সংঘাত বন্ধ হয়ে সুস্থতা ফিরে আসবে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুর প্রতি সকলের সমর্থন প্রমাণ করেছে, আসলেই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটায় না। সামরিক শক্তি, পেশী শক্তি বা রাজনৈতিক শক্তির অবৈধ ব্যবহার করার সুযোগ থাকে। বলতে দ্বিধা নেই, উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় সর্বত্রই ভোটের বা নির্বাচনের ব্যাপারে এমন অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই জনমতকে তোয়াক্কা না করেই ক্ষমতা দখল করা হয়। কিংবা জনগণের ভোটের রায়কে ছিনিয়ে নেয়া হয়। কখনো কখনো ভোট দেয়া ছাড়াই জনপ্রতিনিধি ঘোষণাও করা হয় ক্ষমতার শীর্ষ থেকে। এ ধরনের কার্যক্রম কেবল গণতন্ত্রের জন্যই যে হানিকর তা নয়, মানুষের মৌলিক অধিকারেরও সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অথচ এমন অগণতান্ত্রিকতা আকছার চলছে বিশ্বের নানা দেশে। আমাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায়ও এমন ঘটনা কম নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো এটাই যে, বিশ্বের সর্বত্র গণতন্ত্রের মোড়লরূপে ঘুরে বেড়ানো তথাকথিত গণতন্ত্রীরা এহেন স্বৈরাচারকে উপরে উপরে গাল-মন্দ করলেও তলে তলে মেনে নেয়, সাহায্য করে এবং নানা সুযোগ-সুবিধা হাসিল করে। পশ্চিমা গণতন্ত্রের এ হলো ছলনার মুখোশ। বরং ছলনার মুখোশই যে তাদের আসল চেহারা, তা চিনতেই অনেক সময় কষ্ট হয় সাধারণদের।
আবার এই তথাকথিত গণতন্ত্রীরাই আফগানিস্তান, ইরাক, মিসর, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়াসহ বিশ্বের দেশে দেশে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করে। সামরিক শক্তি দিয়ে গণরায়কে নস্যাৎ করে দিতেও তারা কার্পণ্য করে না। তখন গণতন্ত্রের জন্য তাদের মায়াকান্না আর শুনতে পাওয়া যায় না। পশ্চিমাদের ছলনা ও মায়াকান্নার উপর নির্ভর করলে মানুষকে কেবল ঠকতেই হয়। বিশ্বের ইতিহাস সে কথাই বলে।
অতএব, জনগণকেই নিজ নিজ গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় ও রক্ষা করতে হয়। পশ্চিমা বা অন্য কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে ন্।া বাংলাদেশের মানুষ দলীয় আগ্রাসনের কবল থেকে নিজেদের ভোটের অধিকার রক্ষায় সে কারণেই তীব্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায় ব্যবস্থা প্রচলন করেছিল। এখনও জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই প্রত্যাশা করছে। এজন্য থেমে থেমে আন্দোলন-সংগ্রাম হচ্ছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া অন্য কারো অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে জনগণের প্রধান অংশ এবং বিএনপি-জামায়াতসহ সংখ্যগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলোও মোটেই রাজি নয়। তাই জরুরি জনদাবিরূপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি গুরুত্বপূর্ণ।
এখন পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলার প্রয়োজনে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা শুনতে পাই, তখন এই ব্যবস্থার গুরুত্ব আরো স্পষ্ট হয়। বলা যায়, শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করছে। তাহলে বাংলাদেশে এর গুরুত্ব নিঃশেষ হতে পারে না। সাধারণ কা-জ্ঞানেও অনুধাবন করা যায় যে, রাজনৈতিক অবিশ্বাস আর হানাহানির দেশে সকলকে আস্থায় আনতে পারে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা। কারণ দলীয় ব্যবস্থা কেবল নির্বাচনই নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ক্ষেত্রে দলের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় করে। পদ-পদবি-ক্ষমতা-সুযোগ-সুবিধা ন্যায়ের বদলে দলের ভিত্তিতে বণ্টিত হয়। এটাও এক ধরনের অসাম্য, অন্যায়, দুর্নীতি ও অগতান্ত্রিক পন্থা। যে পন্থা থেকে উন্নয়নকামী দেশসমূহ বের হতে পারছে না। আর পারছে না বলেই সেখানে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কেউ করতে চাইছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে। বাংলাদেশ ও আরো কিছু দেশের পর এ দাবিতে এখন পাকিস্তান উচ্চকিত। অতএব তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার যৌক্তিকতা ও প্রাসঙ্গিকতা যে দিনে দিনে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে কথা সহজেই বলা যায়। কিন্তু এই সহজ ও সরল সত্যটি যাদের অনুধাবন করা দরকার, সেটা তারা করছে না বা করতে চাইছে না। এটাই সবচেয়ে দুঃখের ও বেদনার বিষয়। যে দুঃখ বহন করছে গণতন্ত্রকামী প্রায় সকল মানুষ। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকৃত জনরায়ের প্রকাশ ঘটলেই মানুষের দুঃখ দূরীভূত হবে। গণতান্ত্রিক চেতনার প্রকৃত স্বরূপ উদ্ভাসিত হবে। মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের নিশ্চয়তা নিশ্চিত হবে। এখন কেবলই তেমন দিনের অপেক্ষা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads