সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০১৩

খুন নাশকতা ও পুলিশ


খুনের উৎসবে যুবলীগ নেতা মিল্কির হত্যা একটি নতুন মাত্রা যোগ করল। কারণ এত দিন আমরা শুধু ফিল্মি কায়দায় হত্যার বর্ণনা পেয়ে এসেছি। সিনেমার বাইরে এবার প্রথম ফিল্মি খুনের প্রথম লাইভ দৃশ্য দেখা গেল। ফিল্মি কায়দায় খুন মানে কীÑ এ হত্যাকাণ্ড আমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল। খুনির নির্মমতা ও অভিনব চর্চা সিনেমার কাইমেক্সকে ছাড়িয়ে গেল। এক হাতে কানে মোবাইল রেখে কথা বলতে বলতে তিনি নিজের প্রাণের বন্ধুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন। এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দিকটিও ছিল লক্ষণীয়। নেপাল, দুুবাই ও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বসে খুনিরা অপারেশনের নীলনকশা তৈরি করেছে। ঘটনার ঠিক তিন দিন আগে কিলিং স্পটের পাশে বসেই মিশন বাস্তবায়ন নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করে খুনিচক্র। ছয় ঘণ্টা ধরে চলা বৈঠকে অপারেশনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। মিল্কি ও তারেক উভয়েই একই সংগঠনের একই ইউনিটের নেতা। দীর্ঘ দিনের দহরম-মহরম ও একসাথে ওঠাবসা তাদের। পদের লোভ অর্থের ভাগবাটোয়ারার কাছে নিজেদের বন্ধুত্বকে অর্থহীন প্রমাণ করলেন তারা। মতিঝিল হচ্ছে বাংলাদেশের ওয়ালস্ট্রিট। এখানে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ওড়ে। ব্যাংক-বীমাসহ বাংলাদেশের বেসরকারি প্রায় সব উদ্যোগের সদর দফতর এটি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজকারবারের আকারও প্রকাণ্ড। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি তাই এখানে রমরমা। মিল্কি ও তারেক দুজনই শূন্য থেকে প্রভূত বিত্তের মালিক হয়েছেন এই এলাকা থেকেই। ভাগজোক করে নিয়েই তাদের অর্থ-বিত্ত ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ভাগাভাগির একপর্যায়ে পছন্দ না হওয়া মানবীয় চরিত্রের একটি দুর্বল দিক। নিজের ভাগকে তারা আর যথেষ্ট মনে করছিল না। লোভের আগুন বড়ই ভয়ঙ্কর। জেগে উঠেছিল লোভের আগুন। পুরোটাই নিজের জন্য চেয়েছিলেন তারা। মিল্কি এ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন। কাউকে খুন করে পথ পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয়নি তার। খবরে প্রকাশ, মতিঝিল এজিবি কলোনি থেকে উত্থান হওয়া মিল্কি যুবলীগে প্রভাবশালী হয়ে উঠছিলেন। নবগঠিত কমিটিতে নিজের পদ ছাড়াও পছন্দের লোকেদের জায়গামতো সেট করেছিলেন। সংখ্যাধিক্যের জোরে যুবলীগের কমিটিতে নিজের পক্ষে সিদ্ধান্ত বাগানো তার জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অর্থে কমিশনার পদপ্রার্থী হওয়ার পথ তার জন্য সুগম হয়েছিল। প্রতিপক্ষ যেখানে বাটোয়ারার পুরোটার জন্য লালায়িত, সেখানে তারা দেখল সব কিছুতেই তারা হারতে বসেছে। যে ভাগ তারা এত দিন পেয়ে আসছিল ভবিষ্যতে সেটাও পাওয়ার নিশ্চয়তা শঙ্কার মধ্যে পড়ে যাচ্ছিল। মিল্কির কৌশল ও চাতুর্যের কাছে তারা ধরাশায়ী হয়ে যাচ্ছিল। প্রতিপক্ষের চোখের সামনে তিনি উজ্জ্বলভবিষ্যৎ নির্মাণ করে চলছিলেন। পরাজিত পক্ষকে তাই হার্ডলাইনে যেতে হয়েছে। তারা নেপাল, দুুবাই আর রাজধানীর নামীদামি হোটেলে বসে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছেন। হত্যার এ ঘটনা আকস্মিক নয়। খবরে এর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ জানাচ্ছে, ছয় মাস আগে তাকে হত্যার পাকাপাকি সিদ্ধান্ত হয়। কেউ বলছে, তিন মাস আগে। অন্যরা খবর দিচ্ছে, এক মাস আগে। এটা নিশ্চিতভাবে বোঝা যাচ্ছে হত্যার সিদ্ধান্তটি মিল্কির মাথার ওপর ঝুলছিল। এ জন্য তারা যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ের দিনগুলো বেছে নিতে চেয়েছিল বলেও খবর জানা যাচ্ছে, যাতে করে তাকে হত্যার দায়টি যুদ্ধাপরাধীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায়। যুবলীগের কোন কোন নেতা এর সাথে জড়িত তাও প্রকাশ পেয়েছে । কোন সন্ত্রাসী নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। ষড়যন্ত্র যত গোপনেই হোক তার একটা গন্ধ বাতাসে ভেসেছে। মিল্কি নিজেই সেটি টের পেয়েছেন। বাংলাদেশের পুলিশ নাশকতার অপচেষ্টাকে অগ্রিম ভণ্ডুুল করে দেয়ার ক্ষেত্রে রীতিমতো বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। অন্তত এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিগত সাড়ে চার বছরে ঘটতে যাওয়া প্রতিটি নাশকতার যড়যন্ত্র নস্যাৎ করেছেন অত্যন্ত সফলভাবে। তা না হলে দেশে কেন একটি নাশকতার ঘটনাও ঘটল না! নিশ্চই ওই সব যদি তারা ভণ্ডুল করতে না পারতেন ভারত ও নেপালের মতো ছিটেফোঁটা অন্তত কয়েকটি নাশকতার ঘটনা বাংলাদেশে ঘটতে পারত। সংবাদ সম্মেলনের প্রতি আমাদের কয়েকটি বাহিনীর কিছু সদস্যের লোভ দেখে কৌতুক অনুভব হয়। নাশকতার অগ্রিম অভিযোগে আটক নাগরিকদের সাথে সিনা টান করে তারা দাঁড়ান। পুলিশ, র‌্যাব কখনো বা বর্ডার গার্ডের সদস্যদের কথিত নাশকতাকারীদের পাশে গর্বিত ছবি দেখতে তারা নিজেরাই যে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। মিল্কি খুন তার সর্বশেষ নজির। ওই দিনই রাজধানীতে ছয়টি খুন হয়। মিল্কির মুল খুনি তারেক ক্রসফায়ারের নামে শেষ করে দিয়ে আবার জানিয়ে দেয়া হলো হত্যার বিচার করা যাবে না। বর্তমান অবস্থায় খুনের বিচার সম্ভব নয়। সাড়ে চার বছরে দেশে খুন গুম ও অপহরণের হাজার হাজার ঘটনা ঘটেছে। স্কুল-কলেজ-মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের ধরে এনে একচেটিয়া জিহাদি ও জঙ্গি তকমা দিয়ে নাশকতা ঠেকিয়ে দেয়ার জন্য বিজয়ের বিশাল হাসি দিলেও দেশে ঘটে যাওয়া খুন-গুম ও অপহরণের একটি ঘটনাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অগ্রিম ঠেকাতে পারেনি। জলের মতো পরিষ্কার অপরাধের কোনো কিনারা করতে পারছে না পুলিশ। অপরাধীদের শনাক্ত করা ও ধরার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে তারা। চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী গুম ও তারকা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুনসহ আরো শত শত জঘন্য ঘটনার একটির ব্যাপারেও পুলিশ কোনো অগ্রিম পদক্ষেপ নিতে পারেনি। জঙ্গি তৎপরতা দমনের চেয়ে এসব অভিযান অনেক সহজ হওয়ার কথা। যেখানে জঙ্গিরা বিশ্বের সেরা সেরা গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে। প্রশিক্ষত গোয়েন্দা বাহিনীকে কুপোকাত করে বিশ্বের সেরা সেরা স্থাপনায় আঘাত হানছে সাফল্যের সাথে। আমাদের পুলিশের ক্ষেত্রে ঘটছে স¤পূর্ণ উল্টো ঘটনা। তারা জলবৎ তরল ঘটনায় পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে স¤পূর্ণ ব্যর্থ আর সবচেয়ে কঠিন অপারেশনে হচ্ছে সফল! কখনোই না ঘটা নাশকতাদমনে পুলিশের সাফল্য বড়ই হাস্যকর। এর সাথে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর রাজনৈতিক লাঠিয়ালের ভূমিকার একটি যোগসুত্র রয়েছে। শাপলা চত্বর ক্রাকডাউনের পর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও পুলিশের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে দেয়া বিবৃতির মিল দেখে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। রাজনৈতিক ব্যবহারের কারণে পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা এখন তলানিতে। বিডিআরকে (বর্তমান বর্ডার গার্ড) মানুষ অপেক্ষাকৃত একটি আস্থাভাজন বাহিনী হিসেবে দেখে থাকে। বিগত বছরগুলোতে এ বাহিনী অনেকটাই পুলিশের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। বিএসএফ সীমান্তে প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা করছে। নবগঠিত বাংলাদেশী বর্ডার গার্ডের ভূমিকা সেখানে নগণ্য বলে প্রতীয়মান হয়। এরাই বিক্ষোভ দমনের নামে দেশের অভ্যন্তরে এসে নিজেদের নাগরিক হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। এখন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী ও বাংলাদেশী সীমান্তরক্ষী উভয়ের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা। শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের পর বর্ডার গার্ডের পক্ষ থেকে দেয়া বক্তব্য সরকারি দল আওয়ামী লীগের দেয়া বক্তব্যের সাপ্লিমেন্টারি মনে হয়েছে। মিল্কি নিজে পুলিশের কাছে জীবনহানির শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। খুনিরা গুলশানে ছয় ঘণ্টার যে দীর্ঘ বৈঠক করেছিলেন সম্ভবত তার আগেই পুলিশের কাছে সেই আর্জি তিনি জানিয়েছিলেন। মতিঝিলে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি নিয়ে যুবলীগের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টিও প্রকাশ্য ছিল। মিল্কি ও তার প্রতিপক্ষ মতিঝিলে কয়েকবার মুখোমখি হয়েছিল। অর্থাৎ মিল্কি হত্যা হঠাৎ ঘটা কোনো ইনসিডেন্ট নয়। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে ক্ষমতা ও অর্থের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে যে নীরব মহড়া চলে আসছিল, তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের একটি ছিল এটি। এর আরো ভয়াবহ প্রকাশ সামনে আরো ঘটতে পারে। এত সহজে শনাক্তযোগ্য একটি ঘটনাকে পুলিশ কেন অগ্রিম ভণ্ডুল করতে পারল না? এই প্রশ্ন সাধারণ জনগই করতে পারে। তা হলে এ বাহিনী জনগণের নিরাপত্তার ব্যাপারে গাফেলÑ এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। অন্য দিকে নাশকতাদমনের নামে অপ্রয়োজনীয় কাজ করে ক্রেডিট নিতে তৎপর। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুবলীগ কতটা অর্থকরী মিল্কি ও তারেক খুনের পর তা প্রকাশ পেল। ইত্তেফাক লিখেছে, মহানগরী যুবলীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের পদ বিক্রি হয়েছে ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকায়। যুবলীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের দরদাম এতটা কেন উঠেছে পুলিশ কি কখনো এ নিয়ে কাজ করেছে? অন্তত এ বেআইনি কর্মকাণ্ডের প্রতি মনোযোগী হলে অযাচিত প্রাণহানির দুটি ঘটনা ঘটত না। বেঁচে যেতেন মিল্কি ও তার বন্ধু তারেক। এতে এটাও প্রমাণ হয়, ক্ষমতাসীনেরা দেশকে ভাগজোক করে নিয়েছে। এ জন্য অমুক লীগ, তমুক লীগ নামের শত শত সংগঠনের জন্ম হয়েছে। প্রশাসনের সমান্তরাল আরেকটি প্রশাসন তারা চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে চলছে বেআইনি সব কর্মকাণ্ড। পুলিশকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যচ্ছে বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসে মিলাদ মাহফিল নিয়ে। নাশকতার আশঙ্কার অভিযোগ এনে সেটা ভণ্ডুল করায় তাদের উৎসাহের অন্ত নেই। একই কারণে সরকারি অফিসে জোর করে টেন্ডার দখল, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি কোনো অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে না। নাশকতাজঙ্গিইস্যু দিয়ে অপরাধকে আড়াল করার যে চেষ্টা হচ্ছে মিল্কি খুনের ঘটনায় ঘাতক তারেক সেই ঢাল ব্যবহার করতে চাইল। টুপি-পাজামা-পাঞ্জাবিকে পুলিশ এখন নাশকতার প্রতীক হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। তারেক এ পোশাক ব্যবহার করেছে হত্যার সময়। এর মাধ্যমে চোখে ধুলা দেয়ার চেষ্টা করেছে তারেক। পুলিশও হয়তো মিল্কি হত্যাকে নাশকতার একটি ঘটনা হিসেবে দাঁড় করিয়ে নিতে পারত এ সুযোগে; কিন্তু বাদ সেধেছে শপার্স ওয়ার্ল্ডের সিসি ক্যামেরা। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশের ব্যর্থতার অন্ত নেই; কিন্তু অপরাধকে আরো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে তাদের সফলতার প্রশংসা না করে পারা যায় না। অন্তত মিল্কির খুনি তারেকের ক্রসফায়ারের পর কারো এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকার কথা নয়। গ্রেফতার হওয়া তারেক একই সাথে মিল্কির প্রতিপক্ষ, যুবলীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতা স্বয়ং খুনি। হত্যার রহস্য উদঘাটনে সে একাই ছিল যথেষ্ট। পুলিশের কাছে ১ নম্বর প্রায়রিটি হওয়ার বিষয় ছিল তারেকের নিরাপত্তা। তাকে সেইফ কাস্টোডিতে নিরাপদে রাখাই ছিল একমাত্র কাজ; কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়া হলো খিলক্ষেতে। এরপর তিনি হয়ে গেলেন এনকাউন্টারের একটি গতানুগতিক কাহিনী। অন্য যারা এ হত্যার সাথে জড়িত, তাদের নামধাম প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এরা একই সাথে সন্ত্রাসী ও যুবলীগের সদস্য। তাদের ছবিসংবলিত প্লাকার্ড-ফেস্টুন রাজধানীর আনাচে-কানাচে ভরা; কিন্তু পুলিশ তাদের ধরতে পারছে না।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads