বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৩

রাজনীতি কী এবং কেন


রাজনীতি বলতে আমরা যা বুঝে থাকি তা হলো, সরকার কোন নীতিতে পরিচালিত হলে জনগণের কাছে সর্বাধিক কল্যাণ পৌঁছানো যাবে, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনগণকে সে নীতিতে সম্পৃক্ত করে দেশ পরিচালনা। রাজনীতিকথাটির মধ্যে দুটি শব্দ আছে। রাজনীতিমিলে রাজনীতিরাজবলতে বড় বা শ্রেষ্ঠ বিষয়কে বোঝানো হয়ে থাকে। নীতির মধ্যে যে নীতি শ্রেষ্ঠ, তা-ই রাজনীতি। সুতরাং দেশ পরিচালনার েেত্র যে নীতি বা আদর্শ শ্রেষ্ঠ, তাকেই রাজনীতি বলা উচিত। অন্য কোনো নীতিকে রাজনীতি বলা যায় না। রাজনীতি হতে হলে নীতির মানদণ্ডে তা অবশ্যই শ্রেষ্ঠ হতে হবে। যদি রাজার নীতিকে রাজনীতি বলা হয়ে থাকে, তবে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বিবেচনা করেই রাজা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু, অনৈসলামিক ব্যবস্থায় বাস্তবে রাজা সর্বাবস্থায় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি না-ও হতে পারেন। রাষ্ট্রের সর্বময় মতার অধিকারী ব্যক্তিকেই রাজা বলা হয়ে থাকে। অনৈসলামিক ব্যবস্থায় রাজনীতি শ্রেষ্ঠ নীতি নাও হতে পারে। কারণ ইসলামি ব্যবস্থায় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকেই বিপুল মতার অধিকারী হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। সুতরাং ইসলামি ব্যবস্থায়ই রাজার নীতিকে রাজনীতি বলা যেতে পারে। অন্য ব্যবস্থায় তা মানানসই হবে না। কারণ যেকোনো নীতিকে শ্রেষ্ঠ নীতি হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে না। শ্রেষ্ঠ নীতি নির্ধারণের জন্য প্রয়োজন সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান এবং তার আদেশ ও নিষেধ জানা ও মানা। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে যাদের জ্ঞান নেই এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ যাদের জানা নেই, তারা প্রকৃত জ্ঞানী হতে পারেন না। এরকম লোকের নীতি বা বিবেচনা শ্রেষ্ঠ নীতি নির্ধারণে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জনগণের কল্যাণে দেশ পরিচালনায় শ্রেষ্ঠ নীতিরই প্রয়োগ জনগণের কাম্য হয়ে থাকে। শ্রেষ্ঠ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের যে উপকার করা যাবে অন্য কোনো নীতির মাধ্যমে তা কিছুতেই পারা যাবে না। দুর্নীতিকে রাজনীতি বলা সঙ্গত হবে না। সুনীতি বা শ্রেষ্ঠনীতির দ্বারা দেশ পরিচালিত হলেই জনগণ সবচেয়ে বেশি উপকার পাবে এবং সে নীতিকেই রাজনীতি বলা যায়। সৃষ্টিকর্তা বলে দিয়েছেন, মানুষকে সামান্যই জ্ঞান দান করা হয়েছে, সে েেত্র মানুষ তার এ অপর্যাপ্ত জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে যে পরিকল্পনা বা নীতিই নির্ধারণ করবে, তা পুরো সফল হবে না। ঐশীজ্ঞানকে উপো করে শুধু বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করাতে যুগে যুগে মানুষ ব্যর্থ হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, তারা যদি তোমার আহবানে সাড়া না দেয়, তা হলে জানবে, ওরা তো কেবল নিজেদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করে। আল্লাহ্র পথনির্দেশ অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়ালখুশির অনুসরণ করে, তার অপো অধিক বিভ্রান্ত আর কে?’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত ৫০) মানুষের ত্রুটিপূর্ণ বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেই ফেরাউন, নমরুদ, হামান ব্যর্থ হয়েছে। অপর দিকে ঐশীজ্ঞানে জ্ঞানী নবী, রাসূল, সাহাবি, ওলিরা ইহকাল ও পরকাল উভয় জাহানেই কামিয়াবি অর্জন করেছেন। যিনি তৈরি করেন, তিনিই তার তৈরি করা বস্তুর ব্যবহারের বিধানদানের জ্ঞান রাখেন। যে ব্যক্তি বা কোম্পানি যন্ত্র আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করেন, সে ব্যক্তি বা কোম্পানিকেই বলে দিতে হয় ওই যন্ত্রের উদ্দেশ্য এবং এর ব্যবহারপ্রণালী। সে কারণে প্রত্যেক যন্ত্রের সাথে কোম্পানি থেকে এর ব্যবহারপ্রণালী দেয়া হয়। অনেক সময় ইঞ্জিনিয়ার পাঠিয়েও শিখিয়ে দেয়া হয় যন্ত্রের ব্যবহারপ্রণালী। ইচ্ছামতো ব্যবহারে দ্রুত যন্ত্রের তি হতে পারে এবং ভুল ব্যবহার একে সম্পূর্ণ অকেজো করে দিতে পারে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বজগতের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। মানুষকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষের সৃষ্টির সম্পূর্ণ রহস্য ও উদ্দেশ্য অবগত। সুতরাং একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই মানুষের জীবন পরিচালনার নীতি প্রদানের অধিকারী। সে কারণে আল্লাহ্ তায়ালা মানুষ পরিচালিত হওয়ার নীতিসংবলিত কুরআন মজিদনাজিল করেছেন এবং কেয়ামতের পূর্বপর্যন্ত আগমনকারী মানুষ নিজ, সমাজ ও দেশকে কিভাবে পরিচালনা করবে তা দেখিয়ে দিয়েছেন হজরত মুহাম্মদ সা:-কে পাঠিয়ে। বিদায় হজে হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘যত দিন কুরআন ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে ধরে রাখবে, তত দিন পর্যন্ত বিপথগামী হবে না।অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার নীতিকে এড়িয়ে নিজের মনগড়া নীতির মাধ্যমে নিজকে, সমাজকে ও দেশকে পরিচালনা করা হলে তাতে ধ্বংস অনিবার্য। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত নীতি দেশ পরিচালনার জন্য শ্রেষ্ঠ নীতি। এ নীতি সব নীতির রাজা। সুতরাং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ প্রদত্ত নীতিকেই রাজনীতিবলা উচিত। এ নীতি উভয়কালে মানুষের উপকারে আসবে। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত ইসলামি নীতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, যা মানব রচিত নীতিতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। প্রথমত, ইসলামি নীতি সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত। অপর দিকে মানুষের তৈরি নীতি তা নয়। সৃষ্টিকর্তা যা জানেন, মানুষ তা জানে না। সুতরাং মানব রচিত নীতিতে ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, এটি পূর্ণাঙ্গ নীতি, যা মানুষের নৈতিক, শারীরিক, আধ্যাত্মিক, বৈষয়িক ও ইহ-পরকালের সাথে সম্পর্কযুক্ত। মানব রচিত নীতি সর্বদিকের সাথে সম্পর্কযুক্ত পূর্ণাঙ্গ কোনো নীতি নয়। তৃতীয়ত, ইসলামি নীতির বুনিয়াদ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সার্বভৌমত্বের ওপর। মানব রচিত নীতিতে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সার্বভৌমত্বের কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না। চতুর্থত, ইসলামি নীতি শাশ্বত; সব যুগ, স্থান ও ব্যক্তির উপযোগী। মানব রচিত নীতির মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। পঞ্চমত, ইসলামি নীতি অমান্য করার শাস্তি কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না। কারণ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আওতার বাইরে কেউ যেতে পারবে না। কুরআনে এভাবে বলা হয়েছে, ‘হে জিন ও মানবকুল, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের প্রান্ত অতিক্রম করা যদি তোমাদের সাধ্যে কুলায়, তবে অতিক্রম করো। কিন্তু ছাড়পত্র ব্যতীত তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না।’ (সূরা আর-রাহমান, আয়াত ৩৩) অথচ, মানব রচিত নীতির শাস্তি মানুষ বিভিন্ন পন্থায় এবং দেশ ত্যাগ করে এড়িয়ে যেতে পারে। ষষ্ঠত, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইহকাল ও পরকালের মালিক। কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আর নিশ্চয়ই ইহকাল ও পরকাল অবশ্যই আমার শাসনাধীন।’ (সূরা আল লাইল, আয়াত ১৩) সুতরাং আল্লাহ্র নীতির অবাধ্যতার শাস্তি উভয় জগতে হয়ে থাকে। কিন্তু মানব রচিত নীতি অমান্য করলে শুধু ইহকালেই শাস্তির ভয় থাকে। ইসলামি নীতির সাথে বেহেশত-দোজখ ও দুনিয়ার সুখ-শান্তি এবং মানব রচিত নীতির সাথে শুধু দুনিয়ার জেল-জরিমানার সম্পর্ক থাকে। সপ্তমত, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শাস্তি মানবের শাস্তির চেয়ে অনেক কঠিন। শাস্তির বিষয়ে কুরআন শরিফে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন, ‘কেননা, তাঁর সে দিনের মতো শাস্তি কেউই দিতে পারে না।’ (সূরা ফজর, আয়াত ২৫) অতএব, তুমি তাদের এক কঠিন শাস্তির সংবাদ দিয়ে দাও।’ (সূরা ইনশিকাক, আয়াত ২৪) আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন যে শাস্তি দেবেন, তা কত যে কঠিন হবে, সেটা মানবের কল্পনায়ও ধরবে না। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে ঈমানদারদের কাছে মানব রচিত নীতির তুলনায় ইসলামের নীতির গুরুত্ব অপরিসীম। ণস্থায়ী দুনিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত নীতি অনন্তকালীন ইসলামি নীতির সাথে তুলনায় ঈমানদারদের কাছে মূল্যহীন বলা যায়। এ অবস্থায় ইসলামি নীতি অনুসরণে সমাজ ও দেশ গঠন করার চেষ্টায় মুসলমানেরা সর্বদা সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে থাকেন। দমননীতির মাধ্যমে এর অবসানের চেষ্টা করার পরিণাম কখনো ভালো হয় না। ইসলামের দৃষ্টিতে রাজনীতি হলো, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতিনিধিত্ব তথা তাঁর নীতির প্রতিনিধিত্ব। ইসলামে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন ঐশী জ্ঞানে জ্ঞানী জনগণ কর্তৃক। তিনি দেশ পরিচালনা করেন আল্লাহর নির্ধারিত নীতি দ্বারা পৃথিবীর সব মানুষ ও জীবের মঙ্গলের জন্য এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার রার উদ্দেশ্যে। আসলে পৃথিবীর সব মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। মানুষ ও জীবের সার্বিক মঙ্গলার্থে কাজ করে যাওয়া সবার কর্তব্য। মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনায় তার কর্মকাণ্ডের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দায়ী। ইসলামী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান মতা লাভ করেন আল্লাহর নির্ধারিত নীতি থেকে। শুধু রাষ্ট্রপ্রধান নন, সব মানুষের মতার উৎস একমাত্র আল্লাহ।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads