রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৩

দলবাজির রাজনীতি পরিহার করতে হবে


 আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক ধারণা লাভ করেছি বিলাতের কাছ থেকে। কিন্তু বিলাতের ইতিহাস আর আমাদের ইতিহাসের পার্থক্য বিস্তর। বিলাতের গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা গড়ে উঠেছে সে দেশের ভেতর থেকে; কিন্তু গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা একইভাবে আমাদের ভেতর থেকে গড়ে ওঠেনি। আমরা এটা লাভ করেছি বিলাতের কাছ থেকে, বিলাতের শাসনামলে। যা বাংলাদেশে চলেছিল ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। প্রায় ১৯০ বছর ধরে। যেটা ইতিহাসের তালমাত্রায় খুব বেশি বলে ধার্য করা চলে না। বিলাতে গণতন্ত্রের আরম্ভকাল ধরা চলে ম্যাগনা কার্টা (Magna Carta; 1215) থেকে। ব্রিটেনে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র পূর্ণরূপ লাভ করেছে ১৯১১ সালে পার্লামেন্ট অ্যাক্টের মাধ্যমে। হঠাৎ করেই বিলাতে আমরা আজ যেমন গণতন্ত্র দেখছি, তার প্রতিষ্ঠা হয়নি। হয়েছে ধাপে ধাপে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন এ দেশে ব্যবসায় করতে আসে (১৬০০), তখন ব্রিটেনে গণতন্ত্র ছিল যথেষ্ট সীমিত। হাউজ অব লর্ডসের হাতে যত ক্ষমতা ছিল, হাউজ অব কমন্সের হাতে তা ছিল না। বিলাতে ক্রমেই হাউজ অব লর্ডসের ক্ষমতা কমেছে, আর বেড়েছে হাউজ অব কমন্সের ক্ষমতা। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ক্ষমতা; যারা হলো সংখ্যায় বেশি। বিলাতে এক সময় রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল প্রধানত দুই শ্রেণীর মানুষের হাতে। একটি শ্রেণীকে বলা যায় অভিজাত (Nobility)অভিজাতেরা ছিলেন ভূসম্পত্তির মালিক। আর নেতৃত্ব দিতেন যুদ্ধে। তাদের প্রভাব ছিল রাজা বা রানীর ওপরে সবচেয়ে বেশি। প্রভাবের দিক থেকে এদের পরে ছিলেন জাজক শ্রেণী (Clergy)যাদের ক্ষমতার উৎস ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস। এদের অধীনে পরিচালিত হতো গির্জা। বিলাতের মানুষের ওপর ধর্মের প্রভাব ছিল অপরিসীম। সমাজ জীবন চলত জাজকদের নির্দেশে। অভিজাত আর জাজকদের বাদ দিলে যারা থাকত, তাদের বলা হতো জনসাধারণ (Masses))বিলাতে জনগণের প্রভাব বেড়েছে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে। ইউরোপের বিলাতেই প্রথম গড়ে ওঠে রাজনৈতিক দল; কিন্তু বিলাতে রাজনৈতিক দল এখনো আইনত স্বীকৃত নয়। যদিও রাজনৈতিক দল আছে, আর তারা নেয় নির্বাচনে অংশ। বিলাতে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, তারা গড়ে সরকার। তাদের থেকে হন প্রধানমন্ত্রী। বিলাতে সরকার হলো রাজা অথবা রানী; ঠিক কোনো দলের নয়। অন্য দিকে বিলাতের বিরোধী দলকে বলা হয় রাজা অথবা রানীর অনুগত বিরোধী দল। যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা রাজা বা রানীকে পারমর্শ দেয় দেশ চালানোর। যদিও রাজা বা রানীকে চলতে হয় প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে। কিন্তু রাজা বা রানী হলেন এখনো ব্রিটেনে সরকারপ্রধান। অন্য দিকে বিরোধী দল বলে, তারা রাজা বা রানীর বিরোধিতা করছেন না, তারা বিরোধিতা করছেন, প্রধানমন্ত্রীর রাজাকে বা রানীকে দেয়া প্রদত্ত পরামর্শের। বিলাতের রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে Extra Legal বা আইনের বাধ্যবাধকতা মুক্তভাবে। বিলাতে কোনো রাজনৈতিক দল গড়তে হলে তার কোনো সরকারি নিবন্ধনের প্রয়োজন পড়ে না। বিলাতে রাজনৈতিক দল ছাড়াও অনেক ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আর তাদের মধ্য থেকে অনেকে নির্বাচিত হন। বিলাতের পার্লামেন্টে স্পিকার অর্থাৎ পার্লামেন্টের সভাপতি নির্বাচন করা হয় পার্লামেন্টের নির্দলীয় সদস্যদের মধ্যে থেকে। কারণ মনে করা হয়, নির্দলীয় ব্যক্তি সভাপতি হলে তিনি কোনো বিশেষ দলের ওপর পক্ষপাতিত্ব করবেন না। পার্লামেন্ট সব সদস্যকেই দেবে যথাযথভাবে কথা বলার সুযোগ। কিন্তু আমাদের দেশে এ রকম কোনো প্রথা নেই। বিশেষ (সংখ্যাগুরু) দল থেকেই হচ্ছেন পার্লামেন্টের সভাপতি নির্বাচিত। এতে থাকছে পক্ষপাতের সুযোগ। রাষ্ট্রের বিভাগ হলো তিনটি। যথা : শাসন বিভাগ (Executive), আইন পরিষদ (Legislature)) ও বিচার বিভাগ (Judiciary)গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য থাকতে হয় এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতার ভারসাম্য। ক্ষমতার এই ভারসম্য না থাকলে গণতন্ত্র অকার্যকর হতে চায়। আমাদের দেশে বর্তমানে বিচার বিভাগকে দিয়ে এমন সব বিষয়ে বিচার করানো হচ্ছে যেটা অন্য গণতান্ত্রিক দেশে করানো হয় না। এতে সৃষ্টি হতে পারছে দেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট। অনেকে বলেন, বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। ইসলাম গণতন্ত্রের অনুকূল ধর্ম নয়। কিন্তু এই যুক্তি মেনে নেয়া যায় না। গণতন্ত্র বলতে যদি বোঝায় আলোচনার মাধ্যমে পরিচালিত সরকার, তবে ধর্ম হিসেবে ইসলামকে বলা চলে না গণতন্ত্রের পরিপন্থী। কারণ কুরআন শরিফে বলা হয়েছে- সমস্ত গুরুতর ব্যাপারে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে (সূরা ৪২ : ৩৮)। আমাদের লাগোয়া রাষ্ট্র মিয়ানমারে সামরিক শাসন চলেছে ১৯৫৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত। মিয়ানমার একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ নয়। সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকায় গণতন্ত্র এখনো যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারেনি; কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো হলো খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। তাই গণতন্ত্র যে কেবল ধর্মবিশ্বাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এ রকম সিদ্ধান্তে আসা যায় না। গণতন্ত্র বিশেষভাবে সাফল্য লাভ করতে পেরেছে ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলে। যাদের গণতন্ত্র চেতনার উৎস হলো গ্রেট ব্রিটেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন থেকে স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু সে ইংরেজি ভাষা ও ব্রিটিশ রাজনীতির ঐতিহ্যকে অস্বীকার করতে চায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলেছে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির গণতন্ত্র। কিন্তু তার মূল অনুপ্রেরণা এসেছে গ্রেট ব্রিটেন থেকেই। ইরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলে গণতন্ত্রের সাফল্যের মূলে কাজ করেছে উদার গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা; ব্যক্তি স্বাধীনতার বাণী। এসব অঞ্চলে রাজনৈতিক দল থাকলেও দলবাজি নেই। যেমন নেই গ্রেট ব্রিটেনে। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন হয় আপসরফা আর খাপ খাইয়ে চলার মনোভাব। যেটা ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলে যথেষ্টভাবেই আছে। প্রশ্ন ওঠে ভারতে গণতন্ত্রের সাফল্য পেতে পারল; কিন্তু সাবেক পাকিস্তানে তা ব্যর্থ হলো কেন? তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ হলো, হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসনামলে যেভাবে ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের চর্চা করেছেন এই উপমহাদেশের মুসলমানেরা তা করেননি। ভাবের বাহন ভাষা। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে হিন্দুরা যে পরিমাণে গণতান্ত্রিক ভাবধারা লাভ করতে পেরেছেন, এই উপমহাদেশের মুসলমানেরা তা পারেননি। যে অঞ্চল নিয়ে সাবেক পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল তা ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় আর এক কথায় ইংরেজি শিক্ষায় যথেষ্ট অনগ্রসর। প্রশ্ন ওঠে, এই উপমহাদেশের মুসলমানেরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাইলেন না কেন? এর একটা কারণ হলো, হিন্দুদের সাথে খ্রিষ্টান বিশ্বের কোনো সঙ্ঘাত ঘটেনি; কিন্তু ইউরোপীয় খ্রিষ্টান বিশ্বের সাথে মুসলিম বিশ্বের ঘটেছে সঙ্ঘাত। যাকে ইতিহাসে ইংরেজিতে বলে ক্রুসেড (Crusade)যা ঘটেছিল জেরুসালেমে সালজুক তুর্কি মুসলমান কর্তৃক জেরুসালেম দখলের ফলে। সালজুকেরা জেরুসালেমে ইউরোপ থেকে তীর্থ করতে আসতে বাধার সৃষ্টি করেন। ফলে শুরু হয় খ্রিষ্টান ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ, যাকে খ্রিষ্টানরা বলেন ধর্মযুদ্ধ। যা আরম্ভ হয় ১০৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। আর শেষ হয় ১২৭২ খ্রিষ্টাব্দে এসে। দীর্ঘ দিন ধরে চলেছিল ক্রুসেড। আর অনেক ক্রুসেড ঘটতে পেরেছিল। প্রথম দিকের কয়েকটি ক্রুসেডের নেতৃত্ব নিয়েছিলেন ফরাসি দেশের সেনাপতিরা। এসব ক্রুসেডে ফরাসি সৈন্য ছিল বেশি। এ সময় ফরাসিদের বলা হতো ফ্রাঙ্ক। ক্রুসেডাররা মুসলমানদের কাছে পরিচিতি পান ফ্রাঙ্কি বা ফিরিঙ্গি হিসেবে। মুসলমানদের কাছে ফিরিঙ্গি সভ্যতাকে উন্নত বলে মনে হয়নি। ইংরেজরা এ দেশে মুসলমানদের কাছে বিবেচিত হয়েছেন ফিরিঙ্গি হিসেবে। মুসলমানেরা তাই ফিরিঙ্গি শিক্ষা গ্রহণে বিরত থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু ইংরেজরা এ সময় সভ্যতায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। ইংরেজরা এ দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসার আগেই তাদের মধ্যে জন্মেছেন শেক্সপিয়রের মতো নাট্যকার। ফ্রান্সিস বেকেনের মতো দার্শনিক এবং নিউটনের মতো বৈজ্ঞানিক। ইংরেজ কেবলই দোকানদারের জাতি ছিলেন না। তারা আমাদের তুলনায় জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে ছিলেন না। আমরা তাদের কাছ থেকে শিক্ষা না নিয়ে বেশ কিছুটা ভুলই করেছিলাম। আমরা তাই যথেষ্ট গণতন্ত্রমনা হতে পারিনি। হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ঘটতে পেরেছিল গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ। ভারতে গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি বড় কারণ এটাই। ভারতে দলবাজি আছে। দলবাজি তাদেরও গণতন্ত্রের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখনো সেটা হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ দলবাজির একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বিরোধী দলকে সে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জড়াচ্ছে নানা মামলা মোকদ্দমায়। সে এমনভাবে নির্বাচন করতে চাচ্ছে যে, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ না হওয়াই সম্ভব। গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর। সেটা যদি না হতে পারে, তবে গণতন্ত্র বাংলাদেশে আপাতত অকার্যকর হয়ে উঠতেই পারে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads