রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৩

মানবাধিকার ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন

অধিকার-এর কার্যক্রম ও গ্রহণযোগ্যতা : ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ১৯ বছরে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার পক্ষপাতহীন ও দায়িত্বশীলতার সাথে বাংলাদেশের ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে সব মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের পক্ষে ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। অধিকার অতীত ও বর্তমানের প্রতিটি সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরে এক দিকে জনগণকে যেমন তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছে, অন্য দিকে সরকারকে তার সুপারিশ দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধের জন্য সহযোগিতা করেছে; তেমনি রাষ্ট্রকে মানবাধিকার লঙ্ঘন না করার জন্য দায়িত্বশীল করতে চেয়েছে। মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার হওয়ার জন্য প্রতিটি সরকারের আমলে অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক হয়রানির শিকার হয়েছে। তবু অধিকার তার দায়িত্ব পালনে কখনোই পিছপা হয়নি। বর্তমানের আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলে থাকাকালে অধিকার-এর মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত, প্রতিবেদন সংগ্রহ করে তাদের কাজে লাগিয়েছে। ২০০৭-২০০৮ সালে মাইনাস টু ফর্মুলারমাধ্যমে দুই নেত্রীকে অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় জেলে বন্দী করলে অধিকার তার প্রতিবাদ করে। কারণ অধিকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিশ্বাস করে। বর্তমানে বিরোধী দলও অধিকার-এর তথ্য-উপাত্ত, তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদন তাদের কাজে লাগাচ্ছে। এ থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, অধিকারের তথ্য-উপাত্ত যেকোনো দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য। এর পেছনে কারণ হলো অধিকার যথেষ্ট যাচাই-বাছাইয়ের পরই তাদের তথ্য সর্বসম্মুখে উন্মুক্ত করে ও পক্ষপাতহীনভাবে শুধু মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে। জাতিসঙ্ঘসহ দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠন ও বিভিন্ন সংস্থার কাছে অধিকার-এর তথ্য সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতার কারণে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। গত ১৯ বছরে অকান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে অধিকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড; হেফাজতে নির্যাতন; গুম; সাংবাদিক, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, নির্যাতন; নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্বিচারে বাংলাদেশীদের ওপর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। অধিকার-এর মানবাধিকার কর্মীরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে থাকে। তারা বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকহিসেবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এ বিষয়েও অধিকার-এর কর্মীদের দক্ষতা অপরিসীম। অধিকার-এর একটি মূল কাজ হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার বিষয়ে সরকারকে দায়িত্বশীল করা। অধিকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বিষয়ে ডকুমেন্টেশন, তথ্যানুসন্ধান, অ্যাডভোকেসি, সচেতনতামূলক কার্যক্রম করে আসছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারের আমলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করেও চরম দায়মুক্তি ভোগ করছে। অধিকার সবসময়ই চেয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যাতে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে না পারে সে বিষয়ে সরকারকে দায়বদ্ধ করা; অথচ তা ঘটেই চলছে। গত ৫ মে ২০১৩ ঢাকায় হেফাজত ইসলামের সমাবেশ হয়। ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৫ ও ৬ মে অসংখ্য মানুষ রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূতভাবে নিহত হয় বলে অভিযোগ আসতে থাকে। ৫ মে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে অনেককে হত্যা করে বলে জানা যায়। ৬ মে মধ্যরাতে সমাবেশকারীদের মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎ বন্ধ করে সমাবেশকারীদের ওপর পুলিশ ও যৌথ বাহিনী হামলা চালায়। এ সময় বিরোধীদলীয় দুটি টিভি চ্যানেল দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি ঘটনাটি সরাসরি সম্প্রচার করতে থাকায় চ্যানেল দুটি সরকার বন্ধ করে দেয়, যা এখনো বন্ধ রয়েছে। অধিকার যেহেতু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের লক্ষ্যে কাজ করে, তাই এ ঘটনায় কত জন মানুষ নিহত হয়েছে সে বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান শুরু করে। প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানে ৫ ও ৬ ই মে ৬১ জন নিহত হয়েছেন বলে অধিকার জানতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অধিকার ১০ জুন ২০১৩ হেফাজত ইসলামের সমাবেশ ও মানবাধিকার লঙ্ঘননামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে ৬১ জন নিহত হয়েছে বলে উল্লেখ করে। যদিও সরকার এর পক্ষ থেকে ৫ মে ১১ জন ও ৬ মে ভোররাতের অভিযানের ঘটনায় কেউ নিহত হয়নি বলে দাবি করে। সরকার এ ঘটনায় এক লাখ তেত্রিশ হাজার পাঁচ শরও বেশি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ফলে ভিক্টিম পরিবারগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দেয়। তথ্যানুসন্ধানকালে নিহত বেশির ভাগ ভিক্টিমের আত্মীয়স্বজন তাদের ওপর পুলিশ ও গোয়েন্দাদের নজরদারির বিষয়টি উল্লেখ করে অধিকারকে ভিক্টিম ও তাদের পরিবারের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করতে নিষেধ করে। ফলে ভিক্টিমদের নিরাপত্তার স্বার্থে মানবাধিকার কর্মীদের নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে অধিকার ৬১ জনের তালিকা প্রতিবেদনের সাথে সংযুক্ত করা থেকে বিরত থাকে। উল্লেখ্য, অধিকার নিহত ৬১ জনের নাম-ঠিকানা, পিতার নামসহ অন্যান্য তথ্যাদি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের জাতিসঙ্ঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এবং আইন ও সালিস কেন্দ্রকে প্রদান করে। ১০ জুন ২০১৩ অধিকার প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক, পুলিশ মহাপরিদর্শক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমে প্রেরণ করে। প্রতিবেদনটি জনসাধারণের জন্য অধিকার-এর ওয়েবসাইটেও দেয়া হয়। ১০ জুলাই ২০১৩ তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠিতে প্রতিবেদনটিসহ ৬১ জন ভিক্টিমের পূর্ণাঙ্গ তথ্য চাওয়া হয়। ১৭ জুলাই ২০১৩ তথ্যমন্ত্রী বরাবর প্রত্যুত্তর চিঠির সাথে অধিকার প্রতিবেদনটি প্রদান করে ও ভিক্টিমদের নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করতে সুপারিশ করে। যেখানে অধিকার ওই কমিশনের কাছে ভিক্টিমদের নাম-ঠিকানাসহ সব তথ্য প্রদান করার অঙ্গীকার করে। ১৭ জুলাই অধিকার তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনটিসহ এই চিঠি পাঠালে তথ্য মন্ত্রণালয় অধিকার-এর সাথে যোগাযোগ করেনি। ১০ আগস্ট ২০১৩ সারা দেশ যখন ঈদ উপলক্ষে দীর্ঘ ছুটিতে ছিল সে সময় মানবাধিকার কর্মী অধিকার-এর সেক্রেটারি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান যখন তার স্ত্রী সন্তানসহ আত্মীয়বাড়ি থেকে এসে তার বাসার গেটের ভেতরে প্রবেশ করেছেন (একই ভবনেই অধিকার অফিসটি রয়েছে), তখন রাত ১০টা ২০ মিনিটে প্রায় ১০ জন লোক বিনা অনুমতিতে দারোয়ানকে সরিয়ে দিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে আদিলুর রহমান খানকে ঘিরে ধরে ও তারা গোয়েন্দা সংস্থার লোক বলে পরিচয় দিয়ে তাকে তাদের সাথে ইউসিবিএল ব্যাংকের একটি মাইক্রোবাসে (ঢাকা মেট্রো-৫৩৪২০৬) উঠিয়ে নিয়ে যায়। এই লোকগুলোর সাথে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল না বা তারা গোয়েন্দা সংস্থার লোক কি না সে বিষয়ে কোনো পরিচয়পত্রও দেখায়নি। খবর পেয়ে অধিকার-এর মানবাধিকার কর্মীরা তৎক্ষণিক বিষয়টি সব মহলে অবহিত করে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় তিনি গোয়েন্দা পুলিশ হেফাজতেই আছেন। যদিও গোয়েন্দা পুলিশ সে রাতে আদিলুর রহমান খানের স্ত্রী বা অধিকার-এর কোনো মানবাধিকার কর্মীকে তাকে গ্রেফতারের খবর নিশ্চিত করেনি। এ বিষয়ে আদিলুর রহমান খানের পরিবার একটি সাধারণ ডায়েরি করার জন্য গুলশান থানায় গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আদিলুর রহমান খানের বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ার কথা জানান এবং সাধারণ ডায়েরি করার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেন। ১১ আগস্ট ২০১৩ মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করার আগে আদিলুর রহমান খানের আইনজীবী ও পরিবারের কেউই তাকে গ্রেফতারের কারণ কী তা জানতে পারেননি এমনকি তার সাথে যোগাযোগও করতে পারেননি। যখন তাকে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করা হলো তখন জানা গেল, তাকে সিআরপিসি ১৮৯৮-এর ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছে। পুলিশ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে মৃতের তালিকা চাওয়া হলেও অধিকার কোনো তথ্য দেয়নি যার জন্য আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করা হয়েছে এই বলে যে, অধিকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ লঙ্ঘন করেছে। একই দিনে আদালত আদিলুর রহমান খানের জামিন নামঞ্জুর করে এবং পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে পাঠায়। ১২ আগস্ট ২০১৩ আদিলুর রহমান খান ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ডের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে একটি ক্রিমিনাল মিসেলিনিয়াস পিটিশন দাখিল করেন। পিটিশনে আদিলুর রহমান খান উল্লেখ করেন, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং যা অশুভ উদ্দেশ্যে তাকে নির্যাতন ও অপদস্থ করার লক্ষ্যে করা হয়েছে। পিটিশন থেকে জানা যায়, তথ্য মন্ত্রণালয়ের ১০ জুলাই ২০১৩ তারিখের চিঠির জবাবে ১৭ জুলাই ২০১৩ অধিকার পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে, সরকার যদি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে তবেই অধিকার ৫ ও ৬ মে ২০১৩ ঘটনার নিহতের তালিকা প্রকাশ করবে কারণ তদন্ত কমিশন আইন ১৯৫৬ অনুযায়ী সরকারকে কমিশন গঠনের ক্ষমতা দেয়া আছে। আদিলুর রহমান খানের গ্রেফতার ও রিমান্ডের বৈধতার বিষয়ে উচ্চ আদালতে বলা হয়, ৫৪ ধারায় রিমান্ডে নেয়া ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় (৫৫ ডিএলআর ৩৬৩) উচ্চ আদালতের রায়ের সরাসরি লঙ্ঘন। আদিলুর রহমান খানের আইনজীবীদের শুনানির পর উচ্চ আদালত তার রিমান্ড স্থগিতের আদেশ দিয়ে রুল জারি করে এবং বলে যদি প্রয়োজন হয় তবে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ১৩ আগস্ট ২০১৩ তাকে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে হাজির করা হয় এবং সেখান থেকে প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং পরে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। উল্লেখ্য, জেলকোড অনুযায়ী আদিলুর রহমান খানের জন্য ডিভিশন চাওয়া হলেও ম্যাজিস্ট্রেট পিটিশনটি প্রত্যাখ্যান করেন। পিটিশনটির প্রত্যাখ্যান নির্দেশ করে যে আদিলুর রহমান খানের সাথে আইন অনুযায়ী ব্যবহার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪৩ বছর চলছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে সংগ্রামরত প্রথম সারির মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান অধিকার ও এর সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান মানবাধিকারের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। অথচ আদিলুর রহমান খানকে বেআইনিভাবে আটক, রিমান্ডে নেয়া, জেলে পাঠানোর মাধ্যমে বর্তমান সরকার এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করল যে, তাদের মানবাধিকার ও এর কর্মীদের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই। বর্তমানে অধিকার-এর অফিস, আদিলুর রহমান খানের বাসভবন (একই বিল্ডিংয়ে অবস্থিত) ও অধিকার-এর কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে আছে। আদিলুর রহমান খান মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। তার পিতা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র থাকাকালে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। অধিকার প্রতিষ্ঠার আগ থেকেই আদিলুর রহমান খান মানবাধিকার রক্ষার কাজ করেছেন। আইনজীবী হিসেবে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের পক্ষে অনেক মানবাধিকারের মামলা লড়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি এবং অন্য তিনজন আইনজীবী ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে দণ্ডিত ব্যক্তিদের মুক্তির জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তিনি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সাথে ৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ছিলেন সোচ্চার। তরুণ আইনজীবী, জাতীয় সামাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (ইনু)-এর সদস্য হিসেবে আদিলুর রহমান খান সক্রিয়ভাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু যার সাথে আদিলুর রহমান খান সরাসরি বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আদিলুর রহমান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পরে মুন্সীগঞ্জ জেলা জাসদের আহ্বায়ক ছিলেন। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতারের পর থেকেই অধিকার-এর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অপপ্রচার চালাচ্ছেন, যদিও তিনি অধিকার-এর অনেক সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আদিলুর রহমান খানকে আটকের পর তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর এজেন্ডা মানবাধিকার রক্ষা নয়, তাদের প্রধান এজেন্ডা জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও জঙ্গিবাদীদের স্বার্থরক্ষা। অধিকার তথ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। কারণ অধিকার-এর লক্ষ্যই হলো এ দেশের প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার রক্ষার জন্য পক্ষপাতহীনভাবে সংগ্রাম করা, যাতে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয় ও যেকোনো রাজনৈতিক দল, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ব্যতিরেকে প্রতিটি মানুষ তাদের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারে। ১২ অগাস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস নোটে উল্লেখ করা হয় ‘... দিনের বেলায় নিহত কয়েকটি মৃতদেহের এবং আহত কয়েকজনের ছবি কম্পিউটারে ফটোশপের সাহায্যে জোড়া লাগিয়ে রাতের অভিযানে তারা নিহত হয়েছে বলে প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।অধিকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই প্রেস নোট প্রত্যাখ্যান করে জানাচ্ছে যে, অধিকার ও আদিলুর রহমান খান সম্পর্কে যে মিথ্যা অপপ্রচার সরকার চালাচ্ছে তা ভিত্তিহীন। অধিকার-এর মানবাধিকার কর্মীরা তৃণমূলপর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার কর্মীসহ) তথ্যানুসন্ধানের সময় এ ঘটনায় নিহত যেসব ব্যক্তির ছবি সংগ্রহ করেছিল তাই এই প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে। অধিকার প্রতিবেদনে ফটোশপের কারসাজির সরকারের মিথ্যা অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। ১১ আগস্ট ২০১৩ রাত আনুমানিক ৮টা ২০ মিনিটে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অধিকার অফিসে তল্লাশি চালায়। তারা দুটি সিপিইউ ও তিনটি ল্যাপটপ নিয়ে যায়। দুটি সিপিইউতেই অধিকার-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টেশন, তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন, ভিক্টিমদের ছবি, মামলার কাগজপত্র ইত্যাদি তথ্যসহ ৫ ও ৬ মের ঘটনার প্রতিবেদনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য ছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অনেকগুলোরই কোনো ব্যাকআপ ছিল না। এই রিপোর্ট প্রকাশ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এই তথ্য সংবলিত কম্পিউটারগুলো ফেরত দেয়া হয়নি। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা : অধিকার মনে করে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন একটি দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে উন্নত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। একটি দেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য দলনিরপেক্ষ ও পেশাগত দায়িত্বসম্পন্ন সংবাদমাধ্যম অত্যন্ত জরুরি। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ, হত্যা, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা বন্ধের লক্ষ্যে অধিকার অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছে। আদিলুর রহমান খানকে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার ব্যক্তিবর্গ তুলে নেয়ার পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর দিলে তারা তৎক্ষণাৎ খবরটি গুরুত্বের সাথে জনসাধারণকে জানিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করেন। কিছু সংবাদমাধ্যম এ ঘটনার পরপর অধিকার ও আদিলুর রহমান খান সম্পর্কে সত্য তথ্য তুলে ধরেছে। তবে অধিকার এ-ও লক্ষ করছে যে, আদিলুর রহমান খানকে আটকের পর দিন থেকেই কয়েকটি সংবাদমাধ্যম অধিকার ও আদিলুর রহমান খান সম্পর্কে মিথ্যা, বানোয়াট ও বিকৃত তথ্য প্রকাশ করছে। তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে অধিকার ও আদিলুর রহমান খান সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা হলো, সরকার বিরোধীদলীয় প্রায় সব ইলেকট্রনিক মিডিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বেশির ভাগ টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার মালিকানা সরকারপন্থীদের হাতে চলে গেছে। ফলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অধিকার ও আদিলুর রহমান খান সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সরকারপন্থী দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ১৮ আগস্ট অধিকারের নিহত সোহেল এখন উজানী মাদরাসায় কাস করছে।সেই প্রতিবেদনে প্রতিবেদক বিভাষ বাড়ৈ উল্লেখ করেন, ‘সেই রাতের ঘটনায় হেফাজত, জামায়াত, বিএনপি আর কথিত মানবাধিকার সংগঠন অধিকার নিহত হিসেবে একজন মাদরাসার ছাত্রের নাম প্রকাশ করতে পেরেছে। কিন্তু সেই তথ্যই ছিল মিথ্যা।... কখনো হাজার হাজার আবার কখনো ৬১ জনের হত্যার কথা প্রচার করে নিহত হিসেবে সোহেল নামের ছাত্রের কথা বলা হয়েছে তিনি এখন কাস করছেন চাঁদপুরের কচুয়ায় তার মাদরাসায়।এই প্রতিবেদনে অধিকারকে মানবাধিকার নামে সক্রিয় গ্রুপউল্লেখ করে বলা হয় যে, অধিকার সোহেল ছাড়া কারো নাম ঠিকানাসহ পরিচয় বলতে পারেনি। অধিকার স্পষ্টভাবে জানাতে চায় যে, এর তালিকায় নিহত ৬১ জনের মধ্যে সোহেলনামে কোনো ব্যক্তির নাম নেই। এটি শুধু একটি উদাহরণ। অধিকার-এর বিরুদ্ধে এ ধরনের আরো অসংখ্য মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। অধিকার সব সময়ই হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং সত্য ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের (সংশোধিত) খসড়া ও মানবাধিকার : এরই মধ্যে গত ১৯ আগস্ট তথ্যপ্রযুক্তি আইনের (সংশোধিত) খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। এই আইনের খসড়ায় ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারায় উল্লেখিত অপরাধকে আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খসড়ায় এই চার ধারার অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির মেয়াদ ১০ বছর থেকে বাড়িয়ে ১৪ বছর করা হয়েছে। আর ন্যূনতম শাস্তি হবে সাত বছর। এ খসড়া আইনে আমলযোগ্য অপরাধ কেউ করলে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতারের বিধান রাখা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, আইনটি ভেটিংয়ের (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ভেটিং পেলেই অধ্যাদেশ আকারে তা জারি করা হবে। আইনটির নাম হবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০১৩। ১০ আগস্টে আদিলুর রহমান খানকে বিনা পরোয়ানায় আটক, জামিন না দেয়া, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেফতার দেখানোর পর ২০ আগস্ট বিনা পরোয়ানায় আটক, জামিন না দেয়ার বিধান রেখে একে আইনে রূপান্তর করতে চাইছে সরকার। অধিকার মনে করে আইনে পরিণত করা হলে এটি হবে একটি নিবর্তনমূলক আইন এবং তা যেকোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হবে। অধিকার মনে করে আদিলুর রহমান খান ও অধিকারের মানবাধিকার কর্মীসহ সব মানবাধিকার কর্মী, সংবাদমাধ্যম ও জনসাধারণের কণ্ঠ রোধ করার উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি করে এটি আইনে পরিণত করার চেষ্টা করছে বর্তমান সরকার। অধিকারের কণ্ঠরোধের অপচেষ্টা : বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা-নির্যাতনসহ রাষ্ট্র কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অধিকার-এর সাহসী পদক্ষেপ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার দক্ষতার কারণেই সরকার অধিকার ও এর সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে অধিকার মনে করে। অধিকার-এর স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার কর্মীরা মাঠপর্যায়ে কর্মরত থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে যাকে মূল ভিত্তি ধরে অধিকার প্রতি মাসেই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধের সুপারিশসহ মানবাধিকার প্রতিবেদন সরকারসহ সবার কাছে উপস্থাপন করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অধিকার-এর মানবাধিকার কর্মীদের কাজ করতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছে যে, ২০১৩-এর আগস্ট মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন অধিকার-এর পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠার পর গত ১৯ বছরের মধ্যে এই প্রথম এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে অধিকার বাধ্য হলো। অধিকার আশা করে প্রতিটি মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সপক্ষে মানুষ অধিকার-এর মানবাধিকার কর্মীদের পাশে এসে দাঁড়াবেন ও বর্তমানে এই চরম নিবর্তনমূলক পরিস্থিতির মোকাবেলা করবেন।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads