মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০১৩

নির্বাচন নাকি গণতন্ত্র?


বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবার আগে আদৌ কোন নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে সংশয় নতুন নয়। হয়তো হবে না, হয়তো হবে। ভদ্রলোক সমাজে যে উদ্বিগ্নতা আমরা দেখছি তাকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক পে রয়েছে আইনী উদ্বিগ্নতা। যেমন, এই সরকারের মেয়াদ শেষ হলে যে সাংবিধানিক জটিলতা তৈরী হবে তার মীমাংসা কিভাবে হবে? আরেক ধরণের উদ্বিগ্নতা হচ্ছে সামাজিক। সেটা হোল নির্বাচন যদি না হয়, মতাসীনরা যদি একতরফা নির্বাচন করে, তাহলে দেশে একটা সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে। সেটা সামাল দেওয়ার উপায় কি? বড়লোকদের জানমাল রার ব্যবস্থা কিভাবে হবে? পাহারাদারি কে করবে? পুলিশ? সরকারের মেয়াদ শেষ হলে পুলিশও নাকি চোখ উল্টিয়ে ফেলে, আর হাওয়া যদি ভিন্ন ভাবে বইতে শুরু করে তাহলে তো কথাই নাই। সহিংসতা ও অস্থিরতা পুলিশ সামাল দিতে পারবে না । তাহলে কি সেনাবাহিনী? এই আতঙ্ক ও ভীতি থেকেই তৃতীয় শক্তির কথা আমরা হামেশা শুনি। তাহলে তো বড়লোকদের জানমাল রার জন্য তৃতীয়শক্তিকে আসতেই হয়। নইলে তাদের রা করবে কে? ফলে রাজনৈতিক দলের ওপর ত্যক্তবিরক্ত সমাজের বিশাল একটা অংশ প্রকাশ্যে কিম্বা গোপনে সেনাশাসনের পে চলে যায়। রাজনৈতিক দলগুলো এটা মোটেও পছন্দ করে না। এটা টের পেয়ে হন্তদন্ত শেখ হাসিনা আগাম ধমক দিয়ে বেড়াচ্ছেন যে অসাংবিধানিকপথে কাউকে মতায় আসতে দেওয়া হবে না। তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গেও দেনদরবার করে বেড়াচ্ছেন। হয়তো তার অনুমান বিপদ যদি আসে তাহলে তার উৎপত্তি সেনাছাউনি থেকেই ঘটবে। এই বিপদের আশংকা তিনি করছেন অনেক দিন ধরেই। এটা সাম্প্রতিক নয়। বিডিআর সেনাবিদ্রোহের পর থেকেই এই আতঙ্ক তার মধ্যে কাজ করছে। প্রতিরাব্যবস্থা হিসাবে ২০১১ সালের জুলাই মাসে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনা সংবিধান বদলিয়ে নিয়েছেন । সেখানে সন্নিবেশিত হয়েছে নতুন ৭(ক) এবং ৭(খ) অনুচ্ছেদ। সেখানে যা বলা হয়েছে তার সারমর্ম পরিষ্কার। তা হোল, কারো যদি বুকের পাটা থাকে তাহলে পঞ্চদশ সংশোধনী সম্বলিত সংবিধান কিম্বা তার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিতকরবার চেষ্টা করুক। অসাংবিধানিক ভাবে মতা দখল তো দূরের কথা। বদলাবার কোন চেষ্টা দেখলেই মজা দেখিয়ে দেওয়া হবে। অসাংবিধানিক পথ বলতে প্রথমে বোঝায় সশস্ত্র অভ্যুত্থান। কিন্তু সেটাই একমাত্র অসাংবিধানিক পথ নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতে অসাংবিধানিক পথ বলতে শুধু শক্তির প্রদর্শনবা শক্তির প্রয়োগবোঝানো হয় নি। অন্য কোন ভাবেও হতে পারে, ‘অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়’ ! সেটা কেমন? যেমন গণ অভ্যুত্থান। আর কিভাবে হতে পারে? জাতিসংঘের শান্তি মিশন। তবে তার জন্য প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে বাংলাদেশে এক এগারো ঘটাবার আগে একে ব্যর্থ রাষ্ট্রহিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা হয়েছিল। তখন মতায় ছিল চারদলীয় জোট। সেই সময় সুশাসন’, ‘সৎপ্রার্থী নির্বাচন’, দুর্নীতি প্রতিহত করবার বিবিধ জেহাদ আমরা প্রত্য করে ছিলাম। যারা সেইসব কাণ্ড করেছিলেন, চেনা জানা মানুষ তারা। এই সরকারের আমলে অবশ্য তাদের আওয়াজ ীণই মনে হয়। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশকে তারা ব্যর্থ রাষ্ট্রপ্রমাণ করবেন না এটা আমরা ধরে নিতে পারি। কারণ ইসলামি রাজনীতির উত্থান ঠেকানোর জন্য শেখ হাসিনা তাদের মিত্র। তাহলে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছে সেনা অভ্যুত্থান ও গণ-অভ্যুত্থান ঠেকানোর জন্য। তাই কি? না, শুধু তাই নয়। এমনকি কাউকে শক্তি প্রদর্শন, শক্তি প্রয়োগ বা গণ-অভ্যুত্থানও করতে হবে না। সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য কোন উদ্যাগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলেসেটাও রাষ্ট্রদ্রোহিতাহবে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চশাস্তি। মৃত্যুদণ্ড। তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। জনগণ কেমন রাষ্ট্র চায় এবং তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ার সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের যে অসঙ্গতি ও বৈরী চরিত্র সে সম্পর্কে কিছু বলার অধিকার এভাবেই হরণ করা হয়েছে। কিচ্ছু বলা যাবে না। সংবিধান নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার ুণœ করলেও তার বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা করা নিষেধ, কোন বিধানের প্রতি নাগরিকদের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এই ধরণের ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ে রেখে বর্তমান সরকার দেশ শাসন করছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই কাজ করতে কেউ যদি সহযোগিতাকরে বা উসকানিদেয় কিংবা এই কাজ অনুমোদন’, ‘মার্জনা’, ‘সমর্থনবা অনুসমর্থনকরে তাকেও একই অপরাধে শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। এরপর রয়েছে ৭(খ) অনুচ্ছেদ। সেখানে জাতীয় সংসদের মতা খর্ব করা হয়েছে। সংবিধান জাতীয় সংসদকে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সংবিধান সংশোধনের কিম্বা নতুন আইন প্রণয়নের মতা দিয়েছে। কিন্তু ৭(খ) অনুচ্ছেদ বলছে এই ধরণের মতা ১৪২ অনুচ্ছেদে দেওয়া থাকলেও সেটা আর জাতীয় সংসদ সকল অনুচ্ছেদের েেত্র খাটাতে পারবে না । কিছু কিছু অনুচ্ছেদের েেত্র সংযোজন’, ‘পরিবর্তন’, ‘প্রতিস্থাপন’, ‘রহিতকরণকরা যাবে না। সেটা ১৪২ অনুচ্ছেদের মতাবলেই হোক, কিম্বা হোক অন্য কোন পন্থায়। রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র ও কাঠামোর অতি গোড়ার ও মৌলিক জায়গাগুলোর গণতন্ত্রবিরোধী বিকারকে আমি সবসময়ই ফ্যাসিস্টবলে আসছি। জনগণের গণতান্ত্রিক আশা, আকাক্সা ইচ্ছা সঙ্কল্প ইত্যাদিকে নস্যাৎ করে দেবার জন্য রাষ্ট্রের যে ভীতিকর ও ভয়ানক পরিগঠন সেই চরিত্রের দিকেই নজর নিবদ্ধ করবার জন্য ফ্যাসিস্টবলা। অনেকে বলেন এই রাজনৈতিক বর্গটি এতোই কিশে হয়ে গিয়েছে যে এটা এখন গালাগালির মতোই শোনায়। সে ব্যাপারে সাবধান করবার জন্য আমি বারবারই বলি ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা নিন্দাসূচক একটি ধারণা নয়। রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট বিকার বা সংকট ধরিয়ে দেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। রাষ্ট্র বা সরকারকে শুধু গণবিরোধী বা গণতন্ত্র বিরোধী বললে কিছুই বলা হয় না। সংবিধানে গণতন্ত্রের অনেক অভাব থাকতে পারে। রাষ্ট্র অবিকশিত হতে পারে। কিন্তু যখন বলা হয় যে সংবিধান নামক যে আইনী অস্ত্র দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তি শাসন করে সেই সংবিধানের বিরুদ্ধে কিছুই বলা যাবে না তখন আমরা একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থারই মোকাবিলা করি। এটা একনায়কতন্ত্র। কারণ ফ্যাসিজমের জনসমর্থন থাকে। এই সরকারেরও রয়েছে। যে কারণে বারবারই বলি, আবারও বলব যে ফ্যাসিস্টকথাটি কোন গালাগালির ভাষা নয়। প্রধানমন্ত্রীর অসৌজন্যমূলক ভাষা ও রূঢ় ভঙ্গি দিয়েও তার শাসনামলকে বিবেচনা করছি না আমরা। কিম্বা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস ও সহিংসতা নিয়েও এখানে কথা হচ্ছে না। কারণ সন্ত্রাস ও সহিংসতা প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সেখানে মাত্রার হেরফের থাকতে পারে। ধনী ও শোষক শ্রেণির কোন দলই বলপ্রয়োগ ছাড়া রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারে না। সেটা অসম্ভব। গায়ের জোর কিম্বা পুলিশি ঠ্যাঙানি তারা শুধু গরিব, অসহায় ও খেটে খাওয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে তা নয়। পরস্পরের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করে। বলপ্রয়োগের প্রতিযোগিতা পরস্পরের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতারই অংশ। সেই েেত্র বরং অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং যে নিজেরা সন্ত্রাসী হয়েও কিভাবে তাদের শ্রেণি ও গোষ্ঠির জন্য বিপজ্জনক বামপন্থা বিশেষত মাওবাদীদের কিম্বা ইসলামপন্থি দল বা প্রবণতাগুলোকে অতি অনায়াসেই গণমাধ্যমের শক্তির জোরে সন্ত্রাসীবলে তারা চিহ্নিত করতে পারে এবং সমাজে তাদের দেওয়া এই মার্কা মারা ট্যাগ প্রতিষ্ঠিত করতেও সম হয়। এই হোল সাংবিধানিক দিক থেকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার চেহারা। আর অন্যদিকে বিচার বিভাগের য়। বিচার বিভাগ নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে, এখানে নতুন কিছু বলার নাই। তবে প্রশ্ন তুলতে পারি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের যে ভূমিকা থাকে বিচার বিভাগ তাঁদের সেই ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন ও সজ্ঞান? গণতন্ত্রে তাঁদেরকেও জবাবদিহি করতে হয়। আমরা এখানে বিচার বিভাগের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার কথা তুলতে চাই না। যেমন জুডিশিয়াল রিভিউ। বরং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে বৈচারিক জবাবদিহিতার যে ধারণা রয়েছে সে প্রশ্নটাই তুলতে চাই। বিচারক ও বিচার বিভাগের বৈচারিক ন্যায্যতা নাগরিকদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রার সংকল্প ও হিম্মত থেকেই তৈরী হয়। তারা কি বোঝেন যে এটাই তাদের প্রধান কাজ? আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নাগরিক আর মানবিক অধিকার রা করবার জন্যই ঐতিহাসিক ভাবে গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের মিস্টেরিয়াস কোন বেসিক স্ট্রাকচার, বেসিক ফিচার বা মৌলিক কাঠামো রার মামলা এটা নয়। নাগরিক ও মানবিক অধিকারের প্রশ্ন বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো বা বেসিক স্ট্রাকচারের চিন্তা গণতন্ত্র বিরোধী। সেই কাঠামো দিয়ে নাগরিকদের কী লাভ যা তাকে রাষ্ট্রের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খুঁটি হচ্ছে নাগরিক ও মানবিক অধিকার। আসল খুঁটিই যদি না থাকে তাহলে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো বা বেসিক স্ট্রাকচারের তর্ক ভূয়া তর্ক ছাড়া কিছুই নয়। আসল খুঁটি নয়া থাকলে রাষ্ট্রের ভেঙে পড়া ঠেকাবে কে? যে রাষ্ট্র আমার অধিকার নিশ্চিত করে না, সেই রাষ্ট্রের ভেঙে পড়া আমি ঠেকাবো কেন? সম্প্রতি এই অধিকারের ধারণাও সম্প্রসারিত হয়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছাড়াও অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। সেটা আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। যার অর্থ হচ্ছে এই অধিকারগুলো সুরার দায় আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের ঘাড়ে এসে পড়েছে। সংবিধানে সেইসব সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ থাকুক আর না-ই থাকুক। বিচারকেরা জানেন তাঁরা নির্বাচিত নন, কিন্তু তাঁরা এজলাসে বসে যে নির্দেশ দেন সেটা নিছক নির্দেশ বা আদেশ নয় বরং রায়। এই কারণেই নির্বাহী বিভাগ তা বলবৎ করতে বাধ্য কারণ রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি রার দায় বিচারকের ওপরই ন্যস্ত। কিন্তু ততণই কেবল যতণ তারা প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক ও মৌলিক মানবিক অধিকার রা করতেই এজলাসে বসেন। একটি মামলার বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাঁরা কিভাবে তা রা হচ্ছে তা প্রদর্শন করেন। জাতীয় সংসদ কিম্বা নির্বাহী বিভাগ যদি নাগরিক ও মানবিক অধিকার ুণœ করে এবং কোন নাগরিক বিচারকের কাছে নালিশ জানান তাহলে তার বিহিত করবার দায় বিচার বিভাগেরই। জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগ যদি রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে নষ্ট করতে চায় বা বিকারগ্রস্ত করবার চেষ্টা করে তাহলে তা রুখে দেবার মতাও জনগণের তরফে তাঁদেরই হাতে। এই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে বিচারকদের সঙ্গে প্রতিটি নাগরিকের যে নৈতিক সম্বন্ধ নিরন্তর স্থাপিত ও পুনর্স্থাপিত হতে থাকে তার তাৎপর্য নির্বাচিত প্রতিনিধির আইন প্রণয়নী শক্তি বা নির্বাহী মতার চেয়েও অনেক বেশি। এই সম্বন্ধ রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকেই শুধু যাচাই করে না, এই নৈতিক ভিত্তির য় ঘটলে রাষ্ট্রের য়ও অনিবার্য হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রকে নতুন গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো ছাড়া তখন আর কোন বিকল্প থাকে না। নাগরিক ও মানবিক অধিকার রার েেত্র বিচারকের ন্যায়পরায়ণতা রাষ্ট্রকে শুধু নৈতিক ভিত্তি দেয় তা নয়, সমাজকেও তার নীতিনৈতিকতার জায়গাগুলো বারবার পরখ করে নিতে সহায়তা করে এবং রাষ্ট্রের চরিত্র মূল্যায়নের েেত্র মানদণ্ড হিসাবে কাজ করে। যেমন, অভিযুক্ত নাগরিকের আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইন অনুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভের মর্যাদা যদি বিচার বিভাগ বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার পরিণতি হয় মারাত্মক। একজন বিচারক যদি এই েেত্র কেউ ব্যর্থ হয় তাহলে সেই বিচারককে বিচার বিভাগকে বরখাস্ত করা যেতে পারে, কিন্তু খোদ বিচার বিভাগই যদি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গে পরিণত হয় তখন সেটা একটি জনগোষ্ঠির জন্য চরম রাজনৈতিক জুলুম হয়ে ওঠে। অকথিত দুর্দশা হয়েই সেটা হাজির হয়। ফ্যাসিবাদকে অতএব রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রের দিক থেকেই বুঝতে হবে। এই দিকটার ওপরই আমি বারবার জোর দিয়েছি। এই দিকটি পরিচ্ছন্ন না থাকলে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রের চরিত্র এবং সেই পরিপ্রেেিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট কর্তব্য কি হতে পারে সে ব্যাপারে অস্পষ্টতা থেকে যাবে। আমি দেখছি, সমাজের যে সকল রাজনৈতিক প্রবণতা পরস্পরের সম্ভাব্য রাজনৈতিক মিত্র হতে পারে এই অস্পষ্টতার কারণে তারা পরস্পরের রাজনৈতিক দুষমনেও পরিণত হয়ে আছে। কারণ রাজনীতির বিচার হচ্ছে যার যার বদ্ধমূল মতাদর্শ থেকে। এই মুহূর্তের কর্তব্য নির্ধারণের তাগিদ থেকে নয়। এ ব্যাপারে আমাদের সমাজে আলোচনা নাই বললেই চলে। রাষ্ট্র সহ আমাদের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকারকে সামগ্রিক ভাবে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসাবে শনাক্ত করা ও বিশ্লেষণ করা এ কারণে জরুরী। রাষ্ট্রের বিকারের ভয়াবহ দিক হচ্ছে সংবিধানের পরিবর্তন এবং দ্বিতীয় দিক হচ্ছে বিচার ব্যবস্থার য়। দলীয় হাতিয়ার হিসাবে বিচারব্যবস্থার ব্যবহার তার প্রকট দিক। নাগরিক হিসাবে এই য়ের সবচেয়ে উৎকট নজির হচ্ছে নাগরিকদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রা দূরে থাকুক, উল্টা বিচার বিভাগ নাগরিকদের নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। অনেকে মতাদর্শ বা সংস্কৃতি বিচার করেই ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। যেমন দাবি করা হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ যদি ফ্যাসিস্ট হয়ে থাকে তাহলে ইসলামপন্থী রাজনীতিও ফ্যাসিস্ট। অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু মতায় ইসলামপন্থিরা নাই, মতায় রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা। তারাই সংবিধানের এই দশা করেছে। তারাই ধর্মনিরপেতা ও ধর্মীয় রাজনীতি বিরোধিতার নামে মূলত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের গণভিত্তি হিসাবে ভূমিকা রাখে। হেফাজতে ইসলামকে শাপলা চত্বর থেকে নির্বিচারে হত্যা করে তাড়িয়ে দেবার পে গণমাধ্যমের নির্লজ্জ ওকালতি দেখেছি আমরা। এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের পে বহু জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টকেই আমরা গীত গাইতে দেখেছি। যেকোন মতবাদই যদি পঞ্চদশ সংশোধনীর মত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করবার কথা তাহলে তাকেও অবশ্যই ফ্যাসিস্ট বলতে হবে। তাই না? কিন্তু আমরা তো এখন আর বলাবলি বা মতাদর্শিক জায়গায় নাই, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেই আমরা বাস করছি। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণ নানান মতাদর্শ নিয়ে, নানান রাজনৈতিক বিশ্বাসের জায়গা থেকে লড়বে। সেটা যেমন হতে পারে কমিউনিস্টরা, সেটা ইসলামপন্থিরাও হতে পারে। কিম্বা আওয়ামী লীগ বা বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিরোধিরাও রাস্তায় থাকতে পারে। যে কারণে বাংলাদেশের বাস্তবতায় সংবিধান ও বিচারব্যবস্থার পর তৃতীয়পর্যায়েই কেবল বাংলাদেশে বিভিন্ন মতাদর্শ ও সংস্কৃতির বিচার বা পর্যালোচনার কর্তব্য ওঠে। বিশেষত এই দিকটি বোঝাবার জন্য যে কিভাবে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ও সংস্কৃতি রাষ্ট্রের এই রূপান্তর বা বিকৃতির শর্ত হিসাবে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা যায় কিনা সেটাই ফ্যসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের কৌশল হওয়া উচিত। নীতির জায়গা হচ্ছে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তর ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ। প্রশ্ন উঠতে পারে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক দেশগুলোর এই রূপান্তর অনিবার্য কি না। এই েেত্র আমি মনে করি সেটা মোটেও অনিবার্য নয়। কখনোই অনিবার্য ছিল না। যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন করবার কর্তব্যকে বাংলাদেশের জনগণ বাস্তবায়িত করতে পারত। তার অর্থ কী? একাত্তরের দশই এপ্রিল তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণায় রাষ্ট্র গঠনের তিনটি আদর্শ গৃহীত হয়েছিল। এক. সাম্য; দুই. মানবিক মর্যাদা এবং তিন. সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ। এই তিনটি আদর্শের মধ্যেই নাগরিক ও মানবিক অধিকারের সারকথা নিহিত রয়েছে। এই তিনটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যই বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তাহলে প্রয়োজন ছিল এই তিনটি ঘোষিত আদর্শকে ভিত্তি ধরে ঐতিহাসিক ভাবে পরিগঠিত হয়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির জন্য একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র (Constitution) প্রণয়ন করা। কিন্তু জনগণের এই গণতান্ত্রিক আকাক্সা ও সঙ্কল্প বাঙালি জাতীয়তাবাদীমতাদর্শের মুখে বানচাল হয়ে যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের গোড়ায় রয়েছে এক দিকে বর্ণবাদ (racism) ও সাম্প্রদায়িকতা (racist communalism) আর অন্য দিকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল পাতিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্র। দুয়ে মিলে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের উর্বর ত্রে হয়ে উঠেছে। যারা মনে করেন এর বিপরীতে সঠিক রাজনীতি হচ্ছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। এর প্রধান কারণ এই জাতীয়তাবাদওতার নৃতাত্ত্বিক বা বর্ণবাদী অহমিকা থেকে মুক্ত নয়। শেখ মুজিবুর রহমান আদিবাসীদের বাঙালিহয়ে যেতে বলেছিলেন এবং ১৯৭২ সালে একটি বর্ণবাদী সংবিধান প্রণয়ণ করেছিলেন। বাঙালিছাড়া অন্য নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির প্রতি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গীও বর্ণবাদ মুক্ত নয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিজেকে ইসলাম অনুরাগী বলে মনে করে, কিন্তু ইসলামে বর্ণবাদ বা জাতীয়তাবাদের কোন স্থান নাই। সম্ভাবনা থাকলেও এই দিকগুলোকে সুস্পষ্ট করে একটি গতিশীল রাজনীতির সূচনা ঘটাবার েেত্র বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ব্যর্থ হয়েছে। ইসলামি মতাদর্শের প্রগতিশীল ভূমিকা নিশ্চিত করতে পারে নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে একটি পালটা প্রতিক্রিয়ামূলক রাজনৈতিক ধারার বেশী তার আর কোন বিকাশ ঘটেনি। এই রাজনীতির প্রশ্রয়ে বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতি হিসাবে যে ধারাগুলো গড়ে উঠেছে তারা ইসলামের ধর্মতত্ত্ব ও নিজ সম্প্রদায়ের ইমান-আকিদার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ কিম্বা জালিম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মজলুমের পে লড়বার যে ঐতিহাসিক নজির ইসলামের ইতিহাসে আছে তারা সেই ইতিহাসের সঙ্গে সম্বন্ধ রচনা করবার েেত্র অগ্রসর হয় নি। এমনকি উপমহাদেশের ইতিহাসের সঙ্গেও নয়। অথচ নানান কারণে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তার লণ এখন অতীতের চেয়েও অনেক বেশি স্পষ্ট। কিন্তু যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করেন, তারা প্রস্তুত নন। বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারার মধ্যে গভীর ঐক্যের জায়গাও আছে। উভয়েই তাদের পরিচয় নির্ণয় করে একাত্তরের যুদ্ধ থেকে এবং ইসলামকে নিছকই ধর্ম বিশ্বাস হিসাবে দেখে, উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস হিসাবে নয়। উভয়েই ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক জায়গা থেকে ব্যবহার করে। ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম অনেক জটিল হয়ে গিয়েছে। ইংরেজের বিরুদ্ধে এই দেশের জনগণের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম কিম্বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে প্রতিষ্ঠিত জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রামি ভূমিকার ঐতিহাসিক তাৎপর্য দুই জাতীয়তাবাদের কোনটিই স্বীকার করে না। ইসলাম আর ইংরেজ প্রবর্তিত জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কৃষকের সংগ্রাম এই ভূখণ্ডে একাকার হয়ে আছে। সে লড়াইয়ে যুক্ত রয়েছে সাঁওতাল, মুণ্ডা ও সমতলের অনেক জনগোষ্ঠি। বাংলাভাষী হিসাবে এই দেশের জনগণের ইতিহাস একই সঙ্গে ইসলাম ও কৃষিব্যবস্থার বিবর্তনের ইতিহাসও বটে। সেই দিক থেকে কৃষি প্রশ্ন বাদ দিয়ে এই দেশে ইসলাম প্রশ্ন বুঝবার বা জানবার কোন অবকাশ নাই। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দুই ধারার কাছে ইসলাম নিছকই ধর্ম মাত্র, এর কোন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ভূমিকা নাই। অন্য ধর্ম-সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠি ছাড়াও এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ একই সঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান । সংখ্যাগরিষ্ঠের এই ইতিহাস বাদ দিয়ে বাংলাদেশ গড়া সম্ভব কি না সন্দেহ। এই অবিভাজ্য পরিচয় যারা যে দিক থেকেই আলাদা করুক তার পরিণতি ভালো হতে পারে না। বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তুলনামূলক বিচার এখানে আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যে দিকটা আমরা এখানে জোর দিতে চাইছি সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থার ফ্যাসিবাদী রূপান্তর যদি বাংলাদেশের বাস্তবতা হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের মূল ভারকেন্দ্র খোদ এই রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে বাধ্য। নির্বাচন হবে কি হবে না সেটা গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গৌণ বিষয়। এটা সমাধান নয়। মূল প্রশ্ন হচ্ছে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ কী হবে? জনগণ কিভাবে তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করবে? গণতান্ত্রিক কর্মসূচি কি হতে পারে? একটি কর্তব্য তো পরিষ্কার সেটা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করা। অর্থাৎ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার কর্তব্যকে সামনে নিয়ে আসা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে তাদের কিভাবে স্থাপন করব সেই দিকগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা। এই গোড়ার কাজ ভুলে গিয়ে নির্বাচন করার অর্থ হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে মতার হাতবদল। এটাই কি আমরা চাই? এই জন্যই কি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল?


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads