বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৩

ত্রাসের পরিণতি, বলপ্রয়োগের পরিণাম এবং সমঝোতার সুফল


১. ইতিহাস ও সভ্যতার হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় ত্রাসের পরিণতি ও বলপ্রয়োগের পরিণাম শুভ হয়নি। হাবিল-কাবিলের ঘটনা থেকে ফেরাউন-নমরূদ বা আধুনিককালের হিটলার-মুসোলিনি-স্ট্যালিন-ইরানের শাহ-পলপট কেউই শক্তির দাপটে টিকে থাকতে পারেনি। প্রতিপক্ষকে নিষিদ্ধ, বঞ্চিত ও আক্রমণ করেও স্বৈরাচারীরা নিজেদের শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনি। সোভিয়েট কমিউনিস্টরা চেয়েছিল অন্য সকল দল ও মতকে নিষিদ্ধ করে কেবল নিজেদের রাজত্ব কায়েম রাখতে। সেই স্বপ্নের সোভিয়েটের লৌহ শাসন তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে। যাদের তারা নিষিদ্ধ করেছিল, তারাই আজকে টিকে আছে। অতএব দল, আদর্শ বা চিন্তাকে শক্তি বা ত্রাসের মাধ্যমে নিষিদ্ধ বা দমন করা যায় না। সাহসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পরাজিত করতে হয়। যখন সেটা করা যায় না, তখনই ভয়ে বা বিপদের আশঙ্কায় নিষিদ্ধ করে নিজে বাঁচতে চায়। অতীতের ইতিহাসে এ রকমভাবে কেউ বাঁচেনি। ভবিষ্যতেও ইতিহাসের নিয়মের বাইরে গিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না।
২.
ইতিহাসের এই সত্য জানার পরেও সবাই সেটা মেনে নেয় না। ক্ষমতার মোহে শক্তি প্রদর্শনকেই প্রিয় মনে করে। প্রতিপক্ষ নিধনকেই আনন্দপূর্ণ কাজ গণ্য করে। অথচ সত্য হলোÑনিধন, নিষিদ্ধ বা হিংসা ও আক্রমণ নয়, শান্তি ও সমঝোতাই শ্রেয়তর। বাংলাদেশে এখন যে সংঘাতময় রাজনীতি চলছে, তাতে সমঝোতা ও আলোচনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ আর কিছুই হতে পারে না। বাংলাদেশে এখন সমঝোতার অভাব সবচেয়ে তীব্র। এমনকি, লন্ডনের ‘দ্য ইকোনোমিস্ট’ পত্রিকায় বাংলাদেশের বিবদমান-উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ‘দ্য ব্যাটলিং বিগামস’ বা ‘দুই যুদ্ধংদেহী বেগম’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দুই নেত্রীর মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনার ব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থেই পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে এমন একটি অমীমাংসিত সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে, সেখানে সমাধানের বদলে বেড়েই চলেছে জনশঙ্কা। সরকার বলছে, নির্বাচন না হলেও তারাই ক্ষমতায় থাকবেন। মেয়াদ শেষ হলেও তারা কিভাবে ক্ষমতায় থাকবেন, সেটা সরকারের মুখপাত্ররা ব্যাখ্যা করছেন না। এ রকমের থাকায় যে প্রচ- বৈধতার সঙ্কট তৈরি হবে, সেটাও তারা ভেবে দেখছেন বলে মনে হচ্ছে না। মেয়াদ শেষেও যদি ক্ষমতায় থাকার খায়েশ প্রকাশ করা হয়, তাহলে যে কেউই তো ক্ষমতায় বসে বলবে, ‘আমি থাকবো।’ গণতন্ত্র কি এ রকমের ক্ষমতা গ্রহণ ও টিকে থাকাকে মেনে নেবে? নেয়ার তো কোনও কারণ দেখা যাচ্ছে না।
৩.
 প্রধান বিরোধী দল বলেছে, নির্দলীয় সরকারের দাবি মানা না হলে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন শুরু করা হবে। বিদেশী কূটনীতিকদের বক্তব্য হলো, দেশের এই সংঘাতময় পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের পথ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরই খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু দেশের দুই রাজনৈতিক জোট আলোচনা, সমঝোতা ও শান্তির পথ তৈরির বদলে উত্তরোত্তর মারমুখী হয়ে উঠছে। সে কারণে ঈদের আনন্দময় উৎসবজনিত ছুটির সময়েও দেশের মানুষের মধ্যে স্বস্তির কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। জনগণ শঙ্কিত হয়ে আছে এটা দেখে যে, ঈদের পরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার বদলে আরও উত্তপ্ত ও গোলযোগপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলের হরতাল ও অন্যান্য কর্মসূচি এবং সরকারি দলের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে সমঝোতা ও মীমাংসার বদলে উত্তেজনার বারুদ বের হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন বাতিল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দলের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে প্রদত্ত শাস্তির প্রতিবাদে একের পর এক হরতাল ডেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সমঝোতার লক্ষ্যে এখনও কোনও আলোচনা বা সংলাপের দেখা না পাওয়ার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিদ্যমান সঙ্কট কমার বদলে ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে যাচ্ছে। নানা আশঙ্কায় আকীর্ণ হচ্ছে মানুষ-সমাজ-রাজনীতি। এই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের সংঘাত ও বিরোধ দেশের গণতান্ত্রিক চর্চাকে ব্যাহত করতে পারে বলেও অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
৪.
দেশ-বিদেশের নানা পর্যায় থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য নেতৃবৃন্দকে এক সঙ্গে বসে মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য বারবার বলা হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান দেশও বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দলের পক্ষে এখন পর্যন্ত সঙ্কট মোচনে ইতিবাচক ও সম্মিলিতভাবে কাজ করাই সম্ভব হয়নি। ফলে সঙ্কট সমাধানের পথ সুদূরপরাহত। সকলের মাথার উপরই সংঘাতের ফলে সৃষ্ট বিপদের হাতছানি। এতেও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বোধোদয় হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর প্রধান আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এজন্য দেশে ও বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। একজন মানবাধিকার কর্মীরই যখন এমন শোচনীয় অবস্থা, তখন দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত বলার দরকার হয় না। গুম-খুন-হামলা-মামলার ঘটনায় সংলাপ বা সমঝোতার সম্ভাবনা দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
৫.  
এটা জানা কথা যে, ত্রাস বা বলপ্রয়োগের বদলে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিতর্ক, মতভেদ থাকাটা স্বাভাবিক একটি বিষয়। এমনকি, ক্ষমতার প্রশ্নে শক্তির প্রতিযোগিতাও গণতন্ত্রে কখনও কখনও দেখা যায়। সরকার শেষ শক্তি দিয়ে হলেও ক্ষমতা ধরে রাখতে ও টিকে থাকতে চায়। বিরোধী দলও ক্ষমতায় যেতে পূর্ণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে সফল হতে চায় গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েই। কিন্তু বিশ্বের কোথাও এ কারণে গণতান্ত্রিক কাঠামো, আদর্শ ও প্রতিষ্ঠান, নিয়মনীতি এবং সংস্কৃতিকে ত্রাসের মাধ্যমে  অমান্য করা হয় না। সব কাজই করা হয় গণতন্ত্রকে মেনেই। সরকারও স্বৈরাচারী হয় না; বিরোধী দলও অগণতান্ত্রিক গোপন পথ বেছে নেয় না। ক্ষমতার স্বার্থে বিশ্বের কোথাও জনগণকে জিম্মি করা হয় না। দলে দলে লড়াইয়ে সাধারণ ও নিরীহ জনগণকে অকাতরে কষ্ট ভোগ করা বাংলাদেশেই সম্ভব হচ্ছে। কারণ, দায়িত্বশীলরা যখন সঙ্কট সমাধান না করে জিইয়ে রাখে, তখন সেটার প্রতিফলন গিয়ে সমাজ ও মানুষকে আক্রান্ত করে। নেতৃত্বের ব্যর্থতার কুফল ভোগ করতে হয় জনতাকে। ত্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে ক্ষমতা বা রাজনৈতিক স্বার্থে খোদ গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরার মতো শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কার কত লাভ বা ক্ষতি, ঠা-া মাথায় সেই হিসাবও কষছে না ক্ষমতার উদগ্র প্রতিযোগিতায় বেপরোয়া দল ও নেতারা। পরিস্থিতি অমীমাংসিত পথে যে দিকে যাচ্ছে, তাতে গণতন্ত্র ও জনগণ কোনও ভয়াবহ ভবিষ্যতের সম্মুখীন হয় সেটা কিন্তু একবারও ভাবা হচ্ছে না। মনে হয় দলগুলোর কাছে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করাই একমাত্র ও শেষ কথা; গণতন্ত্র ও জনগণ আদৌ কোনও বিষয়ই নয়। গণতন্ত্র ও মানুষের স্বার্থের ইস্যুগুলো প্রাধান্য পেলে হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিপক্ষ নিধন ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কেউই পরিস্থিতিকে অব্যাহতভাবে জটিল ও সঙ্কটাপন্ন করে জনশঙ্কা ও জনদুর্ভোগ বাড়াতে পারত না। বাংলাদেশে এখন যা হচ্ছে, তাতে সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকা বা বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাওয়া কতটুকু সম্ভব হবে, সেটা বলা না গেলেও এটা বলা যায় যে, চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চরমভাবে ব্যাহত হবে এবং জনগণের শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে গণতন্ত্র ও জনগণের ক্ষতি হয়ে গেলে ক্ষমতার রাজনীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাজনীতিবিদগণও শেষ পর্যন্ত বিশেষ লাভবান হতে পারবেন বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। বরং তারাই তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই সকলের লাভ হবে। এই সরল সত্য কথাটি যেন সকলেই অনুধাবন করেন। বিদেশী বন্ধুরাও এ কথাটিই বলছেন। মিডিয়া ও সুধী সমাজ থেকেও সমঝোতার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু যে বা যাদের মধ্যে এই বোধোদয় হলে সকলের লাভ হবে, তারাই সেটা বুঝছেন না। ত্রাসের পরিণতি ও বলপ্রয়োগের পরিণাম অপেক্ষা সমঝোতার প্রতিফল যে অনেক শুভ, ফলদায়ক এ ঐতিহাসিক সত্য কথাটি সংশ্লিষ্টরা যখন সত্যি সত্যিই অনুধাবন করতে পারবেন, তখন হয়তো সঙ্কট সমাধানের একটি সুযোগ পেলেও পাওয়া যেতে পারে। তবে সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সে সুযোগটিকে কাজে লাগাতে হবে। তা না হলে, সমাধানহীন সঙ্কট বাড়তে বাড়তে স্বাভাবিক নিয়মেই আরও জটিল হবে এবং সেই উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিসমাপ্তিও আরও ভয়াবহ হবে।
৬.
বাংলাদেশের বিদ্যমান সুতীব্র সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে (১) ত্রাসের পরিণতি, (২) বলপ্রয়োগের পরিণাম এবং (৩) সমঝোতার প্রতিফল এই তিনটির মধ্যে শেষেরটি বেছে নেয়াই হবে ক্ষমতাসীন কর্তাব্যক্তিদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক এবং রাজনীতি, সমাজ ও মানুষের জন্য মঙ্গলজনক।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads