রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৩

ঝোলেঝালে ইলিশ আর পিঁয়াজের গল্প


জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখার দু’এক স্থানে ইলিশ মাছের উল্লেখ থাকলেও কবিতায় ইলিশের তেমন উপস্থিতি নেই। পদ্মা এবং পদ্মার ঢেউ নিয়ে তার বিখ্যাত গান আছে। কিন্তু পদ্মার ঢেউয়ের বাঁকে বাঁকে যে রূপালী ইলিশের ঝাঁক সাঁতার কাটে সে ব্যাপারে তাকে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। নজরুল বাংলাদেশী দুজন রমণীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেও শ্বশুরালয়ে ইলিশ মাছ দিয়ে রসনা তৃপ্ত করেছিলেন কিনা তার তেমন কোন সন্ধান নজরুল গবেষকরা উল্লেখ করেননি। রবীন্দ্রকাব্যেও ইলিশের তেমন দাপাদাপি নেই। যদিও তিনি  যে জলযানে নদীনালা ঘুরে বেড়িয়েছেন তার নাম ছিল ‘পদ্মা’। ইলিশের মূল খনি হলো পদ্মা নদী। রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি এবং জমিদারীও ছিল বাংলাদেশে। তাকেও কেউ ইলিশ মাছের ব্যঞ্জন দিয়ে আপ্যায়িত করেনি এমন তো হতে পারে না। বোধহয় ইলিশ মাছের স্বাদ তাকে তৃপ্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে জন্যে তার সাহিত্যে ইলিশের আনাগোনা তেমনভাবে উঠে আসেনি। কবি ঈশ্বরগুপ্তের ‘তপসে’ মাছ নিয়ে কবিতা আছে। কবি জসীম উদ্দীন তার কবিতায় ডানকানা মাছের উল্লেখ করেছেন। কবি ফররুখ আহমদ কবিতা লিখেছেন ইলশেগুঁড়ি নিয়ে। তবে ইলিশ মাছ নিয়ে সার্থক কবিতা একমাত্র বুদ্ধদেব বসুর। তিনি ইলিশকে বলেছেন ‘জলের রূপালী শস্য’। তাই দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়, ইলিশ বাংলা সাহিত্যের একটি প্রধান অনুসঙ্গ। অতীতেও ছিল বর্তমানেও ইলিশ বাণিজ্যের অনুসঙ্গও বটে। কিন্তু ইদানীং ইলিশের সাথে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। যাকে বলা যায় ‘মনকষাকষি’। এই মনকষাকষি অবশেষে  কলম ঘষাঘষি পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। প্রতিবেশী ভারতীয়রা ইলিশবিহনে গোস্যা করেছেন। এই গোস্যার তারা বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন পিঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়ে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নাকি উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, বাংলাদেশের ইলিশ না পেলে তারা বাংলাদেশকে পিঁয়াজ দেবেন না। এরকমই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সে দেশের পত্রিকা ‘হিন্দুস্তান টাইমস্’ এটি হবে নাকি ‘চোখের বদলে চোখের’ মত প্রতিশোধ। স্মরণযোগ্য বাংলাদেশ ভারতে ইলিশ মাছ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে কয়েক বছর আগ থেকেই। কারণ যে হারে ইলিশ ধরা পড়ছে তাতে করে নিজেদের প্রয়োজন মিটানোই দায় হচ্ছে। তাই অন্যকে দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। অতিরিক্ত থাকলে তবেতো ইয়ার-দোস্তদের মধ্যে বিলি করা শোভা পায়। তাছাড়া বাংলাদেশের নদীতে বিশেষ করে পদ্মা- মেঘনায় ইলিশ আগের মতো ধরা পড়ছে না। পড়বে কি করে। দিন দিন বাংলাদেশের নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এজন্য দায়ী তো ভারতীয়রাই। তারাইতো উজানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখছে। ইলিশের স্বাদ ভুলতে পারবেন না, আবার যে পানি ইলিশের প্রাণ তাকেও বাধাগ্রস্ত করবেন এ কেমন আচরণ। একসময় যে গোয়ালন্দ পানিতে থৈ থৈ করত, পানিবিহনে সে এলাকা বর্তমানে ধূ ধূ মরুপ্রান্তর। এই গোয়ালন্দ ঘাটেই ইলিশের স্তূপ দেখে কবি বুদ্ধদেব বসু ইলিশ সংক্রান্ত তার বিখ্যাত কবিতাটি লিখেছিলেন। কবি নজরুলও তার বিখ্যাত গান ‘পদ্মার ঢেউরে’ রচনা করেছিলেন সেই একই জায়গায় স্টিমারে ভাসার সময়। সেই ঢেউ এখন বাধাগ্রস্ত ভারতীয়দের দস্যুপনায়। এ ব্যাপারে ভারতীয় ব্যবসায়ী বা হিন্দুস্তান টাইমসের কি জবাব আছে।  ইলিশ চাই, ইলিশ দিতে কোন আপত্তি নাই কিন্তু এর আগে পিঁয়াজ নয় পানি চাই, ন্যায্য পানি। যে পানিতে ইলিশ সাঁতার কাটতে পারবে অবাধে।
আহাম্মক আর কাকে বলা যায়। ইলিশের সাথে পিঁয়াজের তুলনা। হ্যাঁ। পিঁয়াজ ছাড়া হয়তো ইলিশের স্বাদ কিছুটা নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। তবে ভারত ব্যতীত পিঁয়াজ পাওয়া যাবে না এমন তো নয়। ইতোমধ্যে মিয়ানমার থেকে পিঁয়াজ চলে এসেছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকেও পিঁয়াজ আমদানি করা তেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। বাংলাদেশে পিঁয়াজের যা ফলন চাহিদার তুলনায় খুব সামান্যই ঘাটতি থাকে। ফলন বৃদ্ধিতে মনোযোগী হলে হয়তো এ ঘাটতি সামাল দেয়া যাবে বৈ কি। কিন্তু ইলিশ একান্তই বাংলাদেশের, বিশেষ করে পদ্মার ইলিশ। যে কারণে ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এ মাছ চীন, জাপান মার্কিন মুল্লুক থেকে আমদানি করা যাবে না। বলা যায় ইলিশ মাছ বাংলাদেশীদের জন্য আল্লাহর খাস নিয়ামত। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। যে কারণে ইলিশের গুণ বর্ণনায় কবি-সাহিত্যিকরাও উদগ্রীব। ইলিশের ঝলমলে রঙ কাকে না আকৃষ্ট করে। রসনা তৃপ্তির ব্যাপারটিতো আছেই। কিন্তু পিঁয়াজের সাথে যারা ইলিশকে টেনে আনতে চায় সেই মনুষ্যজনদের ‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধী’ ব্যতিরেকে আর কি শব্দে চিহ্নিত করা যাবে।
পিঁয়াজের অভাবে হঠাৎ করে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। আসলে পেঁয়াজ নাই তা নয়। অসাধু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা এ জন্যে দায়ী। পিঁয়াজ গুদামজাত করে কৃত্রিম অভাবের সৃষ্টি করেছে। এসব অসাধু ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনলেই পিঁয়াজের ঝাঁঝ চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। একটি সুবিধাজনক বিষয় হলো পিঁয়াজ বেশি সময় ধরে রাখা মুশকিল, পচন ধরে। তাই কেউ দিল কি না দিল এমন হুমকি ধমকি তেমন কোন কাজে আসবে না। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যদি সত্যি সত্যি পিঁয়াজ আর ইলিশকে এক পাল্লায় তুলে মাপতে চান তা দিবস রজনী মাপতে পারেন। তাতে নিজেদের চোখের পানিই ঝরবে পিঁয়াজের ঝাঁঝে। এরপরও কিন্তু কলকাতার বাজারে ইলিশ লাফাবে না। সরষে ইলিশের সুস্বাদু গন্ধে রন্ধনশালা মউ মউ করাতো দূরের কথা।
ঢাকার বাজারেও ইদানীং ইলিশের বড়বেশি অভাব। যে জন্যে দাম চড়া। ইলিশ ধরা পড়ছে কম এ খবরটি যেমন সত্য আবার যাওবা ধরা পড়ছে তাও নাকি চোরাকারবারীরা সমুদ্রেই পাচার করে দিচ্ছে ভারত-মিয়ানমারে। যে জন্যে বাংলাদেশের বাজারে ইলিশের ঘাটতি। চোরাকারবার রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ দরকার। ইলিশের দেশে ইলিশ পাওয়া যাবে না এমন সংবাদ যেমন দুঃখের, লজ্জারও বটে। একদিকে গোপনে ইলিশ পাচার হচ্ছে ভিনদেশে অন্যদিকে জাটকা নিধন করে রোধ করা হচ্ছে ইলিশের বংশ বৃদ্ধি। বাজারে প্রচুর জাটকা বিক্রি করতে দেখা যায়। ইলিশের বাচ্চা নিধন আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও এ আইনের উল্লেখ যেন আইনের বইয়েই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর দেখা মিলে না। এই বাচ্চা ইলিশগুলোকে বড় হবার সুযোগ দিলে ইলিশের ঘাটতি কমিয়ে আনা যেত হয়তোবা। তাই এই বিষয়গুলোর প্রতি তীক্ষè নজর থাকা প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের, মৎস্য বিভাগের। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা পিঁয়াজ আটকে রেখে তারা বাংলাদেশের ইলিশ প্রত্যাশা করছেন। এটা নাকি তাদের প্রতিশোধ, বাংলাদেশীদের প্রতি। কারণ তারা ইলিশ পাচ্ছেন না। ইলিশের স্বাদে-গন্ধে এরা রসনা তৃপ্ত থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আফসোসের কথাই বটে। প্রত্যাশা করা অন্যায় নয়। কিন্তু সে প্রত্যাশায় কতটা যুক্তি আছে তাও দেখার বিষয়। একেতো পেঁয়াজের সাথে ইলিশের তুলনা উন্মাদেরাই দিতে পারে। কারণ পিঁয়াজ এমন কোন মহার্ঘ বস্তু নয়, বিপরীতে ইলিশ বহুকাল থেকেই দুর্লভের তালিকায়। চোখের বদলে যারা চোখ নিতে চাইছে-প্রকৃত প্রস্তাবে এরা নিজেরাই অন্ধের ভান করছে। ইলিশের স্বাদ চাখতে চাইলে আগে পানির ব্যবস্থা করতে হবে। পানির স্বাভাবিক গতিকে রোধ করা যাবে না, এ বিষয়ে বলিষ্ঠ আওয়াজ তুলতে হবে। কারণ ইলিশ মাছের প্রাণ হলো পানি। সেই পানিকে আটকে দিয়ে ভারতীয়রা বাংলাদেশের সব নদীকে মৃতপ্রায় করে তুলেছে। ইতোমধ্যে মরেও গেছে বেশ কয়েকটি। পানি না থাকলে ইলিশ কেন কোন মাছইতো পাওয়া যাবে না। পিঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেবার আগে এদিকটি বিবেচনায় আনার প্রয়োজন বড়বেশি। ভারতের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী এবং হিন্দুস্তান টাইমস অন্যের চোখের ব্যাপারে চিন্তার পূর্বে নিজেদের চোখের বিষয়ে সাবধান হওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়!
যুগসন্ধিক্ষণের কবি ভারত চন্দ্র হয়তো তখনি বুঝেছিলেন তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরা পানি আটকে দিয়ে বাংলাদেশের সব নদী-নালা ধ্বংস করে দেবে। তখন আর মাছে ভাতে বাঙালি এমন প্রবাদটি মিথ্যা প্রমাণিত হবে। কারণ একদিন মাছ মহার্ঘ হয়ে যাবে। হয়তো এ জন্যেই কবি তার অনাগত সন্তানদের উদ্দেশে বলে গেছেন ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads