সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৩

সংলাপের আহ্বান গণআকাঙ্ক্ষারই


বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে গত শুক্রবার জাতিসংঘ মহাসচিব বানকি মুন  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন। আলাপের সময় তিনি শুধু নিজের উদ্বেগের কথা জানাননি সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোরও পরামর্শ ও তাগিদ দিয়েছেন। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, দুই নেত্রীকে বানকি মুন বলেছেন, জাতিসংঘ রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। এজন্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে প্রধান দুই দলের মধ্যে আলোচনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, নিজে সরাসরি এবারই প্রথম কথা বললেও বেশ কিছুদিন ধরেই বানকি মুন সমঝোতার জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। গত জুন মাসে জাতিসংঘের অতিরিক্ত মহাসচিব (রাজনৈতিক) ফার্নান্দোজ তারানকোর মাধ্যমে দুই নেত্রীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতেও মহাসচিব সংলাপে বসার এবং সমঝোতায় পৌঁছানোর একই আহবান জানিয়েছিলেন। তার এই আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের উদ্যোগে ঢাকায় প্রধান দুই দলের নেতৃবৃন্দসহ রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু প্রধানত ক্ষমতাসীনদের কঠোর মনোভাব এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্যের পরিণতিতে সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে গেছে। এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকায় এবং নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার কারণেই শেষ পর্যন্ত বানকি মুন নিজেই দুই নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সংলাপ আয়োজন এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আবারও উদ্যোগ নেয়া হবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের এ উদ্যোগকে সকল দলই স্বাগত জানিয়েছে এবং যথার্থ ও সময়োচিত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এটাই অবশ্য প্রত্যাশিত ছিল। বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, বানকি মুন সঠিকভাবেই সংকটের মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন। এজন্যই তিনি বলেছেন, সমঝোতা দরকার নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে। তিনি একই সঙ্গে এ সত্যও অনুধাবন করেছেন যে, রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে হলে সিদ্ধান্ত আসতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে। বানকি মুন নিশ্চয়ই জানেন, দুই প্রধান নেত্রীর মধ্যে মুখ দেখাদেখি এবং কথাবার্তা পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। কথা শুধু এটুকুই নয়। সংকট কাটিয়ে ওঠার যে কোনো চেষ্টা যাতে সহজে সফল হতে পারে সেজন্য বেগম খালেদা জিয়ার দিক থেকে নামসহ নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে অনেক আগেই ছাড় দেয়া হয়েছে। তিনি বলে রেখেছেন, ওই সরকারের নাম তত্ত্বাবধায়ক বা অন্য যে কোনো কিছু হতে পারে কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারকে অবশ্যই দলনিরপেক্ষ হতে হবে। অন্তত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত কোনো সরকারের অধীনে আয়োজিত কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন না। তেমন কোনো নির্বাচন দেশে হতেও দেয়া হবে না। হঠাৎ শুনতে কঠোর মনে হলেও আমরা কিন্তু খালেদা জিয়ার দেয়া ছাড়কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। উচ্চ আদালতের বিতর্কিত ও বিভক্ত একটি রায়ের একটি মাত্র অংশের ভিত্তিতে সংবিধান থেকে বাতিল করা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুরোপুরি পুনর্বহালের দাবি জানানোর পরিবর্তে যে কোনো নামে নির্দলীয় সরকারের কথা বলার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া প্রকৃতপক্ষে সমঝোতার দরোজা খুলে দিয়েছেন। গণতন্ত্রের ব্যাপারে সততা ও সদিচ্ছা থাকলে ক্ষমতাসীনরা অবশ্যই এ সুযোগটুকুকে কাজে লাগাতেন। অন্যদিকে বিরোধী দলকে তারা শুধু আক্রমণই করে বেড়াচ্ছেন না, প্রধানমন্ত্রী একথা পর্যন্ত বলে বসেছেন যে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে তিনি সংবিধান থেকে ‘এক চুল’ও নড়বেন না। বলা বাহুল্য, এর মধ্য দিয়ে আর যা-ই হোক, সমঝোতামুখী সামান্য ইচ্ছারও প্রকাশ ঘটেনি। সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে এই কঠোর মনোভাব ও অবস্থানের কারণে। পাশাপাশি আক্রমণাত্মক ও উস্কানিমূলক কথাবার্তা তো রয়েছেই। মূলত এজন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের পক্ষে নেয়া সমঝোতার চেষ্টা সফল হতে পারেনি। সর্বশেষ ক্ষেত্রে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসানোর ব্যাপারে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুনের উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণাও মানুষের মনে আশাবাদের সৃষ্টি করতে পারেনি। এতকিছু সত্ত্বেও বানকি মুনের টেলিফোন এবং সমঝোতার আহ্বান মানুষকে একটি কারণেই আগ্রহী ও কৌতূহলী করে তুলেছে। সে কারণটি হলো, তিনি জাতিসংঘের মহাসচিবÑ যে সংস্থাটির সঙ্গে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিপুল দায়বদ্ধতা রয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিমিশনে সুযোগ পাওয়া-না পাওয়ার মতো বিশেষ কোনো প্রসঙ্গের উল্লেখ না করেও বলা যায়, বানকি মুনের উদ্যোগ ও পরামর্শকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার পরিণতি দেশের জন্য তো বটেই, দুই নেত্রীর জন্যও শুভ হতে পারে না। মূলত এই একটি কারণেই দুই নেত্রী ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন বলে অনুমান করা যায়। দু’জনের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়া আগেই ছাড় দিয়ে রেখেছেন বলে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়াকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমরা আশা করতে চাই, জাতিসংঘের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী সকল মহলের আহ্বান ও পরামর্শের প্রতি তিনি সম্মান দেখাবেন এবং সংঘাত এড়িয়ে দেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটাবেন। আমরা এও মনে করি, সমঝোতার আহ্বান জানিয়ে বানকি মুন আসলে গণআকাক্সক্ষারই প্রতিধ্বনি করেছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads