শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

রাজনীতির দৌড়


এক নেত্রী সরকার গঠনের অনেক আগেই মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা যাচাই করেছিলেন মাঠে দৌড় দিয়ে কে কোন স্থান অধিকার করে, তা পরীক্ষা করে। আসলে এ সবই আজ্ঞাবহ নেতাদের পরখ করার তামাশা। ২০১১ সালে একজন সংসদ সদস্য টিভি চ্যানেল আইয়ের ‘তৃতীয় মাত্রা’ অনুষ্ঠানে মাঠে দৌড় দিয়ে মন্ত্রী হওয়ার ঘটনা যেভাবে প্রকাশ করলেন তাতে এটা সুস্পষ্ট, নেত্রীর কাছে ওই নেতাদের ব্যক্তিত্বই নেই। তার বর্ণনা অনুযায়ী, একটি বড় দলের প্রধান নেত্রী চীন সফরে যাওয়ার সময় দলের মধ্য পর্যায়ের তিন নেতাকে সফরসঙ্গী করে সাথে নিয়ে যান। নেত্রী এদের ব্যক্তিত্ব যাচাই করার জন্য চীনের একটি পার্কে বেড়াতে গিয়ে ১০০ মিটার দৌড় দিতে বললেন। দৌড়ে যিনি প্রথম হবেন তাকে তিনি যোগাযোগমন্ত্রী বানাবেন। সফরসঙ্গীরা বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সাথে নিলেন। নেত্রীর নির্দেশে সফরসঙ্গীরা একটা বাঁশিও জোগাড় করলেন। নেত্রী বাঁশি বাজানোর সাথে সাথে তিনজন মধ্য পঞ্চাশ বছর বয়সী নেতা দৌড় দিলেন। প্রথম স্থান অধিকারী ব্যক্তিটি এরপর নেত্রীকে বিনয়ের সাথে বললেনÑ নেত্রী, আপনি কিন্তু কথা রাখবেন; প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন না। তিনি জীবনে ওপরে ওঠার সিঁড়ি পাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। বেশ ক’বছর পর নেত্রী সরকারপ্রধান হলেন এবং প্রথম স্থান অধিকারী সে ব্যক্তি তার চৈনিক প্রতিশ্রুতির কথা বারবার মনে করিয়ে দিতে লাগলেন। ওয়াদা ভঙ্গকারীকে খোদা পছন্দ করেন না ইত্যাদি নীতিকথা বলতেও ছাড়লেন না। একপর্যায়ে তিনি যথারীতি মন্ত্রী হলেন এবং দৌড় যেহেতু যোগাযোগের বিষয়, তাই তিনি হলেন যোগাযোগমন্ত্রী । এটা এ দেশের রাজনীতির জন্য বেনজির ঘটনা তো বটেই; বিষয়টি (অক্টোবর ২০১১ সালে) মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায় এবং হাস্যরসের সৃষ্টি করে। আমার বিশ্বাস, এ ধরনের মশকারা রাজ্জাক, তোফায়েল বা আমুর সাথে করা সম্ভব হতো না। বিগত সময়ে ডেমরার সরকারদলীয় এমপির গণধাওয়া খেয়ে দৌড় জনগণ মিডিয়ার কল্যাণে দেখতে পেয়েছিল। এ দেশের দৌড়ে দ্রুত মানব ভাইটি সঙ্গত কারণে এখন যোগাযোগমন্ত্রী হওয়ার দাবি করতে পারেন। সেই সাথে মাঝে মাঝে যেসব নেতা জনগণের ধাওয়া খেয়ে বেদম দৌড় দেন, তাদের জন্য মন্ত্রিত্বের একটি কোটা বরাদ্দ থাকা উচিত। দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধারেরা এটা মনে রাখলে ভালো হবে। এর চেয়েও বড় ঘটনা রয়েছে ভারতের রাজনীতিতে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈলসিংয়ের মন্তব্য ছিলÑ আমার নেত্রী (ইন্দ্রিরা গান্ধী) যদি বলেন ‘আমাকে একটা ঝাড়– সংগ্রহ করে দিতে হবে’ তাহলে ঝাড়–দার হতাম এবং তাই করতাম। তিনি আমাকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে পছন্দ করেছেন। (দ্রষ্টব্য : ইন্দিরা, পৃষ্ঠা-৪৭২, ক্যাথারিন ফ্রানক)। মহামতি আলেকজান্ডার তার সময়ের অন্যতম দার্শনিক ডায়োজিনসের কুঁড়েঘরে গিয়ে হাজির হয়ে বললেনÑ আমি আলেকজান্ডার, অর্ধপৃথিবীর মালিক। আপনাকে আমার সাম্রাজ্যের একটি দেশের রাজা বানাতে চাই। রাজি কি না বলুন। ডায়োজিনস তখন খালি গায়ে উঠানে বসে গায়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন। পণ্ডিতদের কেনাবেচা করা যায় না। ডায়োজিনস বললেনÑ খুব খুশি হব যদি আপনি আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। কারণ আপনার জন্য আমার গায়ে রোদ লাগছে না। বাংলাদেশের এক রাষ্ট্রপতি সংসদে ভোটে মাত্র রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। স্পিকারের কক্ষে সাংবাদিকসহ অন্যরা তাকে অভিনন্দিত করছেন। হঠাৎ একজন এমপি তার কক্ষে প্রবেশ করে বললেনÑ প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে ডাকছেন। বেচারা বেশ বিব্রত। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। রাষ্ট্রপতিকে কি প্রধানমন্ত্রী তার কক্ষে ডাকতে পারেন? তা ছাড়া তিনি তো এমনিতেই স্পিকার। প্রটোকলে এটা পড়ে না। কিন্তু সবাইকে হতাশ ও অবাক করে তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে ঢুকলেন। দেশে একজন রাষ্ট্রপতির কথা শোনা যায় যিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে গেলে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন, যা কোনো প্রটোকলের মধ্যে পড়ে না। অথচ ইতিহাসে অনেক মানুষই নিচু অবস্থা থেকে বড় পদে গেলেও ব্যক্তিত্ব হারাননি। দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন ছিলেন ক্রীতদাস। কিন্তু সুলতান হওয়ার পর তার ব্যক্তিত্ব এতটাই প্রবল ছিল যে, তার মধ্যে আগের জীবনের কোনো লক্ষণ কেউ দেখেনি। একটি দলের প্রধান নেত্রীর বিদেশ ভ্রমণের সময়ের ঘটনা শুনে রাজনীতিকদের অনেকের ব্যক্তিত্বহীন তা সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা হয়েছিল। বিদেশে অনুষ্ঠানের দিন সকাল বেলায় নেত্রী তার রাজনৈতিক সহকর্মীকে ডাকলেন। কক্ষে ঢুকতেই তিনি সহকর্মীকে বললেনÑ সব ঠিক আছে তো? যখন তিনি তার কক্ষে ঢোকেন তখন নেত্রী সোফায় বসেছিলেন। ভেতরে দু’জন সাবেক মহিলা এমপি দাঁড়ানো। তাদের একজন নেত্রীর পায়ে মোজা পরিয়ে দিচ্ছিলেন। অন্যজন জুতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। মোজা পরা শেষ হলে জুতা হাতে নিয়ে দাঁড়ানো নেত্রী তার পায়ে জুতা পরালেন। ওই দু’জন নেত্রীর একজন দল ক্ষমতায় আসার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। অন্যজন প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। জুতা পরিয়ে প্রতিমন্ত্রী হতে পারলে মন্ত্রী হওয়ার জন্য দৌড় দেয়ায় দোষ কোথায়! এ দেশের দলগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের মতো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতা তৈরি হয় না। এ দেশে দলের প্রধান নেতার ইচ্ছামাফিক নেতা বানানো হয়। ইদানীং বড় দলে উচ্চফলনশীল বা দ্রুতবর্ধনশীল নেতাকুল তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে, যা খুব ভালো লক্ষণ বলে মনে হচ্ছে না। ইউরোপ বা আমেরিকায় এভাবে নেতা বানানোর ধারণাও করা যায় না। নিচু থেকে উঠে আসা মানুষ ওপরে ওঠার বাসনায় এহেন কর্ম নেই, যা তারা করতে পিছপা হয়। তারা জেনে গেছে, দলের প্রধান ব্যক্তির ইচ্ছায় এখানে নেতৃত্ব, মন্ত্রিত্ব, পদ-পদবি পাওয়া সহজ। একজন কর্মী যতই ত্যাগী ও মেধাবী হোক না কেন, দলের প্রধান নেতার ইচ্ছার বাইরে তার পক্ষে বড় পদে যাওয়া সম্ভব নয়। আদর্শের নয়, ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যই দলে পদলাভের আসল যোগ্যতা। ফলে এখানে আবুল-বাবুলদেরই জয় হবে আর দেশ কেবল পেছাতেই থাকবে। দেশের রাজনীতিতে ভালো মানুষের অবস্থান কমে আসছে আর সেই স্থান দখল করে নিচ্ছে মন্দ মানুষেরা। বাংলাদেশে দৌড় দৃশ্য প্রতিটি সরকারের পতনের পরপরই জনগণ দেখে থাকেন। নেতাদের সে কী দৌড়। কেউ ছুটছে সপরিবারে, কেউ বা একাকী। তারা যে এত গতিশীল, তা জাতি কখনোই জানত না। একবার হরতালের মিছিলে পুলিশি হুমকির মুখে এক বড় নেতার দৌড় দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তিনি যে কখন দৌড়ে মিন্টু রোডের এক বাসভবনে এসে আশ্রয় নিয়েছেন তা জানা গেল অনেক পরে। কিভাবে তিনি একা একা দৌড়িয়ে এত দূর আসতে পারলেন, তা বিস্ময়কর। তবে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতেই হলো যে, প্রাণের মায়ায় মানুষ অসম্ভব কিছু করে ফেলতে পারে। দুই নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে উতরিয়ে দেশের জন্য রাজনীতি করেছেন, আন্দোলন করেছেন। ব্যর্থতা তাদের যেমন আছে, সাফল্যও আছে। তারা দু’জনেই মাঠের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেনজির ঘটনার জন্ম দিতে পেরেছিলেন। দুই নেত্রী ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুরুষ স্বৈরাচারীকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছিলেন। উভয়ের আমলেই নারীসমাজের অগ্রগতি হয়েছে। অবহেলিত নারীজাতির হয়েছে ক্ষমতায়ন। অবশ্য তা আমাদের সমাজের অনেক ঐতিহ্যকেও ভেঙে দিচ্ছে। তবে দু’জনের নেতিবাচক যে বিষয়টিতে ঐক্য রয়েছে তা হলোÑ উভয়ের চার পাশে অনেক চাটুকার, দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদীরও সমাবেশ ঘটেছে। দু’জনের সীমাবদ্ধতা এখানেই যে, তারা অনেক ক্ষেত্রে এদের চিনতে পারেননি। ভবিষ্যতে তারা কে কাকে কত দৌড়াতে পারেন সেটাই দেখার বিষয়। সুখ ও দুঃখ পালাক্রমে আসে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জীবনে ‘দৌড়’ আসে পালাক্রমে ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads