রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৩

দ্রব্যমূল্য : সরকারের সাফল্য কোথায়?


মহাজোট সরকার প্রায় ৫ বছরে মানুষকে স্বস্তি ও শান্তি দিতে পারেনি। উল্টো প্রতিদিনই মানুষকে শুনতে হচ্ছে কোন না কোন দুঃসংবাদ। ক্ষমতাসীন মহলের যোগসাজশে প্রতারক কোম্পানিগুলো হাতিয়ে নিয়েছে জনগণের আমানত।
আশা-নিরাশার দোলাচলে কেটেছে গত সাড়ে চারটি বছর। কেটেছে অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও অহংকারে। বুকভরা আশা নিয়ে মানুষ ভাল কিছু আশা করেছিল ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে এই সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার সময়। কিšুÍ সাড়ে চার বছর ধরে মানুষের জীবন কেটেছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে। প্রতিদিনই মানুষকে শুনতে হচ্ছে কোন না কোন দুঃসংবাদ।
জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অগ্রাধিকারভিত্তিক পাঁচটি বিষয়ের প্রথমটি ছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ করা। ইশতেহারের ১.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে, চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা হবে।’
এই সরকারের আমলে অর্থনীতির সকল সূচক নিম্নগামী। সরকারের আর্থিক খাতে লাগামহীন অনাচারের কারণে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে। পণ্য সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে  বাড়ছে। তীব্র মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে। সাড়ে চার বছরে দেশের সব ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকা-কন্ট্রাক্ট চলে গেছে আওয়ামী লীগের নেতা এবং তাদের পরিবার-পরিজনদের হাতে। মহাজোটের আত্মীয়-স্বজনের লুটপাটের কারণে  শেয়ারবাজার ধস বহু চেষ্টা করেও ঠেকানো যাচ্ছে না। লাখো কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। শেষ সম্বলটুকু খুইয়ে তারা রাস্তায় নেমে পড়েছেন। সর্বস্বান্ত বিনিয়োগকারীর অনেকে আত্মহত্যাও করেছেন।
সরকারের লোকজন দেশের মানুষের আমানত করা অর্থ লুট করেছে। সরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ডেসটিনি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ। ক্ষমতাসীন মহলের প্রত্যক্ষ যোগসাজশে এই সমস্ত প্রতারক কোম্পানি জনগণের টাকা লোপাট করেছে। এতে অসংখ্য নিরীহ সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। যে কোন সরকারি ঋণের টাকা জনগণের ঘাম নিংড়ানো পয়সা দিয়েই পরিশোধ করতে হয়। পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর ঋণ একদিন জনগণকেই পরিশোধ করতে হতো। অথচ সরকারের মন্ত্রী-আমলাসহ কর্তাব্যক্তিরা আগেভাগেই লুটপাটের আয়োজন করতে থাকেন।
সরকারের ছত্রছায়ায় লুটপাট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হয়তোবা একদিন সকালে উঠে দেখা যাবে সমুদ্রের পানিও নেই। এ পানিও লুট করে নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ। লুটের টাকা দিয়েই সরকারের লোকজন ২১টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েছে।
বছরজুড়েই নিত্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এ কারণে জনগণের মধ্যে এক ধরনের নাভিশ্বাস উঠেছে। বাজার নিয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে  বিরাজ করছে এক ধরনের হতাশা। ব্যর্থ হয়েছে সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণের তৎপরতা। এটি সফল না হওয়ায় দেশের মানুষের মাঝে পণ্যমূল্য নিয়ে রয়েছে অব্যাহত চাপা ক্ষোভ। মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এক বছরে আলু ও পিয়াজের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এছাড়া রসুন, ছোলা, মসুর ডাল, লবণ, আদা, সয়াবিন, খেজুর, চাল ও ডিমের দাম ৩ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের দেয়া প্রতিবেদনেও এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। কমিটি এসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে তদারক বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল। ২০১২ সালের ১৯ ডিসেম্বর সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছরে আলুর দাম বেড়েছে ১২৭ শতাংশ। ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর যে আলুর কেজিপ্রতি দাম ছিল ৮ থেকে ১৪ টাকা, ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ থেকে ২৬ টাকায়। একইভাবে এক বছর আগে যে পিয়াজের দাম ছিল ২০ থেকে ২৮ টাকা, সেই পিয়াজের দাম ৪০ থেকে ৬০ টাকা। আর রসুনের দাম বেড়ে হয়েছে ৪০ থেকে ৯০ টাকা, মসুর ডাল ৩৮ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়ে ৭৫ থেকে ১৪০ টাকা, খেজুর ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৯০ থেকে ১৫০ টাকা, লবণ ২৬ দশমিক ৩২ শতাংশ বেড়ে ১৮ থেকে ৩০ টাকা, ছোলা ২১ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকা, আদা ১০ শতাংশ বেড়ে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, সয়াবিন ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ বেড়ে ১১৬ থেকে ১১৮ টাকা এবং মাঝারি চাল প্রায় ৩ শতাংশ বেড়ে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ফার্মের ডিম প্রতি হালি ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়ে ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এক বছরে হলুদের দাম সবচেয়ে বেশি কমেছে। এক বছর আগে যে হলুদের কেজি ছিল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, এখন তার দাম ৯০ থেকে ১৪০ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজি মোটা চাল ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়ে ২৭ থেকে ৩২ টাকা, সরু চাল ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেড়ে ৩৪ থেকে ৪৮ টাকা, খোলা পাম অয়েল ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়ে ৭৬ থেকে ৭৮ টাকা, চিনি ১৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়ে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা এবং শুকনা মরিচ ১০ শতাংশ বেড়ে ১২০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১২ সালে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির হার ছিল ১৩ শতাংশ। আর যে সকল পণ্যের মূল্য একবার বেড়েছে তা আর কখনও নামেনি। তা হলোচালের মধ্যে কাটারি ভোগ, চিনিগুঁড়া, কালোজিরা, ডাল জাতীয় পণ্যে, লবণ, ডিম, পিয়াজ, ময়দা, মসলাসহ অন্যান্য পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি এখনও অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে আলু ও পিয়াজের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এছাড়া রসুন, ছোলা, মসুর ডাল, লবণ, আদা, সয়াবিন, খেজুর, চাল ও ডিমের দাম ৩ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। (সূত্রঃ দৈনিক মানবজমিন ৫ জানুয়ারি ২০১৩)
এ দেশে নির্ধারিত ও যুক্তিসঙ্গত মূল্য ভোক্তারা পণ্য বা সেবা কিনতে পারে এমন কথা হলফ করে কেউই বলতে পারবে না। এখানে দফায় দফায় এবং নানা উপলক্ষে পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ে এবং ভোক্তাদের বিনাবাক্যে সেই বাড়তি মূল্যে পণ্য ও সেবা কিনতে হয়। এখানে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যথেচ্ছভাবে মজুদ করে রাখে, দাম বাড়ায় এবং এর কোন প্রতিকার হয় না। ভোক্তারা তাদের লাভের ছুরিতে জবাই হয়। আত্মরক্ষার কোনো উপায় তাদের জানা নেই।
ভোক্তার অধিকার সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বর্ণনা ছাড়াও ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনজনিত অপরাধ শনাক্ত করা হয়েছে। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্য গ্রহণ, সিন্ডিকেট করে পণ্য গুদামজাতকরণ ও অসদুপায়ে মূল্যবৃদ্ধি, নকল পণ্য উৎপাদন, পণ্যে ভেজাল মিশ্রণ, নতুন মোড়কে পুরাতন পণ্য বিক্রি, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, ওজনে কম দেয়া ইত্যাদিকে দ-নীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এসব অপরাধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায় দ- নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আইন তো কাগজেই রয়েছে।
প্রতিদিনই বেড়েই চলেছে কোন কোন জিনিসের দাম। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোন মিল না থাকায় মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে। যাদের সঞ্চয় ছিল তারা এতদিন ভেঙে খাওয়ার চেষ্টা করেছেন। যাদের সঞ্চয় আছে তারা সেটা ভেঙে এখনো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের মন্ত্রীরা সরকারের বড় সাফল্য হিসেবে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার দাবি করলেও টিসিবির হিসাব ও বাজার বিশ্লেষণে তাদের এ দাবির কোন সত্যতা নেই।
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা সাধারণ মানুষকে আরো বেশি পাগল করে ফেলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষের কষ্টের সীমা নেই। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ তাদের আয়-ব্যয়ের সাথে হিসাব মিলাতে পারছে না। এতে জনজীবনে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নেমে এসেছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে নি¤œ ও মধ্যবিত্তের বাঁচার পথ আস্তে আস্তে স্তব্ধ হতে চলেছে।
সরকার নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে চাইলেও বাজারে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। সরকারের তোড়জোড় আর হুমকি-ধমকি কোন কাজে আসছে না। দাম বাড়ছে সমান তালে। যেভাবে ওই সিন্ডিকেট চাচ্ছে। অভিযোগ আছে সরকারের উপর মহলের অনেকেই এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন পণ্যের দাম বাড়ছে। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শীর্ষ ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও সাধারণ ক্রেতাদের দুর্ভোগ কমাতে পারেনি।
এখন সরকারের অর্থমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী বাজারে সিন্ডিকেট রয়েছে বলে স্বীকার করছেন। সিন্ডিকেট ভেঙে বাজার স্বাভাবিক করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারের মন্ত্রীরা গণমাধ্যমে বড় বড় কথা বললেও বাজার মনিটরিংয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কখনও উৎপাদকরা, কখনও পাইকারি বিক্রেতা আবার কখনও খুচরা বিক্রেতারা অধিক মুনাফার জন্য দাম বাড়ালেও রহস্যজনক কারণে সরকারের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সংগঠন চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। কথায় কথায় বাজার সিন্ডিকেটের কাছে চলে গেছে বললে লাভ হবে না। আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে অহেতুক কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে ভোট পাওয়ার জন্য দ্রব্যমূল্য কমিয়ে রাখা ও সিন্ডিকেট ভাঙার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন ভোট নেই, তাই তারা তাদের সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছে। সরকারের মন্ত্রীরাও স্বীকার করেছেন বাজারে সিন্ডিকেট আছে। সরকারের মন্ত্রীদের উচিত বেশি কথা না বলে বাজার কুক্ষিগত করে রাখা সিন্ডিকেট ভাঙা।
শুধু বাজার সিন্ডিকেট  নয়। চাঁদাবাজির কারণেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা দেশে সড়ক পরিবহনে পথে পথে চাঁদাবাজির তা-ব পণ্য পরিবহনে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পরিবহনের চাঁদা নিয়ে সারা দেশে গড়ে উঠেছে একটি নিয়ন্ত্রণহীন সংঘবদ্ধ চক্র। বেপরোয়া চাঁদাবাজির কাছে জিম্মি সাধারণ পরিবহন মালিকরা। রাজধানী থেকে মফস্বল শহরের মেঠোপথ পর্যন্ত চলাচলকারী সব ধরনের যানবাহন এখন চাঁদাবাজির নেটওয়ার্কের আওতায়। পরিবহন মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট চাঁদাবাজিতে অংশ নিলেও কোনো পক্ষই চাঁদাবাজির দায় নিতে চায় না।
সড়ক পরিবহনে চাঁদাবাজি এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। চাঁদা না দিলে ঘুরে না কোনো গাড়ির চাকা। রাস্তায় চলাচলের প্রধান চালিকাশক্তি এখন পরিবহনের চাঁদা। জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক, পৌর এবং উপজেলা সড়ক, ফেরিঘাট, বাস ও ট্রাক টার্মিনাল, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নিয়মিত লাগামহীন চাঁদাবাজি হয়।
সড়ক পথে রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২২ জেলার সংযোগ রক্ষাকারী পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার চাঁদাবাজি হয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী স্থানীয় প্রভাবশালী দালাল চক্রের সঙ্গে যোগ দিয়ে ফেরিঘাটে কৃত্রিম যানজট তৈরি করে। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে ফেরিঘাট পার হতে হয়। এই ফেরিঘাট দিয়ে দিনে প্রায় ২৫০০ বাস, মিনিবাস, পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করে। এর মধ্যে দালালচক্র কৃত্রিম যানজট সৃষ্টি করে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে ১০০০/১৫০০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে আগে পার করিয়ে দেয়। এসব চাঁদা পুলিশ, বিআইডব্লিউটিসি এবং স্থানীয় ক্যাডাররা ভাগ পায়।
ফেরিঘাটের চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে ৮ এপ্রিল ২০১২ দক্ষিণাঞ্চলের ২২ রুটে ধর্মঘট ডেকেছিল বাস-ট্রাক ওনার্স এসোসিয়েশন। পরে কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে সেটি প্রত্যাহার করা হয়। বাংলাদেশ ট্রাক সেক্টরে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হয় আরিচা ঘাটে। এই ঘাটের পারাপারের জন্য ৯৫০ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও চাঁদাবাজদের কারণে দিতে হয় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। আগে চালকরা নিজেরা পারাপারের টিকিট কাটতেন। এখন চাঁদাবাজরা টিকিট কাটাতে দ্বিগুণ টাকা হাতিয়ে নেয়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার  কারণে দীর্ঘদিনেও এই চাঁদাবাজি বন্ধ করা যাচ্ছে না। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা পুলিশ ও প্রশাসন এই চাঁদার ভাগ পায়।
সড়ক পরিবহন চাঁদাবাজিতে শ্রমিক ইউনিয়নের পাশাপাশি মালিক সমিতির প্রাধান্য বেড়ে যাওয়ায় চাঁদার ভাগিদারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সারা দেশে ট্রাফিক পুলিশও বড় ভূমিকা রাখে চাঁদাবাজিতে। রাজধানীতেই ট্রাফিক সার্জেন্টরা নিয়মিত বিভিন্ন পয়েন্টে পণ্যবাহী ট্রাক এবং বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করে ঢাকার বাইরেও ট্রাফিক পুলিশ সব ধরনের যানবাহন থেকে বিভিন্ন অজুহাতে চাঁদা আদায় করে।
সড়ক মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনগুলোতে বিভিন্ন পৌর এলাকায় ঢুকলেই পৌরসভার টোল দিতে হয়। গত কয়েক বছরে এটি চালু করেছেন অনেক পৌরসভার চেয়ারম্যান। বাধ্যতামূলক এই চাঁদা না দিয়ে পৌর এলাকা পেরোতে পারে না কোনো যানবাহন। পৌরসভার আদায়কারী রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ওই চাঁদা আদায় করে।
এখন পরিবহন চাঁদার বিকেন্দ্রিকরণ হয়েছে। এ ছাড়া মালিক সমিতিগুলোও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাঁদাবাজিতে নেমে পড়েছে। প্রতিটি জেলা মালিক সমিতিকে টাকা দিয়ে এলাকা পার হতে হয়। এমনকি পৌরসভাকেও প্রতিদিন টোল দিতে হয় প্রতিটি বাসকে।
ঢাকায় আসার পথে গোপালগঞ্জে চাঁদা দিতে হয় ২৫০ টাকা। বাগেরহাট মালিক সমিতিকে ১০০ টাকা, পৌর টোল ৫০ টাকা। পিরোজপুরে মালিক সমিতি ১০০ টাকা, পৌর টোল ৫০ টাকা। পাথরঘাটা মালিক সমিতি ১০০ টাকা, পৌর টোল ৫০ টাকা।
চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও। সড়ক পরিবহনে নিরাপত্তার জন্য ব্যবসায়ীদের দাবিতে হাইওয়ে পুলিশ গঠিত হলেও ছয় বছর শেষে তারাই ব্যাপক চাঁদাবাজিতে নেমে পড়েছে। সারা দেশের মহাসড়কগুলোকে ২৪টি হাইওয়ে থানার অধীনে এনে ২০০৫ সালের জুনে গঠিত হাইওয়ে পুলিশ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল মহাসড়কগুলোতে ডাকাতি, ছিনতাই রোধ এবং মাদক ও চোরাচালানের পণ্য পরিবহন বন্ধ করা। কিন্তু পুলিশের একাংশের সঙ্গে অপরাধীদের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠায় হাইওয়ে পুলিশে গঠনের উল্টো ফল হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির নেতারা বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম, খুলনা-যশোর, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-বরিশালসহ বিভিন্ন রুটে ব্যাপক চাঁদাবাজিতে নেমেছে হাইওয়ে পুলিশ। তাদের চাঁদাবাজিতে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের মালিকরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। হাত বাড়ালেই ৫০০ টাকার নিচে দেয়া যায় না। রাস্তায় চালক ও হেলপাররা অসহায়। টাকা না দিলে পুলিশ গাড়্ আিটকে রাখে।
 চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে খোলাবাজারে ব্যাপক হারে চাল বিক্রি করতে হবে। তাহলে দাম কমতে পারে। মজুতদারি, চাঁদাবাজি ও আমদানি নিয়ে অনিয়মের কারণে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্রেতারা বলছেন, টিসিবিকে পুরোপুরি ঢেলে সাজিয়ে এর মাধ্যমে প্রচুর পণ্য আমদানি করতে হবে। ছোট আমদানিকারকদের উৎসাহ ও সহায়তা দিতে হবে, যাতে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীদের হাতে আমদানি নিয়ন্ত্রিত না হয়। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের ব্যবসায়ী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের ওপর মনিটরিং বাড়ানোর তাগিদ দেন তারা। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০)
সঠিক ওজনে পণ্য পাচ্ছি কিনা, সে ব্যাপারে ভোক্তা হিসেবে আমরা কেউই নিঃসন্দেহ নেই। ওজনে কম দেয়া এদেশের এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ওজনের সময় হাতের মারপ্যাঁচে যেমন কম দেয়া হয়, তেমনি কম ওজনের বাটখারা ব্যবহার করেও কম দেয়া হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যরা বাজারে অভিযান চালিয়ে বহুবার কম ওজনের বাটখারা আটক করেছে। অসৎ বাটখারা প্রস্তুতকারীরা ওজন কম রেখেই বাটখারা তৈরি করে। বিভিন্ন পরিমাপের বাটখারাতেই এরূপ ওজন কিছু কিছু কম রাখা হয়। যেমন, নামে এক কেজির বাটখারা; কিন্তু আসলে হয়তো ৯শ’ গ্রামের। এভাবে এক কেজিতে একশ’ গ্রাম কিংবা এর চেয়ে কম বা বেশি পরিমাণ পণ্য কম দিয়ে মূল্য এক হাজার গ্রামেরই নিয়ে নেয়া হয়। পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআনে ওজনে কম দেয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। অথচ অধিকাংশ ব্যবসায়ীই এই হুঁশিয়ারি আমলে আনেন না। একজন সাধারণ ক্রেতার পক্ষে বাটখারার ওজন সঠিক কিনা তা পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। সন্দেহ জাগ্রত হলেও তার করার কিছুই থাকে না। বিক্রেতার কথায় বিশ্বাস করেই তাকে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হবে। বিক্রেতার অসততার কারণে ক্রেতার বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই ধারা চলছে তো চলছেই।
ভোক্তার পাঁচটি মৌলিক অধিকারের একটিরও প্রাপ্তিও আমাদের দেশে নিশ্চিত নয়। পণ্য সঙ্কটের সাধারণ শিকার এদেশে ভোক্তারা অতিরিক্ত বা উচ্চমূল্য নকল, ভেজাল কিংবা অবনত মানের পণ্য কিনতে বাধ্য হয়। ওজনের ব্যাপারেও তারা নিশ্চিত হতে পারে। যারা ইচ্ছেমত ভোক্তা ঠকিয়ে নিজেদের পকেট ভরছে, সেই অসৎ-অসাধু ব্যবসায়ীরা বরাবরই থেকে যাচ্ছেন অধরা। তাদের কোনো জবাবদিহিতা ও শাস্তির সম্মুখীন হচ্ছে না। তাদের ভোক্তা ঠকানো ও প্রতারণার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও আইনি প্রতিকার পাওয়া গেলে আমাদের এখন যেখানে শোষিত, বঞ্চিত, প্রতারিত, ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে, সেভাবে হয়তো হতে হতো না।
আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন, সুদকে করেছেন হারাম। ইসলামে ব্যবসাকে জীবিকার উত্তম উপায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সততার সঙ্গে, যতটা সম্ভব কম মুনাফায় ব্যবসা করার জন্য বলা হয়েছে এবং পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে মাপ ঠিক দেয়ার কথা বলা হয়েছে। খাদ্যপণ্য মজুদ রাখার ক্ষেত্রেও ইসলামে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আমাদের ব্যবসায়ীরা অধিকাংশই ইসলামের অনুসারী হলেও এসব দিক-নির্দেশনা মান্য করে সামান্যই। ত্যাগ ও সংযমের মাস রমযান। অথচ আমরা বরাবরই দেখে আসছি, রমযান উপলক্ষে, ঈদ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
বর্তমান সরকার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগামিতা ঠেকাতে পারেনি। যতদূর মনে পড়ছে, মাহে রমযানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ বৃদ্ধি ও মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য কয়েক মাস আগেই সরকার চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। পরে পর্যায়ক্রমে কিছু পদক্ষেপও নেয়া হয়। বলা অসঙ্গত হবে না, এতকিছুর পরও দ্রব্যমূল্যের উলম্ফন গতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সাফল্য লাভের জন্য বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে, সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে, অভয় দিয়েছে; কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এতসব ব্যবস্থা নেয়ার পরও সুফল সেভাবে মিলছে না। সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসায়ে মন্দা ও বন্যায় ব্যাপক ফসলহানির কারণে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
চাতাল, তেল পরিশোধন কারখানা, চিনিকল সবখানেই ছিল মিল মালিকদের তেলেসমাতি। তারা গুদামজাত করে রাখেন পণ্য। বাজারে ছাড়েননি। অল্প অল্প ছাড়েন। এভাবে সঙ্কট সৃষ্টি করে ফায়দা নেয়া হয় বাজার থেকে। পণ্য না ছাড়তে তারা নানা অজুহাত দেখান। এলসি খোলার পরও পণ্য আমদানি হচ্ছে না। জাহাজ থেকে খালাস হচ্ছে না। জাহাজে আছে। উৎপাদন কম হচ্ছে ইত্যাদি। কৃষি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর খাদ্য মন্ত্রণালয় দেশে তাদের পণ্যের জোগান পর্যাপ্ত বললেও ব্যবসায়ীরা সব সময়ই সঙ্কটের নানা অজুহাত দেখিয়েছেন। ধানের ভরা মওসুমেও চালের দাম তেমন কমেনি। কৃষকের কাছ থেকে অল্প দামে ধান কিনে মিল মালিকরা বেশি দামে বিক্রি করছেন। পাইকারি বিক্রেতার কাছে চড়া দামে বিক্রি করায় এর প্রভাব পড়ে খুচরা বাজারে। ব্যবসায়ীরা ওই সময় দাবি করেন, কম দামে ধান কিনলেও মিল মালিকদের হাতে এসে তা বেড়ে যায়। কৃষকরা অনেক সময় ন্যায্যমূল্যে গোলার ধান বিক্রি করতে পারেন না। কিšুÍ মিলগুলো সব সময়ই লাভের ওপর থাকে। ধানের বাজার মন্দা বলে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে কিনলেও তারা সব সময়ই চড়া দামে চাল বিক্রি করেন। আবার চালের জোগান কিংবা উৎপাদন কমের দোহাই দিয়ে বাজার চড়া করেন। মূলত দেশের চাল ও ধানের বাজার এভাবেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মিল মালিকদের দ্বারা।
দরিদ্র, শ্রমজীবী এবং নির্দিষ্ট ও বাধা আয়ের মানুষের জীবন নির্বাহ রীতিমত কঠিন হয়ে পড়েছে। দ্রব্যমূল্য হ্রাস-বৃদ্ধির কতকগুলো সাধারণ অর্থনৈতিক নিয়ম আছে। আমাদের দেশে এই নিয়মের বাইরেও মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। নিয়মবহির্ভূত মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্রধানত ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরাই দায়ী। তারা পণ্যে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় এবং সেই মূল্যে পণ্য বিক্রি করে উচ্চ মুনাফা লুটে নেয়। এছাড়া ভোক্তাদের যে নকল-ভেজাল বা অবনত মানের পণ্য কিনতে হয়, তার জন্যও উৎপাদক-আমদানিকারক ব্যবসায়ীরাই দায়ী। ভোক্তাদের এই দুর্ভোগ, বঞ্চনা ও ক্ষতি থেকে যতটা সম্ভব মুক্ত এবং তাদের ন্যায়সঙ্গত আইনি প্রতিকার লাভের সুযোগ নিশ্চিত করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের বিকল্প নেই। এখানে একথাও বলা আবশ্যক যে, যিনি কোনো একটি পণ্যের উৎপাদক বা বিক্রেতা, তিনিই আবার অন্য একটি পণ্যের ক্রেতা বা ভোক্তাও বটে। কাজেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আসলে সকলের অধিকার সংরক্ষণ আইন। এটি একটি গণআইন।
বাজার তদারকের জন্য মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটি থাকলেও প্রকৃত পক্ষে সংশ্লিষ্টদের মাঝে এর খুব একটা উৎসাহ কিংবা প্রচেষ্টা দেখা যায় না। তবে একাধিকবার বাজার পরিদর্শন করেছে মনিটরিং কমিটিগুলো। পৃথক ও যৌথভাবে নানা সময় তৎপরতা দেখালেও বাজারে এর কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং দেখা গেছে, মনিটরিং কমিটির সামনেই নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে পণ্য বিক্রি হতে। আবার মূল্য তালিকা টাঙানোর বাধ্যবাধকতা বেঁধে দিলেও বাজারে তার কোন প্রমাণ মেলেনি। এমনকি মনিটরিংয়ের সময় কিছু দোকানে তাৎক্ষণিকভাবে তা টাঙানো হয়। তবে পরক্ষণেই সেটা সরিয়ে নেয়া হয়। আইন না মানার অপরাধে তেমন কোন শাস্তি না দেয়ায় ব্যবসায়ীদের মাঝে কোন দায়বোধও জন্মাতে দেখা যায়নি।
জনকল্যাণ ও জনস্বার্থে আইন প্রণয়ন অবশ্যই একটি বড় কাজ। তবে এই কাজ কোনো সুফলই উপহার দিতে পারে না, যদি না তার সুষ্ঠু ও যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটে। আইন করে দায়িত্ব শেষ করলে সরকারের চলবে না, তার বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে। এটা এমন এক ধরনের আইন যা থেকে কল্যাণ পেতে হলে জনগণের সম্পৃক্ততা খুবই জরুরি। ভোক্তার অধিকার কি, অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কি কি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছেÑ এসব বিষয়ে গণসচেতনতা না থাকলে যতো ভালো আইনই হোক, তা থেকে ভোক্তা কোনো ফায়দা লাভ করতে পারবে না। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থাগুলোকে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি নিতে হবে। এই সঙ্গে সংক্ষুব্ধ ভোক্তার অভিযোগ দায়ের ও দ্রুত প্রতিকার লাভের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, নকল-ভেজাল ও অবনত মানের পণ্য বিক্রি, ওজনে কম দেয়া ইত্যাদি অন্যায়, অপকর্ম ও অপরাধের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলাও অপরিহার্য। ভোক্তাদের কোনো সংগঠন নেই। তাই তাদের অধিকার সংরক্ষণে এমনতর প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে তারা সামাজিকভাবেও সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। উপযুক্ত গণচেতনা, আইনের কার্যকর প্রয়োগ এবং সক্রিয় সামাজিক প্রতিরোধই কেবল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে পারে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads