শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

গডফাদারকে হত্যাকারীর লাইভ টেলিকাস্ট


খুনে ব্যবহৃত পিস্তল কি বৈধ ছিল? পিস্তলের লাইসেন্সই বা কার নামে? ফোনের অপর প্রান্তের সেই ‘মহামান্য’ গডফাদারই বা কে? দেশবাসী জানতে পারবে কি এসব প্রশ্নের জবাব? যুবলীগের ঢাকা মহানগর দেিণর এক নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান ওরফে মিল্কির নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ঘিরেই এসব প্রশ্ন। গত ২৯ জুলাই রাতে গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে যুবলীগ নেতা মিল্কিকে অনেক লোকের সামনে গুলি করে হত্যা করেন যুবলীগেরই আরেক নেতা এইচ এম জাহিদ সিদ্দিকী তারেক। এ ঘটনায় ৩০ জুলাই রাতে মিল্কির ভাই মেজর রাশেদুল হক খান গুলশান থানায় ১১ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামি তারেকও যুবলীগের ঢাকা মহানগর দেিণরই যুগ্ম সম্পাদক। অর্থাৎ খুনি তারেক ও নিহত মিল্কি শুধু একই রাজনৈতিক দলের নেতাই নন, তারা একই শাখায় কাজ করতেন। বিপণিকেন্দ্রের গোপন সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা দৃশ্য দেখে তারেকসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মাত্র ১৪ সেকেন্ডে একেবারে কাছে থেকে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি করে মিল্কিকে নির্মমভাবে হত্যাকারী তারেক ছিল মিল্কির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু। মতিঝিল কলোনিতে একই সাথে বেড়ে ওঠা। বছরখানেক আগেও তারা একই সাথে রাজনীতি করেছেন, ঠিকাদারি করেছেন। বছর দেড়েক আগে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মিল্কি। এ নিয়ে মতিঝিলের আওয়ামী লীগের এক নেতার সাথে তার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া কমিটিতে পছন্দের লোক নেয়া না নেয়া, বাড্ডা এলাকার নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলের কয়েকজন নেতার সাথে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয় মিল্কির। ধীরে ধীরে তা চরম আকার ধারণ করে। এ ছাড়া মিল্কির এক অপছন্দের লোক বাড্ডা যুবলীগের ওয়ার্ড কমিটিতে স্থান পায়। এতে মিল্কি বিরোধিতা করায় ওই নেতাও তার ওপর প্তি ছিলেন। এভাবে এক দিকে তার বিশাল শত্র“প গড়ে ওঠে, অন্য দিকে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে তারেকের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয় মিল্কির। শেষ পর্যন্ত নিজেদের দ্বন্দ্বেরই বলি হতে হলো মিল্কিকে। কিন্তু এভাবে মোবাইলে বর্ণনা দিতে দিতে এমন ঠাণ্ডামাথায় খুন এর আগে কেউ দেখেছেন কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। দেশের মানুষ এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিষয়টি উপলব্ধি করতেও যেন সচেতন পাঠকের এক মুহূর্ত দেরি হয়নি। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের অনলাইনে পাঠকের মন্তব্য দেখলেই বোঝা যায়। উদাহরণস্বরূপ পাঠকের কিছু মন্তব্য এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো : ‘আমরা কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ল করছি না। তারেক খুন করার সময় তার মোবাইল ফোনে গডফাদারকে গুলি ও চিৎকার শোনাচ্ছে। অন্য পাশের ব্যক্তি কী পরিমাণ মতাধর হলে গুলি করার সময় তার (খুনির) একটা হাত ব্যস্ত রাখতে হয় ফোন ধরে রাখতে তা কি কেউ চিন্তা করেছেন?... তারেক ঠাণ্ডামাথায় গুলি করতে করতে লাইভ ব্রডকাস্ট করে বসের মনোরঞ্জনও করছিল। আমাদের জানতে হবে তারেক কাকে শোনাচ্ছিল? ওই বিকৃত মানসিকতার গুলি আর রিয়াজের (মিল্কির) আর্তনাদ শ্রবণকারী হচ্ছে আমাদের সমাজের আসল ঘুণ পোকা। এমপি পদমর্যাদার নিচে হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। মন্ত্রীও হতে পারে। আসুন সবাই মিলে একটাই দাবি তুলি, ওই ঘুণ পোকার নাম প্রকাশ করা হোক।’ ‘আমরা এই গডফাদারের চেহারা দেখতে চাই। আজই, এখনি। মোবাইল অপারেটরদের সুবাদে এটা জানা এখন ওয়ান টুর ব্যাপার। আশা করি ওই শয়তানের মুখোশ অচিরেই উন্মোচিত হবে ও তার শয়তানি শক্তি ধ্বংস হবে।’ পত্রিকার খবরে আরো প্রকাশ, ‘যুবলীগের এক দাপুটে নেতার সাথে কথা হচ্ছিল তারেকের। অতি সম্প্রতি ওই নেতা শীর্ষ সারির এক নেতায় পরিণত হয়েছেন এবং এখন তিনি ব্যাপক আলোচনায়। একটি সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি র‌্যাব ও পুলিশের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু তারা বিষয়টি প্রকাশ করছে না।’ এ দিকে ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রধান আসামি তারেক ও শাহ আলমকে উত্তরা থেকে গুলশান থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এ সময় খিলতে এলাকায় আসামিদের ছিনিয়ে নিতে সন্ত্রাসীরা র‌্যাবকে ল করে গুলি চালায়। র‌্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এতে তারেকসহ দুইজন নিহত হয়। গডফাদারকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতেই এই ক্রসফায়ারের ঘটনা কি না অনেক পাঠকেরই এমন প্রশ্নও রয়েছে। তবে, আরো কিছু দিন গেলেই হয়তো আসল ঘটনা পরিষ্কার হবে। পবিত্র রমজান মাসে সাদা পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি পরে খুন করার মধ্য দিয়ে হত্যাকারীদের ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক ফায়দা লোটার পরিকল্পনা ছিল কি না তা নিয়েও সচেতন পাঠকের রয়েছে গভীর সন্দেহ। আবারো কয়েকজন পাঠকের মন্তব্যের মধ্য দিয়েই বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক : ‘নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ আওয়ামী লীগের পুরনো অভ্যাস। জামায়াতকে ফাঁসাতেই হাইকমান্ডের নির্দেশেই পাঞ্জাবি টুপি পরা সন্ত্রাসী কর্তৃক এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বেরসিক সিসিটিভি মাঝখানে সব গোমর ফাঁস করে দিলো।’ ‘এভাবেই সাদা পাঞ্জাবি পরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ শাপলা চত্বরে আলেম-ওলামাদের হত্যা করেছিল। আজ ছবিটি দেখে তা বিশ্বাস করতে হচ্ছে।’ ‘এভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করা যুবলীগের পুরাতন বৈশিষ্ট্য। কিন্তু হেফাজতের পোশাক পরে কেন? সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকলে এতণে হয়তো হেফাজতের দুই ডজন নেতাকে গ্রেফতার করা হতো।’ ‘এ হত্যাকারীর পাঞ্জাবি টুপি পরার রহস্য কী? আওয়ামী বুদ্ধি প্রয়োগ করে সে হয়তো বাঁচতে চাইছিল। হায়রে সিসি ক্যামেরা, তুমি না দেখলে আজ হয়তো হানিফ সাহেব বলতেন এ হেফাজত আর জামায়াতের কাজ।’ ‘সিসি ক্যামেরার এ দৃশ্য ধারণ না হলে বা দৃশ্যে দেখা না গেলে এবং যুবলীগ নেতা জাহিদ সিদ্দিকী তারেক গ্রেফতার না হলে সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা প্রচার করতেন মিল্কি হত্যাকাণ্ডের সাথে মৌলবাদী জড়িত। কারণ ঘাতকদের মাথায় ছিল সাদা টুপি, গায়ে সাদা রঙের পাঞ্জাবি।’ ‘১৪ সেকেন্ডে নৃশংস খুন। মনে হয় এবার বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছে। চলুন আমরা সরকারকে বলি ওদের জন্য ভালো একটা পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে। হায়রে আমার সোনার বাংলাদেশ, আর নোংরা রাজনীতি। এরা পশুর চেয়েও অনেক খারাপ আর ভয়ঙ্কর।’ ‘যুবলীগ নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। ওরা মারবে, মরবে ও কামড়া-কামড়ি করে যে টিকবে, সে একদিন দলের বড় নেতা হবে। ভোট চাইবে, আমরাও ভোট দেব। তারপর টেলিভিশনের টকশোতে বাজিমাত করে টকশো বিশেষজ্ঞে পরিণত হবে।’ আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া অতীব জরুরি। আর সেটি হলো যে পিস্তল দিয়ে মিল্কিকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারেক, সেই পিস্তলটি বৈধ ছিল কি না। বৈধ হলে কার নামে সেটির লাইসেন্স ছিল? আর অবৈধ হলে এমন অবৈধ কী পরিমাণ অস্ত্র এখনো যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হাতে রয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। কারণ প্রতিপকে ঘায়েল করতে সযতেœ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হাতে তুলে দেয়া এসব অস্ত্র শেষ পর্যন্ত নিজেদের কোন্দলেই বেশি ব্যবহৃত হয় কি না, তা নিয়ে এখন নতুন করে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সব রাজনীতিবিদের বিশেষ করে মতাসীনদের উদ্দেশে একটি অতি সাধারণ গ্রামীণ প্রবাদবাক্য দিয়ে লেখা শেষ করছি, ‘পরের জন্য কুয়ো খুঁড়লে, সেই কুয়োয় নিজেকেই পড়তে হয়

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads