শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৩

স্বাধীনতার ভাবনা, একটি সাক্ষাৎকার ও কিছু কথা


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য যৌবনে বছরের পর বছর নানাভাবে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তিনি কেন শেষ পর্যন্ত সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ালেন, এর দীর্ঘ পটভূমি সম্পর্কে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে ঠিক, কখন থেকে তার মনে আলাদা দেশ গঠনের আকাক্সা ও প্রচেষ্টা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছিল, সে বিষয়ে একেবারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। ওয়াকিবহাল ব্যক্তিদের অভিমত, ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পর মুজিবের এই বিশ্বাস দৃঢ় হতে থাকে যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্য মেনে আর একত্রে থাকা সম্ভব নয়। একপর্যায়ে তিনি সশস্ত্র আন্দোলন, এমনকি ভারতের সাহায্য কামনার কথাও ভাবতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে, ১৯৬২ সালের দিকে শেখ মুজিব গোপনে ত্রিপুরার আগরতলায় গিয়ে বরং আটক হয়েছিলেন বলেও কেউ কেউ দাবি করেছেন। ভারত তখনো তাকে বিশ্বাস করতে না পারাই নাকি এর কারণ। সেখানে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করে মুজিব ফিরে এসে প্রকাশ্য ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রাধান্য দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যান। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, প্রায় একই সময়ে (৬২ সালে) স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে একটি নিউকিয়াসগঠিত হয় এবং তখন থেকে পরিকল্পিতভাবে এর কাজ আগাতে থাকে। এ বিষয়ে একটি তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা যায়। তা জানিয়েছেন সম্প্রতি পরলোকগত, প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ড. এম জহির। মৃত্যুর পরপরই গত ১২ জুলাই ইত্তেফাকে তার স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনামÑ ‘যদি ফাগুন আসে গো ফিরে। ড. জহির সাবেক পূর্বপাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি এম আছিরের ছেলে। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল পুরনো ঢাকায়। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীর সাথে তার বাবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ড. জহির লিখেছেনÑ “সোহরাওয়ার্দীর কথা কিছুটা মনে আছে। ১৯৬১ সালের দিকে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের মেয়ের বিয়েতে এসে তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখন তিনি আব্বাকে বলেছিলেন, ‘আইয়ুব ডাজ নট রিয়েলাইজ, আনলেস দেয়ার ইজ ডেমোক্রেসি পাকিস্তান উইল ব্রেক। মুজিব অ্যান্ড আদার্স ওয়ার্ক টু ব্রেক পাকিস্তান। আই অ্যাম হোল্ডিং ইট। আই ক্যান নট। ইফ দেয়ার ইজ নো ডেমোক্রেসি, পাকিস্তান উইল ব্রেক।এত দূরদর্শী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, সোহরাওয়ার্দী তখনো জানতেনÑ তার দল আওয়ামী লীগে তার স্নেহধন্য শেখ মুজিবসহ অনেকে পাকিস্তান থেকে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। গণতন্ত্র না থাকলে যে দেশটা টিকবে না, তার এই ভবিষ্যদ্বাণী মাত্র এক দশকের মধ্যেই সত্যে পরিণত হয়েছিল। মুজিবতনয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার একটি সাক্ষাৎকার বিদেশের একটি বাংলা পত্রিকাসূত্রে ঢাকার একাধিক দৈনিক পত্রিকা এবার ছাপিয়েছে। এতে রেহানা বলেছেন, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তিনি ব্রাসেলসে বড় বোনের পরিবারের সাথে ছিলেন। তখন ভগ্নিপতি ড. ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল ছিল জার্মানি। সেখান থেকে তারা বেড়াতে যান বেলজিয়াম। ১৪ আগস্ট তারা ওঠেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (কবি) সানাউল হকের বাসায়। শেখ রেহানার ভাষায়Ñ ‘আমরা প্রেসিডেন্টের মেয়ে, খাতির যতেœর কী বাহার। পরদিন পৃথিবীতে আমাদের কেউ নেই। নিঃস্ব অসহায় আমরা দুবোন তখন সানাউল হক সাহেবের কাছে বোঝা হিসেবে পরিগণিত হলাম। আমাদের সরিয়ে দিতে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন।... পরে শুনেছি (জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত) হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকেও টেলিফোন করে সানাউল হক বলেছেন, এসব ঝামেলা (অর্থাৎ হাসিনা-রেহানা) আপনি আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন, তাড়াতাড়ি এই ঝামেলা সরান।সানাউল হক (১৯২৪-৯৩) বঙ্গবন্ধু পরিষদের অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন পরবর্তী জীবনে। ১৯৪৫ সালে মাস্টার্স করে কিছু দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন অর্থনীতি বিভাগে। এরপর সিএসপি হয়ে ক্রমান্বয়ে সচিব পদে প্রমোশন পেয়েছিলেন। অবসর নিয়ে আইন ব্যবসায় শুরু করেন সুপ্রিম কোর্টে। ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার অর্জন করেন। একই বছর পাকিস্তানের আইয়ুব খান সরকার তাকে সিতারা-ই-কায়েদে আজম খেতাবে ভূষিত করেছিল। বাংলা একাডেমীর চরিতাভিধানগ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। বর্তমান মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত এই সঙ্কলন গ্রন্থে আলোচ্য সানাউল হক সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ ও মুক্তবুদ্ধির ধ্যানধারণা বিকাশের ক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখযোগ্য।উল্লিখিত সাক্ষাৎকারে শেখ রেহানা জানানÑ পরিবারের কেউ যে বেঁচে নেই, তা জানতে পারেন তিন-চার মাস পরে। রেহানা বলেছেন, ১৫ আগস্টের অল্প পরেই মুজিব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন জার্মানি যান। রেহানা কামাল চাচাকে অনুরোধ করেন, সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকার ঘটনা তুলে ধরতে। কামাল অনুরোধ রাখেননি। ২৪ কী ২৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও রেহানা ভারতে চলে আসেন। হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকায় ফেরা পর্যন্ত দিল্লিতেই ছিলেন। খন্দকার মোশতাক সম্পর্কে রেহানা একটি নতুন কথা বলেছেন। তা হলো, শুনেছি ১৫ আগস্টের আগের রাতে ১২টা পর্যন্ত মোশতাক ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেই ছিলেন। শেখ রেহানার বিশ্বাস, ‘তাদের পরিকল্পিত অভিযান সম্পর্কে কেউ কিছু আঁচ করতে পারছে কি না, তা অবজার্ভ করতে তিনি ওইখানে ছিলেন।রেহানা আরো বলেন, ‘আমার দাদীর মৃত্যুর পর মোশতাকের সেই অস্বাভাবিক কান্না এখনো আমার চোখে ভাসে।... একমাত্র তিনিই তখন মাটিতে গড়াগড়ি করে কান্নাকাটি করেছেন।ভারত সরকারের বিশেষ আতিথ্যে থাকার সময় শেখ রেহানা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে পড়ালেখা করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। এরপর তার ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয়া হয় দিল্লি নেহরু ভার্সিটি, সিমলায় ও পশ্চিমবঙ্গের শান্তি নিকেতনে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানায়, তারা নিরাপত্তা দিতে পারবে না। ফলে রেহানা লন্ডনে আত্মীয়ের কাছে চলে যান। সেখানে মুজিব হত্যার বিচার দাবি করার প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কতজন যে কত বিদ্রƒপ করল।১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির রাজনৈতিক খলনায়ক হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদকে অভিযুক্ত করে থাকে আওয়ামী লীগ। তার সাথে দলের প্রধান নেতা মুজিবের সম্পর্ক কেমন ছিল? তা এক বিচিত্র ও কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ থেকে একটি গ্রুপ বেরিয়ে গিয়ে বছর দুয়েক আলাদা ছিল। এতে ছিলেন খন্দকার মোশতাক, সালাম খান, হাশিমুদ্দিন প্রমুখ। অপর দিকে, তখন মূল দলের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ষাটের দশকের শেষ দিকে মুজিবের নেতৃত্বে আওয়াম লীগ দৃশ্যত দেশীয় সমাজতন্ত্রর দিকে ঝুঁকে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সুবাদে সত্তরের দশকে দলটি কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। তখনো মোশতাক পরিচিত ছিলেন মার্কিনঘেঁষা বা দক্ষিণপন্থী হিসেবে। মুজিবনগরে তাজউদ্দীন বনাম মোশতাক দ্বন্দ্ব সর্বজনবিদিত। যা হোক, মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর এই দুনেতাই তার ঘনিষ্ঠতা ও আস্থা অর্জনে প্রয়াসী ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই। আওয়ামী মহলের অনেকে বলে থকেন, মোশতাক তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে কান ভারীকরেছিলেন নেতার। তবে শেখ মুজিব তাজউদ্দীন ও মোশতাক উভয়কেই তখনকার জাতীয় প্রয়োজনে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশকে তখন ইন্দো-সোভিয়েত অক্ষের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে। এ দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তাজউদ্দীন। অপর দিকে শেখ মুজিব প্রয়োজন বোধ করছিলেন ক্রমান্বয়ে পাশ্চাত্যের ঘনিষ্ঠ হওয়া, এমনকি চীনের সাথে যোগাযোগের। তাই মোশতাককে দূরে সরানো সম্ভব ছিল না। স্মর্তব্য, ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বামপন্থীরা মুজিবকে মার্কিনপন্থী বলে সমালোচনা করতেন। এ দিকে চীনপন্থীরা মুজিবের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ হলেও চীনের প্রতি তার দুর্বলতা ও সশ্রদ্ধ মনোভাব অনেক পুরনো। ১৯৫৩ সালের বেইজিং শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে তার যে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, এর বয়ান দিয়েছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। যা হোক, মোশতাক যখন মুজিব সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী, তখন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আগ্রহেই গোপনে চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। শেখ মুজিবের আত্মজীবনীতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলির উল্লেখ রয়েছে। বইটিতে বহুলালোচিত খন্দকার মোশতাক প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। প্রথমেই ৩২ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু মুজিব তার উল্লেখ করেছেন শহীদ নজীর আহমদের পর ঢাকার অন্যতম ছাত্রনেতা হিসেবে। ৪৬ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিব জানিয়েছেন, ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যু সামনে রেখে যে ঐতিহাসিক নির্বাচন হয়েছিল, তখন দলের নির্বাচনী অফিস ও কর্মীশিবির খোলার জন্য বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার দায়িত্বে ছিলেন মুজিব নিজে; তেমনি বৃহত্তর কুমিল্লার ভার দেয়া হয় মোশতাককে। স্মৃতিচারণে শেখ মুজিব জানিয়েছেন, ১৯৪৭ সালের মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে তরুণ নেতা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি এবং অন্যদের মধ্যে জহিরুদ্দিন, (টাঙ্গাইলের) শামসুল হক, খন্দকার মোশতাক, কিউ জে আজমিরী প্রমুখ। এই কনভেনশনেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে লাহোর প্রস্তাবের সংশোধনী উত্থাপন করিয়েছিলেন। ফলে মুসলিম অধ্যুষিত একাধিক রাষ্ট্রের বদলে একটিমাত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে বলে স্থির হয়। শেখ মুজিবের ভাষ্যমতে, আবুল হাশিম আর সামান্য কয়েকজনছাড়া কেউ এই মৌলিক পরিবর্তনের প্রতিবাদ জানাননি। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী (মুসলিম) লীগ প্রতিষ্ঠাকালে মুজিব ও মোশতাক উভয়েই জয়েন্ট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। হয়তো বয়সে সিনিয়র হওয়ার কারণে প্রথমে মোশতাকের নাম এসেছিল। মুজিব তখন কারাগারে। এটা অনস্বীকার্য যে, সংগঠক হিসেবে শেখ মুজিব খন্দকার মোশতাকের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ ছিলেন। অবশ্য আওয়ামী রাজনীতির একজন নেতা হিসেবে মোশতাকও কয়েকবার জেল খেটেছিলেন। মুজিব আত্মজীবনীতে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনায় তার দলের নেতা ও সহকর্মীদের নাম উল্লেখ করতে কার্পণ্য করেননি। তাদের অনেকের অবদানের সাথে দোষত্রুটিও তুলে ধরেছেন। ভাষা আন্দোলনে মোশতাকসহ নেতারা গ্রেফতার হওয়া এবং বৃহত্তর কুমিল্লায় মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ার কথাও জানা যায় এই বই থেকে। আবার এটাও মুজিব জানিয়েছেন যে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি নিজে ছিলেন আওয়ামী লীগের এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রবক্তা। অপর দিকে, মোশতাকসহ দলের অনেকেই শেরে বাংলার দলসহ যুক্তফ্রন্ট করার পক্ষে ছিলেন। আলোচিত আত্মজীবনীর একটি উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতি হলো, ‘খন্দকার মোশতাক আহমদের মতো জেলখাটা কর্মীকেও নমিনেশন দেওয়া হয় নাই’ (পৃষ্ঠা ২৫৩)। সেখানে মুজিব দুঃখের সাথে উল্লেখ করেন, ‘যুক্তফ্রন্টের খেসারত হিসেবে ৫৪-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে অনেক প্রার্থীÑ যারা জেল খেটেছে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তাদের নমিনেশন দেওয়া যায় নাই।এ প্রসঙ্গে তিনি এম এ আজিজ (চট্টগ্রাম), খন্দকার মোশতাক (কুমিল্লা), আবদুল জব্বার খদ্দর (নোয়াখালী)Ñ এই তিনজনের নাম বলেছেন। খন্দকার মোশতাক ৬৯-৭০ সালে ছিলেন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তার মাথায় বিশেষ ধরনের টুপি তাকে দলের নেতাদের মধ্যে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য দিয়েছিল। আমার মনে আছে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় ইসলামপন্থীরাসহ আওয়ামী লীগ বিরোধী অনেকে মোশতাকের টুপিকে গান্ধী টুপির নতুন সংস্করণ বলে ব্যঙ্গ করতেন। পরে জানা যায়, মোশতাক একজন পীরজাদা। স্বাধীনতা পর মন্ত্রী থাকাকালে ফারাক্কা ও রক্ষীবাহিনীসহ কোনো কোনো ইস্যুতে মোশতাকের অসন্তোষের কথা কারো কারো লেখায় এসেছে। তবে লক্ষণীয়, ’৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের যে কজন শীর্ষ নেতাকে যেকোনোভাবে বিজয়ীকরতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, মোশতাক সেই ভাগ্যবানদের একজন। শেখ রেহানা এবারে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে মোশতাক পরিবারের সাথে মুজিব পরিবারের অতীত ঘনিষ্ঠতা তুলে ধরেছেন। রেহানার ভাষায়Ñ ‘স্বাধীনতার আগে এই মোশতাক যখন জেলে, তখন তার অসুস্থ স্ত্রীর সব দায়দায়িত্ব নিয়েছিলেন আমার মা। তাকে সুস্থ করে তুলতে মা বিরামহীন চেষ্টা করেছেন।শেখ রেহানা এক আত্মীয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, মোশতাককে বঙ্গবন্ধু ঠিকই চিনতেন। অনেক আগে একটি লেখায় পড়েছিলাম, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার সময় মোশতাক চিকিৎসাধীন ছিলেন ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে। দুই-তিন দিন পর কোনো মতে বেরিয়ে ভারতে চলে যান এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। আওয়ামী লীগের মতো একটি বিশাল সংগঠন ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রতিবাদ করেনি সে সময়। দেশের কোথাও একটি মিছিল বা সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেখা যায়নি তাদের। দলটি অভাবনীয় এ ঘটনায় দিশেহারা ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। এর মূলে ছিল নৈতিক দুর্বলতা। ফলে হাজার হাজার নেতাকর্মীর সংগঠনটি সাহস ও মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল। ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে এক দিকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও ক্ষমতার অপব্যবহার দলটির নৈতিক শক্তি শেষ করে দিয়েছিল। অপর দিকে, বিশেষ করে অগণতান্ত্রিক একদলীয় ব্যবস্থায় হয়ে পড়েছিল জনবিচ্ছিন্ন। আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। কারণ একদলীয় শাসন এবং প্রায় সংবাদপত্রবিহীন দেশের সাথে তাদের পরিচয় ছিল না। বাকশালব্যবস্থার পরিণতি কী, বঙ্গবন্ধু কী পদক্ষেপ নেবেন ভবিষ্যতে এবং আবার কখন ফিরবে পরিচিত বহুদলীয় সংসদীয় সিস্টেমÑ এসব কিছু দেশবাসীর মতো আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছেও স্পষ্ট ছিল না। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সম্প্রতি এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা ও রীতিনীতি এবং আত্মসমালোচনা বলে কিছুই বিকশিত হয়নি। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতি অতি দ্রুত ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ল।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads