বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৩

নিজেদের প্রগতির পথে নিজেরাই বাধা


এই ঐশী সেই ঐশী নয়। এই ঐশী আত্মহত্যা করেছে। গত মঙ্গলবার নিজ কক্ষের সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে আত্মহত্যাকারী ইশরাত ঐশী ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ ধানমন্ডি শাখার একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে ঐশীর বাবা জানান, কিছুদিন ধরে ‘ঐশী’ নাম নিয়ে সমস্যায় পড়ে সে। নামের কারণে অনেকেই তাকে উত্ত্যক্ত করতো। এছাড়া প্রেমঘটিত কারণেও সে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে। আমাদের আলাপ-আলোচনায় ও মিডিয়ার প্রচার-প্রপাগা-ায়  রাজনীতির খবর এতটাই গুরুত্ব পায় যে, অন্য অনেক মৌলিক বিষয় আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। রাজনীতির এমন এক ভয়ঙ্কর পরিবেশে এখন আমাদের বসবাস যে গৃহে, সমাজে এমনকি একাডেমিক পরিবেশেও আমরা আমাদের প্রকৃত দায়িত্ব পালন করতে পারছি না। রাজনীতির আতঙ্কে এখন আমরা কুপোকাত। একে কি রাজনীতি বলা যায়? এ কারণেই হয়তো বিশ্লেষকদের অনেকে এখন বলছেন, দেশে চলছে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। এ কেমন দেশ, কেমন সমাজ, যেখানে নামের মিলের কারণে একজন কিশোরীকে আত্মহত্যা করতে হয়? অতীতে আমরা লক্ষ্য করেছি, জাহেল সমাজকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আসমান থেকে নবী-রাসূলদের প্রতি ওহী নাজিল হতো। ওহীর সে গ্রন্থকে আমরা বলে থাকি ঐশী-গ্রন্থ। আমরা জানি না ঐশীর বাবা-মা শব্দের মর্ম বিবেচনায় এনে মেয়ের নাম ঐশী রেখেছিলেন কি না। তবে দুঃখের বিষয় হলো, নামের সাথে মেয়েটির কর্মকা-ের  কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় ন। এই গরমিলের কারণে আমাদের সমাজের জন্য ঐশী একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐশী আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আসামীর কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ঐশী নিজেও বলেছে, ‘সন্তান বখে যাওয়া ও মাদকাসক্ত হওয়ার পিছনে অভিভাবকরাই বেশি দায়ী। ধারাবাহিক অবহেলা, শাসনের নামে মানসিক নির্যাতন চালানো, নিজেদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার মধ্য দিয়েই সন্তানদের দূরে ঠেলে দেয়া হয়। এ ধরনের  একাকিত্ব আর হতাশা থেকেই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা মাদকে জড়িয়ে পড়ে, ক্ষোভে-দুঃখে তারা নিজেদের ঠেলে দেয় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে’। কোনাবাড়ি কিশোরী সংশোধন উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে ঐশী আরো জানায়, রাজধানীর অনেক পরিবারে বখে যাওয়া বহু ছেলেমেয়ে রয়েছেÑ আরো নানা অঘটন ঘটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। এরপর একদমে প্রায় একডজন মাদকাসক্ত বন্ধু-বান্ধবীর নাম উল্লেখ করে সে বলে, এরা সবাই অভিজাত পরিবারের সন্তান। বাসাবাড়ি ছেড়ে দু’চারদিন যেখানে-সেখানে কাটিয়ে এলেও কারো কাছে এদের কোনো কৈফিয়ত দিতে হয় না। আমিও শুরুতে এমন স্বাধীনতা ভোগ করে আসছিলাম। কিন্তু এতে পরে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার মা-বাবা। গত কয়েক মাস ধরে তো আমি আর আমার জ্ঞান-বৃদ্ধিতে চলতাম না। ইয়াবা বন্ধুরা যা বলতো তা-ই আমার কাছে বেদবাক্য বলে মনে হতো। তারা যে যুক্তি দিতো তা-ই আমার কাছে পৃথিবীসেরা পা-িত্য বলে মনে হতো।
ঐশী বলেছে, রাজধানীর বহু পরিবারেই রয়েছে মাদকাসক্ত ছেলেমেয়ে। কিন্তু শুধু কিশোর-কিশোরীরাই কি এখন মাদকাসক্ত হয়ে বখে যাচ্ছে? না, শুধু কিশোর-কিশোরীরাই নয়, মাদকের ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে আমাদের পুরো সমাজই। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুন-খারাবির ঘটনা লক্ষ্য করেছি আমরা। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়েছে মাদক ও মাদক ব্যবসার সাথে। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যকেও মাদক চক্রের সাথে সম্পর্ক রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশেষে মাদকের সাথে যুক্ত হতে দেখলাম বিচারকের নামও। অবৈধভাবে নিজ হেফাজতে ফেন্সিডিল রাখার অপরাধে ভোলার সিনিয়র সহকারী জজ জাভেদ ইমামকে ৪ বছর সশ্রম কারাদ- দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে আদালত ১০ হাজার টাকা জরিমানাও করেছেন। এসব ঘটনা থেকে মাদক দ্রব্যের ব্যাপক প্রসারের সাথে সাথে সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।
ঐশীর ঘটনা প্রসঙ্গে এখন অনেকেই কথা বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, প্রথমেই ঐশীর মানসিক চিকিৎসা করা প্রয়োজন। ঐশীর মানসিক চিকিৎসার ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকতে পারে না, কিন্তু আজ মনে হচ্ছেÑ আমরা যারা ঐশীকে সৃষ্টি করেছি বহু আগে তাদেরই মানসিক চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন ছিল। আমি যখন এ কলামটি লিখছি তখন পত্রিকার পাতায় দৃষ্টি পড়লো এক প্রফেসরের লেখার প্রতি। তিনিও স্বীকার করেছেন, ঐশীরা আমাদেরই সৃষ্টি। তিনি আফসোস করে বলেছেন, আমাদের ছেলে-মেয়েরা সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে বায়েজিদ বোস্তামি কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির কথা জানতে পারে না। তিনি আরও লিখেছেন, মা-বাবার সেবার মধ্যে রয়েছে জান্নাতের নিশ্চয়তা, তাদের কষ্ট হয় এমন উফ শব্দও উচ্চারণ করা যায় না। অথচ আজ শুধু দুর্ব্যবহারই নয় বাবা-মাকে হত্যা করতেও পিছপা হচ্ছে না সন্তান। মূল কথা হলো, শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য যে নীতি-নিষ্ঠা তা যেন এখন আমাদের সমাজ থেকে লুপ্ত হতে বসেছে। আমরা জানি, সন্তানের জন্য পিতা-মাতার শ্রেষ্ঠ উপহার হলো উত্তম শিক্ষা-দীক্ষা। কিন্তু এখন অধিকাংশ অভিভাবকই সমাজে প্রশংসা লাভের উদ্দেশ্যে ছেলে-মেয়েকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু আধুনিকতার মূলে যদি নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ভিত্তি না থাকে, তাহলে তা যে কত ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে তার বড় প্রমাণ ঐশী। ঐশী অভিযোগ করেছে, অভিভাবকদের ধারাবাহিক অবহেলা, শাসনের নামে মানসিক নির্যাতন ও নিজেদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার কারণেই সন্তানরা একাকিত্ব  ও হতাশা থেকে জড়িয়ে পড়ে মাদকে। অবশেষে ক্ষোভে-দুঃখে নিজেদের ঠেলে দেয় ধ্বংসের পথে। ঐশীর এমন অভিযোগকে অস্বীকার করা যায় না। আর এমন পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। একটি সমাজ উন্নয়ন ও প্রগতির পথে এগুতে পারে নৈতিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্য-চেতনা ও কর্মপ্রণোদনার মাধ্যমে। এমন রোডম্যাপ থেকে আমাদের সমাজ বিচ্যুত হয়েছে বেশ আগেই। এসব বিষয় উপলব্ধি করে দায়িত্ব পালনের কথা ছিল দেশের রাজনীতিবিদ, সমাজপতি শিক্ষাবিদ, আলেম-ওলামা, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিসেবীদের। কিন্তু সমাজের দায়িত্বশীলরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। এমন অবস্থায় গুরু দায়িত্বের বোঝা এসে চাপে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত সরকারের ওপর। সরকার নিজের দায়িত্বের গভীরতা উপলব্ধি করলে সমাজ সঠিক পথে তাদের যাত্রা শুরু করতে পারে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, অন্য সবার মতো সরকারও সময়োপযোগী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। ফলে সমাজে চলছে সুশাসনের বদলে দলীয় শাসন, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের পরিবর্তে চলছে  অনুরাগ ও বিরাগের আচরণ, শিক্ষার সঠিক লক্ষ্য ও পরিবেশ না থাকায় বিভ্রান্ত হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা, শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠার মতো নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় তারা জড়িয়ে পড়ছে ডিজেপার্টি ও ইয়াবার সাথে। এসব বিষয়ে কোনো দেশের সরকার ও সমাজ সচেতন না হলে, দায়িত্ব পালনে এগিয়ে না আসলে ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ে দেশের ও তরুণ সমাজের কোনো কল্যাণ হবে না। রাজনীতিতে ও সমাজে এখন যেভাবে লোভ-লালসা ও সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতা চলছে তাতে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বসবাসযোগ্য  জনপদ রেখে যেতে পারবো না। তাই এখন প্রয়োজন হিংসা-বিদ্বেষ ও নির্মূলের রাজনীতি পরিহার করে নীতি-নৈতিকতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সঠিক এক কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা। নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছোটবড় নির্বিশেষে সবাই যথাকর্মে তৎপর হলে আমাদের উন্নতি ও প্রগতি কেউ রুখতে পারবে না।  কিন্তু এখন তো আমরা নিজেদের প্রগতির পথে নিজেরাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি। নিজেদের বিরুদ্ধে নিজেদের দাঁড়াবার এমন মূর্খতা থেকে কি আমরা মুক্ত হতে পারবো না?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads