বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৩

বাতিঘর নিজেই এখন আলোহীন


আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্র বিবেচনায় আনলে নিজেদের মানুষ ভাবতে লজ্জা হয়। নষ্ট সমাজে ভষ্ট মেয়েরা যখন বাবা-মাকে খুন করছে তখন আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা পশুহাটের ইজারা নিতে ব্যস্ত হয়েছে অস্ত্রের মহড়ায়। এরপরেও কি আমাদের মেনে নিতে হবে যে, মানুষের সমাজে আমরা বসবাস করছি? অধঃপতিত এমন সমাজের রাজনীতি ও সমাজনীতি দিয়ে কাক্সিক্ষত জীবন ও সমাজ অর্জন সম্ভব কী? রাজনীতি বলি, অর্থনীতি বলি, এসব বিষয় তখনই ফলপ্রসূ হয় যখন এসবের পিছনে থাকে প্রকৃত মানুষ। আমরা আমাদের বর্তমান সময়ের সংকট নিয়ে নানা কথা বলি, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করি, কিন্তু মূল বিষয়টি এড়িয়ে যাই। ফলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সমস্যার কথা, সংকটের কথা সবাই বলতে পারে, তবে সমাধানটাই আসল। কিন্তু সে সমাধানের পথে তো আমরা এগুচ্ছি না। মানুষের সমস্যার সমাধান করতে পারে মানুষই। কিন্তু তেমন মানুষের দেখা তো মিলছে না। এ কারণেই হয়তো দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে কবি উচ্চারণ করেন, ‘মানুষের মাথা মানুষে খায় অথচ মানব এখানে নেই’। আমাদের গৃহে, বিদ্যালয়ে, সমাজে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন মানুষ গড়ার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে তখনই হয়তো আমরা কাক্সিক্ষত সমাজ বিনির্মাণের পথে অগ্রসর হতে পারবো। এর অন্যথা হলে আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি সবই ব্যস্ত থাকবে ছলনার পাশা খেলায়।
ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা পশুহাটের ইজারা নিতে অস্ত্রের মহড়া চালান! এমন কর্মে যারা জড়িয়ে পড়েন তাদের কি পশুর চাইতে ব্যতিক্রম কিছু ভাবা যায়? আমরা এতটাই স্থূল হয়ে পড়েছি যে, কোনো বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছি। কোরবানিকে কেন্দ্র করে এই যে পশুহাট, তাকি শুধুই অর্থ উপার্জনের লালসায় পঙ্কিল হবে, নাকি কোরবানির সাথে সম্পৃক্ত যে ত্যাগের মহিমা তারও কিছু প্রতিফলন ঘটবে?
কোরবানী ঈদের সাথে তো হযরত ইবরাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ) এর ত্যাগের ইতিহাস জড়িত। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পিতা প্রিয় পুত্রকে কুরবানি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পুত্র ইসমাইলও আল্লাহর ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে কুরবানি হতে রাজি হলেন। ত্যাগের এমন মহিমা কি আমাদের জন্য কোনো অনুপ্রেরণা যোগাতে সক্ষম নয়? কোরবানির পশুহাট ইজারা নিয়ে রাজনৈতিক দলের যেসব নেতা-কর্মীর অস্ত্রের মহড়া চালান তারা কি ইতিহাসের এ ঘটনা সম্পর্কে অবগত নন? আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষ নেতারা কি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের শিক্ষাদীক্ষা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রশিক্ষণকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করেন না? মনে করলে হয়তো পশুহাট ইজারা নিয়ে আমাদের অস্ত্রের মহড়া দেখতে হতো না।
দৈনিক আমাদের সময়ের ২১ আগস্ট সংখ্যার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানী ঢাকার ১৯টি কোরবানির পশুহাটের ইজারা নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা। এই নিয়ে দৌড়ঝাঁপের পাশাপাশি চলছে পেশীশক্তি প্রদর্শনের মহড়াও। গত ২০ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (নগর ভবন) আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সকাল থেকেই মহড়া দেখিয়েছে। তারা একজন কর্মচারীর মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে হুমকি দিয়েছে বলেও জানা গেছে। একই মহড়া চলছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেও। ২০ আগস্ট বিকেলে হাজারিবাগের মাঠ ইজারা নিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুল হক বাবু ও হাজারিবাগ যুবলীগ নেতা এ কে এম আজাদ সম্পত্তি বিভাগের কর্মচারী মহাদেবকে তার অফিস কক্ষে আটক করে রাখেন। এ সময়ে তারা মহাদেবের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে জানতে  চান, তাদের না জানিয়ে কেন হাটের সিডিউল বিক্রি করা হয়েছে? খবর পেয়ে নিরাপত্তা কর্মকর্তা মহসিন মোড়ল নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়ে সেখানে ছুটে যন এবং আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ কর্মীদের শান্ত করেন। তবে ঘটনার ব্যাপারে কোনো মামলা বা জিডি করা হয়নি বলে জানান মহাদেব।
এভাবে অস্ত্রের দাপট ও প্রশাসনের প্রশ্রয়ে আমাদের সমাজে চলছে শাসকদলের দৌরাত্ম্য। এমন সংস্কৃতি চলমান থাকলে কোনো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সুশাসনের বদলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে আমাদের প্রগতি থমকে গেছে। আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক উন্নতি সব কিছুই এখন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে স্থবির হয়ে আছে। এমনকি কিশোর অপরাধের মতো বিষয়টিও আমাদের সরকার ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। যার যা কাজ, তা না করার কারণেই আজ দেশের এই হাল হয়েছে। প্রশাসন তো কোনো দলের নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থেই তাদের কাজ করার কথা। কিন্তু প্রশাসনকে যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে এবং দলের স্বার্থে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে আসল কাজই এখন প-। নয় তো প্রশাসনের নাকের ডগায় মাদক ব্যবসা এতটা ব্যাপক আকার ধারণ করছে কিভাবে? মাদকাসক্ত হয়ে শত শত কিশোর-কিশোরীর জীবন এখন বিপর্যয়ের মুখে। খুন-খারাবির মত ঘটনাও ঘটে চলেছে এই মাদককে কেন্দ্র করে। ঐশী যার বড় প্রমাণ। ঐশীর ঘটনা আমাদের সমাজের জন্য এখন এক বড় প্রশ্ন। আমরা আমাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করেই যেন নিজেদের দায়িত্ব শেষ করতে চাই। বিদ্যালয়ে ভর্তি করলেই যে সন্তানরা মানুষ হয়ে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? অসৎ সঙ্গ কিশোর-কিশোরীদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার করুণ উদাহরণ ঐশী। অসৎ সঙ্গ পড়ার টেবিল থেকে তাকে টেনে নিয়ে গেছে রাজধানীর অভিজাত পল্লীর ডিসকো বার এবং হেরোইন-ইয়াবার জগতে। ঐশী গত ২ বছর ধরে লেখাপড়া বাদ দিয়ে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে হেরোইন, ইয়াবা সেবন ও ঢাকার ডিজে পার্টি এবং ডিসকো বারে সময় কাটাতো। বাবা-মা খুন হয়ে যাওয়ার পরও শনিবার রাতে তার গুলশানের একটি ডিসকো বারে যাওয়ার কথা ছিল বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। আদরের সন্তান ঐশীকে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন থেকে ফিরিয়ে আনতে অনেক চেষ্টা করেন মা এবং বাবা। কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই বিফলে যায়। অবশেষে বাধ্য হয়ে মেয়েকে ঘর থেকে বের হওয়ার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেন তারা। এর খেসারত হিসেবেই স্বস্ত্রীক জীবন দিতে হলো পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানকে।
বাবা-মাকে খুনের দায়ে ভ্রষ্ট মেয়ে ঐশীর বিরুদ্ধে সবাই এখন ঘৃণা প্রকাশ করছে। কিন্তু প্রাণ চঞ্চল এই কিশোরীর এমন অধঃপতনের দায় কি একা শুধু তারই? সেতো কোনো অন্ধকার সমাজে বাস করতো না। আলো ঝলমলে এ রাজধানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সে ‘ও’ লেভেলে পড়তো। সে বসবাস করতো একটি শিক্ষিত পরিবারে। তারপরও এ কিশোরী বয়সে সে কি করে হেরোইন ও ইয়াবার জগতে প্রবেশ করলো? কোনো অশিক্ষিত জাহেল তাকে এ পথে নিয়ে যায়নি। ঐশীকে এ পথে নিয়ে গেছে তার আধুনিক বয়ফ্রেন্ডরা। রাজধানীর অভিজাত পল্লীর ডিসকো বার ও ডিজে পার্টি তাকে উন্মাতাল করতে বিশেষভাবে প্রণোদনা দিয়েছে। শুধু এক ঐশী নয়, উচ্ছৃঙ্খল এ পথে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে আরো বহু কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অভিজাত পল্লীর এসব ডিসকো বার ও ডিজে পার্টি সম্পর্কে আমাদের প্রশাসন ও সমাজপতিরা কি অবহিত নন? এ ব্যাপারে তো আমাদের রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও পুলিশ বাহিনীকে তেমন সরব হতে দেখছি না।
আমাদের কিশোর-কিশোরী ও যুব সমাজকে অসৎ সঙ্গ ও অসৎ পরিবেশ থেকে রক্ষার ব্যাপারে তো অভিভাবকদের বাইরেও সমাজ ও প্রশাসনের দায়িত্ব রয়েছে। তাই বখে যাওয়ার জন্য শুধু ঐশী একা দায়ী নয়। নিজ নিজ জায়গায় আরো অনেকেই তাদের দায় এড়াতে পারেন না। ঐশী তো একদিনে ভ্রষ্ট হয়নি। হেরোইন, ইয়াবা ও ডিজে পার্টি পর্যন্ত পৌঁছতে তার অনেক সময় লেগেছে। ‘ও’ লেভেল পর্যন্ত বেড়ে ওঠার এই সময়টায় পরিবার, স্কুল, সমাজ ও রাষ্ট্র তার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে ঐশীকে আজ হয়তো ভ্রষ্ট মেয়ে হিসেবে পরিচিত হতে হতো না। আমরা জানি, শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠার জন্য নির্মল আনন্দ-বিনোদন খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু আমাদের পরিবার, স্কুল, সমাজ ও রাষ্ট্র কি শিশু-কিশোরদের জন্য কাঙ্খিত বিনোদনের ব্যবস্থা করতে পেরেছে? অসৎ সঙ্গ ও অসৎ পরিবেশ থেকে রক্ষার জন্য যে নৈতিক শিক্ষা ও মেরুদ- প্রয়োজন, দেশের শিক্ষা কারিকুলাম কি আমাদের শিশু-কিশোরদের তা দিতে সমর্থ হয়েছে? শিশু-কিশোরদের বিনোদন চাহিদা মেটাতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো ব্যর্থ হওয়ায় শিশু-কিশোর ও তরুণরা এখন গভীর রাত পর্যন্ত জেগে দেখে বিভিন্ন হিন্দি ও ইংরেজি চ্যানেল। ঐসব চ্যানেলে তো অশ্লীল ও ক্রাইম ছবি বা সিরিয়ালের কোনো অভাব নেই। আর মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমও এখন এতটাই অবারিত হয়ে গেছে যে, তার মন্দ ব্যবহার আমাদের কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীর জীবনে বিষফল বয়ে আনছে। তাই আজ ভ্রষ্ট মেয়ে হিসেবে শুধু ঐশীকে নিন্দাবাদ করলে চলবে না, আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের দায়িত্বও উপলব্ধি করতে হবে অভিভাবক, স্কুল, সমাজ এবং রাষ্ট্রকেও। সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করলে হয়তো বখে যাওয়ার হাত থেকে আমরা ভবিষ্যতে রক্ষা করতে পারবো বহু ঐশীকে। তবে এর জন্য প্রথমেই আমাদের রাজনীতিতে আনতে হবে গুণগত পরিবর্তন। দুর্বৃত্তায়ন থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে না পারলে আমাদের সব আশাবাদই উড়ে যাবে কর্পুরের মত। কারণ রাজনীতির বাতিঘর খুব সহজেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বাতিঘর এখন নিজেই আলোহীন। বাতিঘরে আলো জ্বালাতে ব্যর্থ হলে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে আমাদের রাজনীতিবিদদের। বিষয়টি উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads