মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০১৩

ঐশীর অধঃপাতে আমিও দায়ী


অক্সফোর্ড স্কুলের ও’লেভেলের ছাত্রী ১৭ বছরের ঐশী রহমান তার বাবা মাহফুজুর রহমান (৪৯) ও মা স্বপ্না রহমানকে গত ১৪ আগস্ট রাতে হত্যা করেছে। এই হত্যাকা- নিঃসন্দেহে নির্মম, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক। তবে বাবা-মাকে হত্যা করার ঘটনা এটাই নতুন নয়। এর আগেও যুগে যুগে স্বার্থের সংঘাতে কিংবা লাভের আশায় অথবা সাম্রাজ্যের লোভে বা নিতান্ত উন্মত্ত অবস্থায় বাবা মাকে হত্যা করার ঘটনা আছে। এখনও আমাদের গ্রামাঞ্চলে সম্পদের লোভে পিতামাতাকে হত্যা করার ঘটনা দু’চারটা যে ঘটে না, এমন নয়। কিন্তু সেসবকে আমরা খুব বেশি অস্বাভাবিক ঘটনা বলে চিহ্নিত করি না। যেন ভাবি, এরকম তো ঘটেই থাকে। এবং সত্যি সত্যি ঘটেই থাকে। সেটি ঘটে সাধারণত শিক্ষাবঞ্চিত পরিবারের ভেতর। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য পিতামাতাকে হত্যার ঘটনা পৃথিবীতে প্রচুর। তাহলে ঐশী যে তার বাবা-মাকে হত্যা করলো, একে আমরা লোমহর্ষক কেন বলছি?
লোমহর্ষক বলছি এই কারণে যে, মাহফুজুর রহমান পুলিশের এস.বি বিভাগের পরিদর্শক। তার একটিই কন্যা সন্তান। অতি যতেœ তার প্রায় সকল আবদার শুনে ধীরে ধীরে তাকে পরিণত বয়সের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মা স্বপ্না রহমান গৃহিণী ছিলেন। সংসারের ভেতরের দায়িত্ব তিনিই পালন করতেন। সে দায়িত্বও বিশাল। এতটুকু শিশু ঐশীকে পরম যতে তিনি ধীরে ধীরে বড় করে তুলেছেন। ছোট পরিবার। তাদের রয়েছে আর একটি পুত্রসন্তান। ঢাকার একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। এই পুরো পরিবারের একটি গ্রুপ ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রুপ ছবি যেমন হয় তাদের পাশে ঐশী ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে আছে। একেবারে সামনে ফুটফুটে ছোট ভাই ঐহী।
পুলিশের চাকরিকে আওয়ামী কুশাসনকালে আর কেউ ভাল চোখে দেখছে না। আমরা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, পুলিশ সরাসরি গুলী করে, ফুটফুটে টগবগে তরুণের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। শূন্য রাজপথে তার শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে রাজপথ লাল হয়ে গেছে। পুলিশকে আমরা দেখছি নির্বিচার গুলী করে শত শত মানুষকে হত্যা করছে। পুলিশ লক্ষ লক্ষ রাউন্ড গুলী ছুঁড়েছে শাপলা চত্বরে অবস্থানকারী মানুষদের উপর। তাদের দোষ, তারা আল্লাহ্ ও নবী করীম (সাঃ)-এর সম্মান রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। আমরা পুলিশকে দেখেছি সম্মানিত ব্যক্তিদের গায়ে হাত তুলতে তারা কুণ্ঠাবোধ করছে না। আমরা দেশব্যাপী পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্যের খবর প্রায় প্রতিদিনই পড়ি।
নিহত মাহফুজুর রহমান এ রকম নিন্দিত পুলিশ বাহিনীর সদস্য ছিলেন। কিন্তু তার হত্যাকা-ের পর বাংলাদেশে সম্ভবত কোনো মানুষই এমন কথা উচ্চারণ করেননি যে, পুলিশ খুন হয়েছে, বেশ হয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ পুলিশ মাহফুজুর রহমান ও তার গৃহিণী স্ত্রী স্বপ্না রহমানের জন্য শোকে বিধুর হয়েছে। মাহফুজুর রহমান যদি জনতাকে মারতে গিয়ে গণপিটুনিতে খুন হতেন, তাহলে এমন বেদনাবিধুর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। মাহফুজুর রহমান এখন আমাদের সমাজের ক্ষয়-প্রাপ্তির প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
এখানেও আশ্চর্য ঘটনা কিছুই নেই, তা কিন্তু নয়। পুলিশ মাহফুজুর রহমান এক মধ্যবিত্ত পরিবারই গড়ে তুলেছিলেন। কোথায়ও তিনি তার বৈধ-অবৈধ উপার্জনে বাড়িঘর করেছিলেন কিনা এমন খবর নিতে কেউই আগ্রহ প্রকাশ করেনি। এই মর্মন্তুদ হত্যাকা-ে বরং শোকযাত্রায় তার পাশেই দাঁড়িয়েছে। চামেলীবাগের যে বাসায় তিনি থাকতেন, সেটা ছিল ভাড়া বাসা। অন্যসব মধ্যবিত্তের মতোই ৪-৫ তারিখের মধ্যেই তাকে বাসা ভাড়া শোধ করে দিতে হতো। সম্পদ যদি তিনি গোপনে কিছু করেও থাকেন, তাও করেছিলেন প্রিয়তমা কন্যা ঐশী ও প্রিয় পুত্র ঐহীর জন্য। কিংবা তিনি অবিরাম চেষ্টা করছিলেন কিভাবে তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যায়। যেন আমার মতোই কোনো একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। আমরা কেবলই সন্তানের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণের চেষ্টা করি। কেউ কেউ পারি। কেউ কেউ হেরে যাই। হেরে গেলেন মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমান।
পুলিশ হলেও মাহফুজুর রহমান তার কন্যা ঐশীকে, কন্যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই রাজারবাগের আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। সেখানেও এই ঐশী মাথায় স্কার্ফ বেঁধে স্কুলে ক্লাস করেছে। পরম যতে মা স্বপ্না চুল আঁচড়ে স্কার্ফ বেঁধে সেফটিপিন লাগিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছেন। লক্ষ্য তো একটাই ছিল, আমার মেয়ে মানুষ হবে। কিন্তু ঐশী যত বড় হতে থাকলো, ততই কোথাকার যেন দূরাগত হাতছানি তাকে পেয়ে বসলো। এবং সে জেদ ধরলো আইডিয়াল স্কুলের এই শৃঙ্খলিত নিয়ম-নিগড় সে কিছুতেই মানবে না। সে ইংলিশ স্কুলে পড়বে। মাহফুজুর রহমান বা স্বপ্না যদি তার দাবি মেনে না নিতেন তাহলে এই সময়ে কী ফল হতো বলতে পারি না, কিন্তু পিতা-মাতা কন্যাস্নেহে তার সে দাবি মেনে নিয়েছিলেন। তাকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন ধানমন্ডি ২৭ নম্বরস্থ অক্সফোর্ড স্কুলে। সেখানে সে ও’লেভেলের ছাত্রী ছিল।
কিন্তু কী করলো ঐশী? সে নিতান্ত বালিকা ছিল না। বাংলাদেশের বয়সের হিসেবেও সে প্রায় যুবতী ছিল। আর এক বছর পরেই তার বয়স ১৮ হতো। কিংবা এখনই তার বয়স আঠারোর অধিক। সে আর অবোধ বালিকা নেই। কিন্তু কী করলো ঐশী! ঠা-া মাথায় সে বাবা-মাকে একসঙ্গে খুন করেছে। হঠাৎ করে যে খুন করতে পারবে না, সে ধারণা তার ছিল। আর তাই ঐশী (আহা, মা) দু’ধারী ছোরা জোগাড় করে এনে রেখেছিল। আর মৃত্যু হতে পারে এই পর্যায়ের ঘুমের বড়ি সংগ্রহ করে ঐশী তা গুঁড়ো করে রেখে দিয়েছিল।
তার মাকে সে রাতের খাওয়ার পর পরই এক কাপ কফি দিয়েছিল। কফি ছিল চেতনানাশক ঘুমের বড়িতে ভরপুর। ফলে মা ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন আগেই। কোনো কোনো পত্রিকা লিখেছে ঐশী তার বাবাকে ফোন করে আবদারের ঢংয়ে বলেছিল, বাবা, আজ তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। কন্যাস্নেহে পুলিশ পিতা মাহফুজুর রহমান দ্রুতই ফিরে এসেছিলেন। ঐশীর মা ঘুমিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ঐশীর বাবার খাওয়া-দাওয়ার দায় সেই নিয়েছিল। খাওয়া শেষে চেতনানাশকসহ এক কাপ কফি পিতার হাতে সে তুলে দিয়েছিল। প্রিয়তমা কন্যার রুমে বসেই পিতা সে বিষ পান করেছিলেন। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই কন্যার রুমেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তখন পিতৃ-মাতৃঘাতিনী ঐশী প্রথমে তার পিতার গলায় দু’ধারী ছোরা বিদ্ধ করে দেয়। তারপর বিদ্ধ করে স্নেহময় পিতার হৃদপি- বরাবর। পিতা মাহফুজ অচেতন হয়েছিলেন সদ্যই। ফলে দ্রুতই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মাতা অচেতন হয়েছিলেন বেশ আগেই। ফলে নেশার ঘোর তার সামান্য কেটে আসছিল। পিতাকে হত্যা করে ঐশী যখন মায়ের বুকে ছুরি বসিয়ে দিল, তখন তার মা স্বপ্না রহমান জেগে উঠেছিলেন। একবার চোখ খুলে ঐশীকে বলেছিলেন, তুমি আমাদের মেয়ে না? তারপর ঐশী মায়ের গলায় দুধারী ছোরা দ্রুতই বসিয়ে দেয়। এবং মায়ের সারা গায়ে অন্তত এগারোটি ছুরিকাঘাত করে।
নাহ্ ঐশী, তুমি আমাদের সন্তান। তুমি কেমন করে আমাকে হত্যা করো? তুমি কেমন করে তোমার পিতা বা মাতার গলায় খঞ্জর চালাও? ঐশী এখন এসব প্রশ্ন থেকে আড়ালে। খঞ্জর সে চালিয়েছে এবং পিতামাতাকে একযোগে হত্যা করেছে। কেন করেছে কাহিনীটা সেখানেই।
ঐশী যখন আইডিয়াল স্কুলের নিয়মশৃঙ্খলা মানতে চাইলো না, তখন স্নেহময় বাবা-মা তার দাবি মেনে নিয়ে তাকে ধানমন্ডির অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। তারপর সে পড়লো অসৎ-সঙ্গে। ফেরা শুরু করলো গভীর রাতে। কখনও ঢুলু ঢুলু। কখনও অসংলগ্ন। হেরোইন-ইয়াবার নেশায় সে বুঁদ হয়ে গেল। ও’লেভেলের ছাত্রী। প্রতিদিন তো আর মা সঙ্গে আসতে পারে না। বাবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। ছোট ভাইয়ের স্কুল নিয়ে মাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তার উপর আছে রান্নাবান্না। সব মিলিয়ে ঐশীর স্বাধীনতা বেড়ে গিয়েছিল। এই স্বাধীনতা কী নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার ছিল? এখনকার তরুণ প্রজন্ম সম্ভবত বলবে, কোনো দরকার নেই। ঐশী একা নষ্ট হয়েছে। আমরা সবাই তো আর নষ্ট হইনি।
কিন্তু মাত্র ১৭ বছরের ঐশী মাস দুই থেকে গৃহে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তার বাইরে যাওয়া বারণ। কোনো কোনো কাগজ লিখেছে তার হাত খরচের জন্য তার বাবা মাসে লক্ষাধিক টাকা খরচ করতেন। কিন্তু তিনিও খতিয়ে দেখেননি যে, এই বিপুল অংকের টাকা কী হিসাবে তিনি তাকে দিচ্ছেন। আর এই টাকায় ঐশী হেরোইন-ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সন্তান হেরোইন-ইয়াবায় আসক্ত, এটা কি কোনো অভিভাবক মেনে নিতে পারবেন? আমার বিবেচনায় অসম্ভব। তারা যখন দেখলেন, তাদের মেয়ে স্কুলের নামে হেরোইন-ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছে, তখন তাকে তারা খানিকটা বন্দীই করে ফেললেন। সম্ভবত তার মা স্বপ্না রহমানই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রথম শত্রু। কারণ বাসার যুবতী মেয়ে কোনো ছেলে বন্ধুকে নিয়ে এসে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করলে কোনো মা কি তা কিছুতে মেনে নিতে পারবেন? মা মেনে নিতে পারেননি। ফলে গত তিনমাস যাবৎ ঐশীর বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ হয়ে গিয়েছিল। হেরোইন নাই, ইয়াবা নাই, নিদেনপক্ষে গাঁজা নাই। এই অবস্থা থেকে মুক্তি চেয়েছিল ঐশী রহমান। সে মুক্তি বাবা-মাকে হত্যা করে হলেও।
কিন্তু হত্যা শেষে পরদিন সকালে দিনভর ঘুরেও কোথায়ও কোনো বন্ধু-বান্ধবের কাছে সে আশ্রয় পায়নি। যখন তারা জেনেছে যে, সে তার বাবা-মাকে হত্যা করে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে, তখন তার ইয়াবাসেবী বন্ধুরাও তাকে উপেক্ষা করেছে। সম্ভবত কোনো তথাকথিত প্রেমিকও সাড়া দেয়নি। ফলে সে দিনভর রাখা স্কুটার ড্রাইভারের বাসায় তার কাজের মেয়েকে রেখে যায়। ছোট ভাইকে রিকশায় বা স্কুটারে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। তারপর সে নিরন্তর একা। বাবা নাই। মা নাই। চারপাশের ইয়াবা বন্ধু-বান্ধবেরা নাই। কেহ নাই কিছু নাই।
এই নিবন্ধের শিরোনামে আমি দায়িত্ব স্বীকার করেছি যে, ঐশীর অধঃপাতে আমিও দায়ী। তার কারণ এই যে, আমি এই সমাজের প্রবীণ নাগরিক। হ্যাঁ, ঐশী, তোমার বাবার মতো আমিও তোমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারিনি। তোমাকে আইডিয়াল স্কুলের হিজাবের নিচে আমার রাখা উচিত ছিল। অথবা আমার উচিত ছিল ইংলিশ স্কুলে ভর্তির পর তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করা। অথবা কিছুই না। আমরা কেন তোমাকে শৈশব থেকে এভাবে গড়ে তুলতে পারলাম না যে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ- এমন সব প্রাচীন প্রবাদের সঙ্গে। তোমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কোথায়ও বোধ করি এটাও বলা হয়নি যে, গুরুজনকে শ্রদ্ধা করিবে। কানাকে কানা বলিবে না। খোঁড়াকে খোঁড়া বলিবে না। সদা সত্য কথা বলিবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমরা এমন এক নিম্নস্তরে নামিয়ে এনেছি যে, তোমাকে কেবলই ইয়াবার দিকে ঝুঁকিয়েছি। বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থার যে অধঃপতন হয়েছে, ঐশী, তুমি সেই নৈতিকতা ধ্বংসের প্রতীক হয়ে গেলে। সেটা তুমি হয়েছ। আমার কন্যা সন্তানও হতে পারতো। আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এর চাইতে বেশি কিছুই করতে পারলাম না। তোমার জন্য আশীর্বাদ রইলো, মহান আল্লাহতায়ালা যেন তোমাকে ক্ষমা করেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads