মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৩

‘অধিকার’ সম্পাদকের গ্রেফতার ও সরকারের যুক্তি প্রসঙ্গে


এডভোকেট আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার দেশে-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর সম্পাদক তিনি। গত ১০ আগস্ট রাতে গুলশান এলাকায় তার বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দারা। গ্রেফতারের পর সারারাত থানায় আটকে রেখে রোববার তাকে আদালতে হাজির করা হয়। ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে, যদিও পরদিন হাইকোর্ট সে রিমান্ড স্থগিত করেছে। এখানে গ্রেফতারের কারণ লক্ষ্য করা দরকার। মন্ত্রীদের মধ্যে কেউ বলেছেন, তথ্য ও যোগাযোগ আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কেউ আবার বলেছেন, ‘অধিকার’ সম্পাদক নাকি সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘গভীর ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত ছিলেন! পুলিশও আদালতে একই ধরনের অভিযোগ এনেছে। বলেছে, অতীতে বিভিন্নস্থানে নিহত ব্যক্তিদের ছবি একত্রে সাজিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করার মাধ্যমে ‘অধিকার’ নাকি বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণœ করার এবং মুসলমানদের মধ্যে চরম ক্ষোভ সৃষ্টি করার পদক্ষেপ নিয়েছিল! সবচেয়ে চমকপ্রদ কিছু কথা শুনিয়েছেন তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেছেন, আদিলুর রহমান খান নাকি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ভূমিকা পালন করছিলেন! সেজন্যই তিনি নাকি হেফাজতে ইসলামের ওপর চালানো গণহত্যার ব্যাপারে বানোয়াট তথ্য-পরিসংখ্যানসহ রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন! জনাব ইনু নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেননি যে, নিজেদের পক্ষে তৎপরতা চালানোর জন্য রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত ও বিএনপি নিজেরাই যথেষ্ট। এজন্য অধিকারের মতো কোনো সংগঠনের প্রয়োজন তাদের থাকতে পারে না। তাছাড়া অধিকারই বা কেন বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে মাঠে নামবে? সরকারের পক্ষে যুক্তি যতোই দেখানো হোক না কেন প্রমাণিত সত্য হলো, এডভোকেট আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করার এবং রিমান্ডে নেয়ার মধ্যদিয়ে আরো একবার সরকারের নির্বিচার পদক্ষেপের প্রকাশ ঘটেছে। কারণ, ‘অধিকার’ কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এর সম্পাদকও কোনো রাজনৈতিক নেতা নন। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রকাশ করার পরিপ্রেক্ষিতেই বরং বিশ^ব্যাপী পরিচিতি ও খ্যাতি পেয়েছে অধিকার। সরকারের নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের কারণে গণমাধ্যম যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় ‘অধিকার’ বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সব সময় সঠিক তথ্য অবহিত করে এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৫ ও ৬ মে গভীর রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের ওপর চালানো অভিযানের তথ্য প্রকাশ করেছিল। হাসপাতালের মর্গসহ সংশ্লিষ্ট ও স্বজন হারানোদের বরাতে ‘অধিকার’-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই রাতে ৬১ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। ‘অধিকার’ যেহেতু গোপনে তৎপরতা চালায় না সেহেতু সরকার সহজেই সংগঠনটির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে এবং তথ্য-পরিসংখ্যান সত্যি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হলে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারতো। কিন্তু সেটা না করে দীর্ঘ তিন মাস পর এতদিনে এসে তৎপর হয়ে উঠেছেন ক্ষমতাসীনরা। তাই বলে গণতন্ত্রসম্মত পথে পা বাড়াননি তারা। অধিকার সম্পাদক এডভোকেট আদিলুর রহমান খানকে প্রথমে রাতের বেলায় গ্রেফতার করেছে, তারপর সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা দায়ের না করেই রিমান্ড মঞ্জুর করিয়েছে সরকার। এইভাবে দেশের আইনও লংঘন করা হয়েছে। থানায় ‘অধিকার’ সম্পাদকের সঙ্গে তার স্বজন এবং আইনজীবীদের সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। ‘অধিকার’-এর অফিসে তল¬াশি চালানোর সময়ও কোনো আইনজীবীকে উপস্থিত থাকতে দেয়া হয়নি। এর আগে দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকেও তথ্য ও যোগাযোগ নামের একই কালাকানুনে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ‘অধিকার’ সম্পাদককে গ্রেফতার ও মামলায় ফাঁসানোর মাধ্যমে সরকার আরও একবার তার পুনরাবৃত্তি করল। এর ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের নিজের ইমেজই বরং ক্ষুণœ হবে। এজন্যই বিএনপির চেয়ারপারসন ও বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ড. কামাল হোসেন এবং এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ দেশের সিনিয়র আইনজীবীরা এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে এডভোকেট আদিলুর রহমান খানের মুক্তি দাবি করেছেন। একই দাবিতে সোচ্চার হয়েছে টিআইবিসহ অন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোও। গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে প্যারিসভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস এবং হংকংভিত্তিক সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। বিবৃতিতে পুলিশী হেফাজতে অধিকার সম্পাদকের জীবন বিপন্ন হতে পারে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। মতিঝিলের অভিযানে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত থাকলে এ বিষয়ে অধিকার-এর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করার ও যুক্তি প্রমাণের সুযোগ রয়েছে। ‘অধিকার’ দেশে চলমান রাজনৈতিক দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার এবং গুপ্তহত্যাসহ হত্যাকা-ের পরিসংখ্যান সংবলিত রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। সেগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিতও হয়। এজন্যই সম্ভবত: সরকারের পক্ষে নীরবে বসে থাকা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে আমরা কিন্তু মনে করি, মাহমুদুর রহমান থেকে এডভোকেট আদিলুর রহমান খান পর্যন্ত পত্রিকা সম্পাদক, মানবাধিকার সংগঠনের নেতা এবং সাংবাদিকদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করার এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালানোর মাধ্যমে সরকারের জন্য শুভ কিছু অর্জন করার মত নেই। এভাবে বরং গণতন্ত্র এবং তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেই বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। দেশে-বিদেশেও ঘটছে প্রতিক্রিয়া। আমরা তাই মনে করি, সব মিলিয়েই সরকারের উচিত অবিলম্বে ‘অধিকার’ সম্পাদকসহ সকল রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেয়া এবং দায়ের করা এধরনের সকল মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads