শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৩

আদিল এখন সরকারের গলায় কাঁটা


আমাদের দেশের প্রচলিত রাজনীতি হলো ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতা দখলের। যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা চায় ক্ষমতায় বহাল থাকতে এবং পুনরায় ক্ষমতায় আসতে। এই জন্য ক্ষমতাসীন দল মরিয়া হয়ে সংগ্রামে ব্যস্ত থাকে ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার জন্য। পক্ষান্তরে বিরোধী দল চায় যে কোন প্রকারে ক্ষমতা দখল করতে। যেকারণে বিরোধী দল ইতঃপূর্বে চালু থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করার কৌশল গ্রহণ করেছে। সরকার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত নয় পুনরায় ক্ষমতায় আসার জন্যে সংবিধানকে সংশোধন করে এমন নিñিদ্র করেছে যে, নির্বাচন না দিয়েও ক্ষমতায় থাকার পাকাপোক্ত বিধানের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তারই ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন যে, সংবিধানে কোন ফাঁকফোকরও রাখা হয়নি। অর্থাৎ নির্বাচন না দিয়েও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বহাল থাকার ব্যবস্থা নিñিদ্র ও নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ লক্ষীন্দরের বাসর ঘর যেমন নিñিদ্র ব্যবস্থা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে লক্ষীন্দরের নিñিদ্র বাসর ঘরের মতোই ফাঁকফোকর বিহীন ব্যবস্থা করেছে; লক্ষীন্দরের বাসর ঘরে বসেই শেখ হাসিনা দেশ চালাবেন। সেই নিñিদ্র ব্যবস্থার কথা আওয়ামী লীগ নেতারা সময় সময় জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন। সর্বশেষ স্মরণ করিয়ে দিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম। যাহোক এব্যাপারে বারান্তরে আরেকটি আইটেম লেখার ইচ্ছা রইল।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আরেকটি কনসেপ্ট চালু হয়েছে। জনগণের দৃষ্টি ফিরানোর রাজনীতি। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজী, হত্যা, গুম, খুন-খারাবী, অস্ত্রবাজি, দেখামাত্র গুলীর নির্দেশ, বিরোধী দল দলন, নিপীড়ন নির্যাতন, মানবাধিকার দলনের কারণে সরকার দেশে যেমন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তেমনি দেশের বাইরেও বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। ফলে সরকার এখন কৌশলী রাজনীতি তথা সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি ফিরানোর রাজনীতি শুরু করেছে।
গত ৫ই মে হেফাজতের ওপর ক্র্যাক ডাউন করে সরকার যে চরম বেকায়দায় পড়েছে তা থেকে জনগণের দৃষ্টি ফিরানোর জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। ২০০২ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৫ বছর পর অর্থাৎ ২০০৭ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। সেই নির্বাচন ২০১৩ সালে এসেও সরকার দিতে সাহস পাচ্ছে না। ঢাকাকে দুইভাগ করা হলো অন্তত: পক্ষে একটায় বিজয় ছিনিয়ে নিবে সরকার। তাতেও সাহস পাচ্ছে না তারা। সে কারণে সীমানা সমস্যা সৃষ্টি করে মামলা সাজিয়ে নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করছে। সর্বশেষ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে সব স্থানীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
অথচ কি আশ্চর্যের কথা রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশালেও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন মেয়াদপূর্ণ হওয়ার আগেই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হলো। শুধুমাত্র হেফাজতের ওপর হামলাজনিত সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি ফিরানোর জন্যই চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। সরকার চেয়েছিল অন্ততঃ দুইটার বিজয় তারা ছিনিয়ে নিবে। কিন্তু দেখা গেল সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি।
অবশেষে দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ গাজীপুরে মরিয়া চেষ্টা করেছিল বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার। হয়ে গেলো একেবারে বুমেরাং।
ফলাফল আওয়ামী লীগ অফিস এখন নেতাকর্মীশূন্য। রাজপথে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব নেই। হরতালের পর হরতাল চলছে। হরতাল ঠেকানোর মত আওয়ামী লীগ কর্মীদের সেই তেজ আর নেই। সবাই এখন আখের গোছাতে টেন্ডার কাবিখা নিয়ে ব্যস্ত। কারণ হয়তো বা এই সুযোগ জীবনে আর নাও আসতে পারে।
এতদসত্ত্বেও দৃষ্টি ফিরানোর রাজনীতি থেমে নেই। জনশ্রুতি ছিল ইহুদী মহিলা ক্রিস্টিনা ওবার মায়ার স্বামী জয়কে তালাক দেয়ার পর জয় গোপালগঞ্জের জনৈক ব্যবসায়ীর মেয়ে বিয়ে করেছে। সকলকে তাক লাগিয়ে সেই ইহুদী মহিলাকেই নিয়ে আসা হলো জয়ের স্ত্রী পরিচয়ে। যুবলীগের এক অনুষ্ঠানে জয় ঘোষণা করলো, “আমার কাছে খবর আছে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে।” অর্থাৎ যুবলীগ আবার লুটপাটের সুযোগ পাবে। এই তথ্যটি হালে পানি পায়নি। বরং কোন ফেসবুকে কি বলেছে এই ভয়ে জয় দেশ ছেড়ে আবার পাড়ি জমিয়েছে সুদূর আমেরিকা।
ঈদের পূর্বক্ষণে আসলো আরেক চমক। আওয়ামী লীগের কাল্পনিক সাফল্যের ফিরিস্তি দিয়ে সারা ঢাকা শহর ছেয়ে গেল বিলবোর্ডে।
তাতেও কাজ হলো না। ভীমরুলের মত ধরে ফেললো বিলবোর্ডকে জনতা থেকে মিডিয়া। বিলবোর্ড দলের ইমেজ সৃষ্টি করতে তো পারলোই না বরং বিরূপ সমালোচনার ঝড় তুলেছে বিলবোর্ড। রাতের অন্ধকারে আবার সরিয়ে নেয়া হলো সকল বিলবোর্ড। কোনভাবেই দলের ইমেজ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না।
কপালমন্দ অধিকারের। আওয়ামী লীগের দৃষ্টি ফিরানোর রাজনীতির খড়গ পড়লো গিয়ে অধিকারের ঘাড়ে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমানকে পলাতক আসামীর মত ওঁৎ পেতে থেকে গ্রেফতার করা হলো। ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে তাকে খুনের আসামীর মত রিমান্ডে নেয়া হলো। ভাগ্যিস হাইকোর্টের সম্বিৎ ফিরেছে। এর আগে হাইকোর্ট জলবৎ তরলং রিমান্ডকে অনুমোদন করতো কিন্তু এইবার আদিলুর রহমানের ক্ষেত্রে রিমান্ডকে না মঞ্জুর করেছে হাইকোর্ট। সরকারের দৃষ্টিতে আদিলুর রহমানের অপরাধ আদিল কেন ৫ মের হত্যাকা- সম্পর্কে তথ্য পরিবেশন করলো। আদিলের কাছ থেকে সরকার নিহতদের তথ্য জানতে চায়। জানতে পারলেই নিহতদের আত্মীয়-স্বজনের ওপর হামলা করার সুযোগ পাবে।  ৫ মে’র ঘটনার পর জেলা প্রশাসকরা মাদরাসার প্রিন্সিপালদের ডেকে নিয়ে সতর্ক করেছেন যেন  ৫ মে’র হতাকা- সম্পর্কে তারা মুখ না খোলেন। এদিকে আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী স্থানীয়ভাবে পাহারারত আছে যাতে কোন প্রিন্সিপাল শিক্ষক বা কোন অভিভাবক মুখ খুলতে না পারে। প্রিন্সিপাল, শিক্ষক, অভিভাবকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই অধিকার নিহতদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করছে না। তাছাড়া সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা তথ্য সূত্র প্রকাশ পেশার নীতির বিরুদ্ধ।
তারা স্পষ্ট জানিয়েও দিয়েছেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের কাছে তারা নাম ঠিকানা পরিবেশন করবে। প্রশ্ন হলো, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন করতে সরকার ভয় পাচ্ছে কেন। তাহলে ডালমে কুচ কালা হায়।
সরকারের ভাষ্য সেদিন কোন হত্যাকা- হয় নাই, কেহ নিহত হয় নাই। অপরাধ বিজ্ঞানের মতে, অপরাধী কোন না কোন আলামত রেখে যাবেই। ৬ মে সকালে যারা রাস্তায় নেমেছেন তারাই দেখেছেন রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট ” ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হত্যাকা-ের পর ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল করার পর ২৭ মার্চ সকালের রাস্তার চেহারা ২০১৩ সালের ৬ মে’র সকালের রাজপথের চেহারা ছিল অভিন্ন। সরকার নিজেরাই তো অপরাধের আলামত রেখেছেন। হত্যাকা-ের পূর্বক্ষণে সমগ্র মতিঝিলে বিদ্যুৎবিহীন করা হলো কেন? সাংবাদিকদের সরিয়ে দেয়া হলো কেন? অনেক ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়া হলো কেন? দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি বন্ধ করা হলো কেন? সরকার যদি এতই সাধু হবে তো এত রাখঢাক কেন?
৮০’র দশকে হজ্জ করতে গিয়ে ইরানী হজ্জযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে মার্কিন বিরোধী স্লোগান দিলে সৌদী নিরাপত্তা বাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে হুড়াহুড়িতে পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে চার শতাধিক লোক মারা যায়। বেশ কিছু দিন পূর্বে ভারতের কুতুব মিনার পরিদর্শনে গেলে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে ভয়ে-আতঙ্কে দৌড়াদৌড়িতে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে শতাধিক পর্যটক মারা যায়। গত ১৪ আগস্ট মিসরে লাখ লাখ লোকের সমাবেশে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী হামলা করলে পাঁচ শতাধিক লোকের মারা যাওয়ার কথা সরকারই স্বীকার করেছে।
৫ মে লাখ লাখ লোকের সমাবেশকে বিনা নোটিশে রাতের অন্ধকারে মাত্র দশ মিনিটে তাড়িয়ে দিলেন একটি লোক মারা গেল না, একটা লোক আহত হলো না, এ এক অবশ্বিাস্য ঘটনা। সরকার বাংলাদেশের মানুষকে বোকা মনে করছেন। তারা না হয় ডরে-ভয়ে নিরাপত্তার কারণে নির্বাক থাকলো কিন্তু বিশ্ববাসী তো আর বোকা নয়। সরকারের গোপনীয়তা রক্ষার কারণে ঘটনার ডালপালা মেলেছে। শত শত থেকে হাজার হাজার নিহতের প্রচার হয়েছে। নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি করলে অবশ্যই সত্য ঘটনা প্রকাশ পেত। সরকারি ভাষ্য মতে, ঘটনায় সাউ- গ্রেনেড, লেথাল উইপন্স ব্যবহার করা হয়েছে। দশ মিনিটের মধ্যে লাখ লাখ লোককে তাড়িয়ে দেয়া হলো একটা লোক নিহত বা আহত হলো না। আকাশ থেকে ফেরেশতা এসে লাখ লাখ লোককে তুলে নিয়ে গেল কি না।
আবার আসি আদিলের কাছে। আদিলের গ্রেফতারে শুধু থলের বিড়াল বের হয়ে পড়ে নাই সারা বিশ্বে তোলপাড় চলছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন গ্রেফতারের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আদিলের মুক্তি দাবি করেছে। আদিলুর রহমান শুভ্র এখন সরকারের গলায় কাঁটা। সরকার জনগণ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যত্র ফিরাতে গিয়ে জারীজুরি ফাঁস হয়ে বরং ধরা পড়ে গেল। পাঠক নিশ্চয়ই মনে আছে ৫ মে আসরের নামাযের পর শাপলা চত্বরে আলেম সমাজ এতিম ছাত্ররা যে মোনাজাত ধরেছিল সে মোনাজাতে শাপলা চত্বর কিংবা যারা টেলিভিশনের সামনে ছিল কারুর চোখ অশ্রুসিক্ত না হয়ে পারে নাই। সেই মোনাজাত আল্লাহ সোবহানা তা’আলার কাছে কবুল না হয়ে পারে না। নবী-রাসূলদের উত্তরসূরী আলেম সমাজ এবং এতিমদের মোনাজাত বিশেষ করে আসরের পর কবুল হয়ে থাকে। ঐ দিনের মোনাজাতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠার কথা। ঐ মোনাজাত কবুল না হয়ে পারে না। যার ফল ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads