বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৩

একটি পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী


 মিসর পাল্টে যাবে ক. মিসরে যা কিছু ঘটছে, তার উল্লেখযোগ্যটাই ঘটানো হচ্ছে। মিসর ফেরাউনের দেশ। মিসর নবী হজরত মুসা ও হারুন আ:-এর দেশ। নবী হজরত ইউসুফ আ: মিসরের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। মিসরের বনেদি ইতিহাসে সত্য-মিথ্যার লড়াই ও সঙ্ঘাত ছিল। হজরত মুসা আ:-এর জন্ম, বেড়ে ওঠা, ফেরাউনের মুখোমুখি দাঁড়ানো, নদীর পানি সরে রাস্তা হওয়া, ফেরাউনের ডুবে মরা, এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস। মুসা নবীর উম্মতেরা ছিলেন বিশেষ করুণাপ্রাপ্ত। তাদের জন্য আসমানি খাদ্য আসত। আবার তারাই কর্মদোষে অভিশপ্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মিসরীয়দের বিগত এক শবছরের ইতিহাসও বর্ণাঢ্য, কিন্তু রক্তস্নাত। ব্রাদারহুড এ নিয়ে মোটা দাগে তিন-তিনবার রক্ত ঢালল। এর এক ফোঁটা রক্তও বৃথা যাচ্ছে না তার প্রমাণ আজকের সত্য-মিথ্যার লড়াই। তবে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে, একই সাথে মার্কিন-ইহুদি ও রাজতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ তাৎক্ষণিক সুফল দেবে না। আরব বসন্ত ও ব্রাদারহুডের রক্ত মিসরবাসীকে ভোরের সূর্যের মতো একটুখানি গণতন্ত্র দেখার সুযোগ দিয়েছিল। সেই গণতন্ত্রের কবর দিলো দৃশ্য-অদৃশ্য অশুভ শক্তি। তারপরও এই রক্তের ওপর এক নতুন মিসর দাঁড়াবে। মিসরবাসী এক সময় মুক্তির স্বাদ পাবে। কিন্তু অপেক্ষার সময়টা হয়তো দীর্ঘ হবে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় বানরের পিঠা ভাগের মতো। ইহুদি চক্র ও সাম্রাজ্যবাদ দাবা খেলে। পাক-আফগান সীমান্ত থেকে আফ্রো-এশিয়াজুড়ে সাপ-লুডু খেলার ছক সাজানো। রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসকেরা সাপ-লুডু মাত্র। কখনো তারা সাম্রাজ্যবাদের সেবায়েত। কখনো লাঠিয়াল। মধ্যপ্রাচ্যের বিগত এক শবছরের ইতিহাস যারা জানেন, তারা জাজিরাতুল আরবের ইতিহাসও জানেন। ইহুদি চক্রান্তের ইতিহাসও তাদের জানা। ওসমানী খেলাফত ধ্বংস করার জন্য উম্মাহর বন্ধুবেশী শত্রুরা কী না করেছে। কোনো ক্রান্তিকালেই তারা উম্মাহর স্বার্থ-সংরক্ষণে মৌলিক ভূমিকা পালন তো করেনি, বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ-সংরক্ষণে উম্মাহর সদস্যদের রক্ত নিয়ে খেলা করেছে। পিঠে ছুরিকাঘাত করেছে। আরবদের তেলের বিনিময়ে আরবরা বুলেট উপহার পেয়েছে। ইতিহাসের এই ধারা পাল্টাবে। শাসকের ওপর শাসিতের, জালেমের ওপর মজলুমের, নিপীড়নকারীদের ওপর নির্যাতিতের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। মিসরের সাধারণ জনগণ ও মুরসিপন্থীরা অকাতরে জান দিতে শিখেছে। প্রাণের বিনিময়ে বিজয় চাওয়ার ঈমানি শক্তি তারা অর্জন করেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের রাজতান্ত্রিক সেবায়েতরা অচিরেই পিছু হটবে। একটা দেশের অর্ধেকের বেশি জনশক্তিকে লাশের কাফন পরিয়ে সেই দেশ শাসন করা যায় না। ভ্রাতৃসঙ্ঘের কর্মীরা রক্তমূল্যে দেশটাকে নিজেদের পছন্দের জনপদ বানাবেই। এই মাটিতে হাসানুল বান্না, সাইয়েদ কুতুব, জামিলা কুতুব ও মুফতি আবদুহুসহ শত শহীদের রক্ত ঝরেছে। সেই রক্তের ওপর নতুন করে খুন রাঙ্গা ইতিহাস দাঁড়াচ্ছে। এখন মিসরে চলছে এক অসম যুদ্ধ। এক পক্ষে নিরস্ত্র লাখো কোটি মিসরবাসী। অন্য পক্ষে সমগ্র রাষ্ট্রীয় বাহিনী। এই অসম যুদ্ধে হয়তবা অস্ত্র ও ষড়যন্ত্রের বিজয় হবে। তবে নৈতিকভাবে তারা হেরে যাবে। যে দেশের সেনাবাহিনী নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ের উল্লাস করে, সেই দেশ এক সময় অবয়ব পাল্টায়। মিসরকেও পাল্টে যেতে হবে। ছোপ ছোপ রক্ত, শহীদদের হাড়গোড় মাটি ভেদ করে ঈমানের পিরামিড গড়বে। মিসর ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ভারসাম্য রক্ষাকারী দেশ। এই ভারসাম্য নষ্ট করার জন্যই ইরাক ও সিরিয়া শেষে মিসরকে নিঃশেষ করার যড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জনগণের শাসন ও ব্রাদারহুড অভিন্ন ধারণাপুষ্ট হয়ে রাজতন্ত্রের পিলে চমকে দিয়েছে। রাজা-বাদশাহরা নিজেদের তখতকে আর নিরাপদ ভাবছে না। তাই আরব বসন্তের ফসল ঘরে তোলার আগেই মিসর পরিকল্পিত আগ্রাসনের কবলে পড়ল। মিসরের রাজনীতি নীল নদের স্বচ্ছ পানির মতো সব সময় টলটলায়মান নয়। কখনো কখনো পিরামিডের পাথরের মতো কঠিন, ফেরাউনদের মতো দুর্বিনীত ও নিষ্ঠুর শাসকদের উৎপাতে জর্জরিত। কোমল-কঠিনের বাইরেও স্বৈরতান্ত্রিক শাসকশ্রেণী ফেরাউনের মতোই নিষ্ঠুর। জনগণ হজরত মুসা, হারুন ও ইউসুফ আ:-এর মতোই রহমদিল, খোদা বখ্ত, আত্মপ্রত্যয়ী ও ত্যাগী। এক সময় জুলুম-অত্যাচারে জর্জরিত মিসরবাসীর জন্য আল্লাহ নদীর পানি সরিয়ে রাস্তা করে দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দিয়েছিলেন। সেই নীল নদের পানি এখন খুনে লালে লাল। এত রক্তের বদলায় একটি পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পাল্টে যাবে। পাল্টে যাবে মিসরও। ভোটার মন চঞ্চলা-চপলা নারীর মতো খ. মিসর নিয়ে আরো ঋজু মূল্যায়ন ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। বাংলাদেশ মিসর নয়। তবে উম্মাহর স্বার্থ বিবেচনায় মিসর পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের কিছু মিল আছে। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের বোঝাপড়ায় এই জনপদটাও পশ্চিমা ও আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তির রাডারের আওতায় রয়েছে। বর্তমানে রাজনীতিতে যে বিষাক্ত আবহাওয়া ও চুল-তত্ত্বের অসংলগ্ন বাগি¦তণ্ডা তার নেপথ্যেও চেনা-অচেনা, দৃশ্য-অদৃশ্য শক্তির অভিলাষ পূরণের ইচ্ছা স্পষ্ট। যে অদৃষ্টবাদী চিন্তা আমাদের জাতীয় রাজনীতিকে ঘিরে ধরেছে তারও আসল কারণ সবাই খেলারামের মতো খেলছে। অদৃষ্টবাদী চিন্তার নানা ব্যাখ্যা হতে পারে। ভাগ্য, নিয়তি কিংবা দৈব ভাবনায় নির্ভর হওয়া। অদৃষ্টবাদিতার একটা লক্ষণ মাত্র, একমাত্র লক্ষণ নয়। এখন যে অদৃষ্টবাদিতা আমাদের ঘিরে ধরেছে, সেটা বিশ্বাসনির্ভর নিয়তিবাদ বা অদৃষ্টবাদ নয়। এটা আরোপিত ক্ষমতার রাজনীতির সুবিধাবাদ। এ কারণেই আমরা ধরে নিতে বাধ্য হচ্ছি, এটাও হতে পারে ওটাও হতে পারে। এর সরল অর্থ আমরা স্বাধীনভাবে নিজেদের ভাগ্য নিয়ে ভাববÑ সেই শক্তিও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ধরন-ধারণ এখন যেদিকে ধাবিত হচ্ছে, তাতে রাজনীতিবিদেরা যেমন জনগণের দিক থেকে নিয়ন্ত্রণহীনÑ তেমনি অদৃশ্য শক্তি দ্বারা অতি নিয়ন্ত্রিতও। এর প্রধান কারণ আমাদের সরকার পরিচালনার সাথে যেসব রাজনীতিবিদ জড়িত, তারা এখন ঘোরতরভাবে অদৃশ্য শক্তিনির্ভর ও অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়েছেন। সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে, থেঁতলে-থিতিয়ে দিয়ে, দমনপীড়ন চালিয়ে এখন তারা বলছেন জনগণ চাইলে আছি, না চাইলে নেই, তবে ভোট খেলা খেলতে হবে আমাদের কমান্ড মেনে। আবার বলছেন তারা আছেন, থাকবেন। এতদিন বেপরোয়া পথ চলে, ক্ষমতাকে অধিকার ভেবে, এতটা বাড়াবাড়ির পর এখন ভাবছেন কেউ-না-কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন। এটা চাতুর্য না ধূর্তামি সেটাও তারা ভাবছেন না। কেউ কেউ আরো আগ বাড়িয়ে বলছেনÑ ক্ষমতা আল্লাহ দেন, আল্লাহ কেড়ে নেন। এবার যেন ক্ষমতাসীনদের মগজে নতুন করে মৌলবাদতাড়িত আল্লাহপ্রেম জেগে উঠল। এতদিন দুমড়েমুচড়ে ক্ষমতাচর্চা করা হলো বাহুর জোরে। দম্ভ-অহমিকা প্রকাশ করা হলো রাষ্ট্রশক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার করে। আইন চলল ক্ষমতার ছত্রছায়ায়। বিচার-আচার নিয়ন্ত্রিত হলো ক্ষমতার অঙ্গুলি হেলনে। প্রশাসন চলল রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের ইচ্ছানুযায়ী। সরকারি ইচ্ছার দাসত্ব প্রদর্শন করল দুর্নীতি দমন ও মানবাধিকার কমিশনসহ সব সাংবিধানিক সংস্থা। এমনকি নির্বাচন কমিশনও। পুলিশ বিভাগ পুরোটা লাঠিয়ালে রূপান্তরিত হলো। পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হলো রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে নয়, দলের প্রয়োজন বিবেচনায়। দুর্নীতির বন্যা বইয়ে দিয়ে টিআইবির বরাতে খেতাব মিলল পুলিশ, রাজনীতি ও বিচার দুর্নীতির শীর্ষে। এত অপকর্মে আল্লাহ নেই, অদৃষ্টের দোহাই নেই। এখন অদৃষ্ট এসে ভর করল, আল্লাহরও প্রয়োজন পড়ল। এ আবার কোন ধরনের ধর্মান্ধতা! এখনো জনমতকে পদদলিত করতে বিরোধী দলমত ও চিন্তা-ভাবনা পর্যন্ত সরকার সহ্য করতে চাইছে না। নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াও অসহ্য। এই সহ্য করতে না চাওয়ার কারণেই তো পাখির মতো গুলি, রিমান্ড আর গুমের অত্যাচার সীমা অতিক্রম করল। নিজেদের মামলা তোলার হিড়িক চললেও বিরোধী দলকে নাকাল করতে মামলাবাজ খ্যাতি পেল সরকার। ভাবখানা এমন, আল্লাহ পাঁচ বছর আগে মহাজোট সরকারকে পাঁচ বছরের ইজারা কিংবা জমিদারির দখলিস্বত্ব দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছেন। এখন খোদা সন্তুষ্ট হয়ে আরো পাঁচ বছর গায়েবি মদদে ক্ষমতায় রাখতে চান। বিলবোর্ডগুলো জনগণের নিন্দাবাদের বিষয় হলেও আল্লাহ তো দেখেছেন। আরো যা যা করেছেন সবই করেছেন আল্লাহর ইচ্ছায়। মাহমুদুর রহমান-আদিলুর রহমানরা খামোখা বাড়া ভাতে ছাই ছিটাতে চেয়েছেন। দুর্ভাগ্য, সরকার রাজনৈতিক সঙ্কট সামলে উঠতে চায়, কিন্তু অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে পথ চলতে চায় বলে মনে হয় না। এখানে আবার নিয়তি নয়, শক্তি প্রয়োগের পথেই হাঁটতে চায়। মন্ত্রীরা রগড়ে ভাষায় সেটাই জানান দিচ্ছেন। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার অভিলাষ তারই প্রতিধ্বনি। প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনে তারই ইঙ্গিত ফুটে উঠল। অদৃষ্টবাদী এই চিন্তা বিরোধী দলকেও গ্রাস করেছে। তারাও দিনের পর দিন নিয়তিবাদী হয়ে থেকেছেন। কটা রোডমার্চ, কিছু হরতাল, ঢাকা ও অঞ্চলভিত্তিক গোটা কয়েক সভা-মহাসভা করে তারা ভাবছেন বাকিটা বিধাতা এসে করে দেবেন। ক্ষমতাটাও হাতবদল করে দেবেন জাদুর মতো হাত সাফাই করে। এ সত্য না মেনে কোনো উপায় নেই, বিরোধী দল দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। শেয়ার মার্কেট থেকে রেল দুর্নীতি-পদ্মা কেলেঙ্কারি কোনো ইস্যুতেই বিরোধী দল কাক্সিত মাত্রায় জনগণকে সাথে নিয়ে শক্ত অবস্থানে দাঁড়ায়নি। ভেবেছে দুর্নীতি পাপ। পাপমুক্ত করে দেবেন সৃষ্টিকর্তা। বিরোধী দলের নিয়তিবাদী হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তারা ধরেই নিয়েছেন, ক্ষমতাসীন জোট ক্ষমতাচর্চা করতে গিয়ে বাড়াবাড়ির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, আর বিধাতা বিগড়ে গিয়ে তাদের ওপর গজব ঢালছেন, জনগণ সরকারি দলের ওপর সব ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছে, আর মুনাজাত করে বিরোধী দলকে ক্ষমতা পাইয়ে দেবে। তারপরও বিরোধী রাজনীতিবিদেরা অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। তারা ধরেই নিয়েছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণ হলো মই জাতীয় নেয়ামত, আল্লাহ হলেন বল, ভরসা ও সহায়। আবার ক্ষমতা থেকে দুঃশাসনকে নির্বাসনে পাঠানোর দায়ও যেন বিধাতার। বিরোধী দল এমন অদৃষ্টবাদী ভাবনার ওপর দাঁড়িয়ে ধৈর্য ও সহ্যের নামে এই অদৃষ্টবাদের রাজনীতিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সরকারের বাড়াবাড়ি যেমন নজিরবিহীন। বিরোধী দলের ধরি মাছ না ছুঁই পানি মার্কা রাজনীতিও দৃষ্টান্তহীন। সরকারের জুলুম-নির্যাতনের মোকাবেলায় একবারও জনগণের পক্ষে বিরোধী দল বুক টান করে রাজপথ আগলে দাঁড়ায়নি। অথচ অনেক রাজনৈতিক সঙ্কট সরকার সৃষ্টি করতে পেরেছে বিরোধী দল রাজপথে ও সংসদে কার্যকর কোনো অবস্থান না নেয়ার কারণে। একটি দলকে সরকার যখন কোণঠাসা করেছে তখন অপরাপর বিরোধী দল দর্শক সেজেছে বলেই সরকার হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে। বিরোধী দল অবশ্যই জুলুম-পীড়ন, হামলা-মামলার শিকার হয়েছে। অফিসেও টিকতে পারেনি। রাজপথেও দাঁড়াতে দেয়নি। সরকার যখন দেখেছে বিরোধী দলকে একের পর এক কোণঠাসা করে পার পাওয়া যাচ্ছে, তখন তারা বিরোধী দলকে মাঠছাড়া করে ছেড়েছে। একটি রাজনৈতিক সরকার নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এমন বেপরোয়া হয় তখনই যখন বাধা পায় না। যারা রাজনীতি করেন, তারা রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পাল্টে দেয়ার মতো হিম্মত রাখেন বলেই রাজনীতি করেন। গতি-প্রকৃতি পাল্টে দেয়ার মতো রাজপথ কাঁপানো প্রতিরোধের রাজনীতি কি বিরোধী দল করেছে? করেনি। তাহলে কিভাবে আশা করা যায়, সরকারি দল বিরোধী দল ও জোটের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে দেবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরব-নীরব সব বামপন্থী এখন শুধু নিয়তিবাদী হয়ে ওঠেননি, ক্ষমতার রাজনীতির পক্ষে ক্ষমতার মৌলবাদী হয়ে আগাগোড়া রূপান্তরিত হয়ে গেছেন। এখন তারা শ্রীনাথ বহুরূপী। তারা নিজস্ব রাজনীতির ধারেকাছেও নেই। কেউ কলাম লিখছেন, কেউ গোলাম সেজেছেন। জনগণকে সাথে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও দেশীয় পুঁজিবাদী বুর্জুয়াদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সামান্য চেষ্টাও এ দেশের বামপন্থীরা করেননি। এখন পরগাছার মতো কোনোমতে ক্ষমতার ডালপালায় টিকে থাকাই তাদের শেষ কথা। তারা তাদের জন্য এটাকেই নিয়তি বা অদৃষ্টের লিখন হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এখন তাদের রাজনীতির মূল কথা হলো ধর্ম ও ধার্মিকদের বিরোধিতা করা। সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষপুটে বসে সাম্রাজ্যবাদের নিকুচি করা। পুঁজিবাদের পেটে হজম হয়ে গিয়ে সমাজবাদের মলমূত্র হয়ে বের হওয়া। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা দলে অনুপ্রবেশের রাজনীতির বাইরে তাদের কোনো কৌশল নেই। বাছ-বিচার ছাড়া ক্ষমতার কোলবালিশ হওয়া ছাড়া তাদের যেন গত্যন্তর নেই। এই প্রগতিশীল অদৃষ্টবাদীদের নিজস্ব কোনো রাজনীতিও আর অবশিষ্ট নেই। এক সময় বাম ধারার রাজনীতির সাথে থেকে যে বাম ধারণা পেয়েছিলামÑ আজ সেই বাম চিন্তা নির্বাসিত আর কমিউনিস্ট কমরেডরা অচেনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীরা বামপন্থীদের মতো অতটা গণবিচ্ছিন্ন না হলেও তাদের অবস্থান স্বচ্ছও নয়, নির্ভরশীল হওয়ার মতোও নয়। তাদের কাছে সাম্রাজ্যবাদী নীলনকশা ও সম্প্রসারণবাদী ষড়যন্ত্র স্পষ্ট নয়। প্রতিপক্ষ গর্ত খুঁড়ে রাখে, আর তারা ঝাঁপ দেয়। তাদের নিজস্ব রাজনীতি কী, সেটা তাদের কাছেও স্পষ্ট কি না, সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। তাদের জনশক্তি ও সুহৃদরা তাদের বেশি বিশ্বাস করে। তাদের প্রতিপক্ষ মোটেও বিশ্বাস করে না। এক ধরনের সুবিধাবাদ, সাময়িক লাভালাভ তাদেরও আচ্ছন্ন করে আছে। তার ওপর ক্ষমতার বলয় ডিঙিয়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার মতো দূরদর্শিতা চোখে পড়ে না। কোনটি তাদের কৌশল, কোনটি প্রকৃত কর্মসূচি তা নিয়ে তাদের পলিটিক্যাল পার্টনাররাও সব সময় দ্বিধামুক্ত নন। এক ধরনের অদৃষ্টবাদী ভাবনা থেকেও মাঝে মধ্যে তারা ঝুঁকি নেন, হুটহাট করে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার মতো কৌশলও গ্রহণ করেন। আবার নিয়তিনির্ভর হয়ে জুলুম-পীড়ন হজম করে ব্যাখ্যা করেন, এটা ত্যাগ ও তিতিক্ষার বৈশিষ্ট্য। নিজেদের ওজন না মেপে হঠকারিতার জন্য দু-চারটি দল নিষিদ্ধেরও ঝুঁকি নিয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতির বৃত্ত ও সীমাবদ্ধতা ভাঙতে মাঝে মধ্যে তৃতীয় শক্তির নামে কিছু উচ্চবাচ্য শোনা যায়। তারাও আরেক ধরনের নিয়তিবাদী ধারার অস্তিত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমদানি করতে চাচ্ছেন। তারা ভাবছেন ভিন্ন ধরনের অদৃষ্টবাদিতাকে পুঁজি করে। তাদের ধারণা, দ্বিমেরু বা দুই ধারার ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির ওপর জনগণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাদের পক্ষপুটে অবস্থান নিতে বাধ্য। কাজটা তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে করতে হবে না। মাঝে মধ্যে দু-চারটা বুদ্ধিবৃত্তিক সভা, টা টকশো আর বিবৃতি দিলে উদ্দেশ্য সিদ্ধি লাভ করবে। স্বাভাবিকভাবে হয়ে যাবে তৃতীয় বিকল্প ধারার পথচলার সব ব্যবস্থা। তারা ধরেই নিয়েছেন তাদের পরিচিতি আছে, কিন ইমেজ আছে, অতীত ক্যারিয়ার আছে, জনগণ তাদের ওপর আস্থা না রেখে যাবে কোথায়। এই অদৃষ্টবাদীরা বিকল্প স্রোত ও ধারা সৃষ্টি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, বাস্তবতার কথা কমই ভাবেন। তাদের চিন্তা এতটাই মৌলবাদী ভাবনাতাড়িত যে, এর বাইরে তারা কিছু চিন্তা করতে নারাজ। কার্যত তারা নিয়তিনির্ভর হয়ে এক সময় ব্যবহৃত হয়ে যান। হয় ক্ষমতা তাদের ব্যবহার করে, নয়তো তারা ক্ষমতাকে ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সময়টিতে, বিশেষভাবে দ্বিধারার প্রচণ্ড মেরুকরণের এই মুহূর্তে অতি বাম, অতি ডান এবং অতি মধ্যম পন্থার কোনো ভবিষ্যৎ থাকার কথা নয়। রাষ্ট্রশক্তির সাথে যুদ্ধ করে টিকে যাওয়ার মতো স্বপ্নাভিসারীদেরও তাৎক্ষণিক সুবিধা পাওয়ার জায়গা দেখি না। কারণ বাঙালি মুসলমানের কিছু বৈশিষ্ট্য ও চিরায়ত ভাবনা রাজনীতিকে বরাবরের মতো প্রভাবিত করবেই। এই জনপদের মানুষ ধর্মকর্ম যেমন করবে, তেমনি রাজনীতির ছায়াও মাড়াবে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি জনগণ পছন্দ করে না, কিন্তু ধর্ম বর্জন করে পথচলাও তারা মেনে নেয় না। ধর্ম ব্যবসায়ও তাদের আপত্তি। আবার গণতন্ত্রের প্রতি তাদের নিষ্ঠার প্রকাশও ঘটাতে চাইবে। তত্ত্বীয় রাজনীতির প্রতি তাদের আগ্রহ যেমন কম থাকবে, তেমনি বাড়াবাড়ির প্রতি তাদের কোনো সহানুভূতি থাকবে না। ক্ষমতার দাপট অতটুকুই সহ্য করবে যতটুকু তার ব্যক্তিসত্তা ও বিশ্বাসের অহমকে আঘাত না করবে। তারা দেশের মানচিত্রকে পিতা-মাতার জায়নামাজের মতোই পবিত্র জ্ঞান করে। এর সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ততটাই জরুরি ভাবে। বর্গি-হার্মাদ, আগ্রাসন ও অনভিপ্রেত দাদাগিরি ঠেকানোর দায়কে তারা নিয়তির বিষয় ভাবে না, শক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে দেয়াকে দায়িত্ব মনে করে। তাই সাময়িক প্রতিকূলতাকে তারা মেনে নেয়, কিন্তু নিয়তিনির্ভর হয়ে হতোদ্যম হয়ে থাকার কথা ভাবে না। ঝড়ঝঞ্ঝা, বিপদ-আপদ সাথে নিয়ে তারা বাঁচে। এই বাঁচার লড়াইয়ে তারা বিশ্বাসে কোনো ছাড় দেয় না। তাই বারবার মাথা তুলে দাঁড়ায় প্রতিকূলতা জয় করে কিংবা প্রতিরোধ করে। জুলুম-অত্যাচার-দমনপীড়ন-নির্যাতনকে সাময়িক হজম করে, শেষ পর্যন্ত মেনে নেয় না; এক সময় ফুঁসে ওঠে। যারা যখন যতটা এই মানস বুঝে রাজনীতি করে তারা ততটা জনসমর্থন পায়, অন্যরা হয় অপাঙ্ক্তেয়। অদৃষ্টবাদী রাজনীতির এই ঘোর ও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার দুঃস্বপ্ন না কাটলে সরকারের জন্য রাজনৈতিক জাহান্নাম অপেক্ষা করবে। বিলবোর্ড চাতুর্থ ও কথা বলার রাজনীতি খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। জনসমর্থনহীন ক্ষমতা কোনোদিন সুখকর পরিণতি এনে দেয় না। দুঃখ হয়, আমাদের রাজনীতিবিদেরা ভোটের গন্ধ পেলেই মৌলিক রাজনীতি ভুলে যান। ভোট আর ক্ষমতার গন্ধ যেন কাছাকাছি। একবারও তারা ভাবতে চান না, ভোটারমন চঞ্চল-চপলা নারীর মতো। কখনো কখনো অধরা থেকে যায়। প্রেম-ভালোবাসার ভরসা না পেলে সেই ভোট আঁচলে গিঁট দিয়ে রাখে। তবু অপাত্রে ঢেলে দেয় না। বিরোধী দল কি দায়িত্বশীল সুপাত্র হওয়ার দায় পূরণ করতে প্রস্তুত। সরকারি দল কি তত্ত্বাবধায়ক ধারণায় না গিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ধনুক ভাঙ্গাপণ ভেঙে দায় বোধ নিয়ে জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াবে! 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads