শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৩

দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন নয়


সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। তিনি বলেন, যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার হচ্ছে না এবং বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ছাড়া এ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না সে কারণে আগামী সংসদ নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দানবের সাথে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে দুই নেত্রীকেই জেলে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভাবছেন তার অধীনে তিনি একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবেন। কিন্তু বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যদি সে নির্বাচনে অংশ না নেয় এবং নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি যদি কম হয় তবে সে নির্বাচন নিরপেক্ষ হলেও দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের ফাঁকা মাঠে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও নিজেদের অগ্রহণযোগ্যতা ও বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে অথবা অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপে সরকারের পতন হবে এবং দানবীয় রূপে আবারো একটি অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারি দলই সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারকে বুঝতে হবে, ১৯৯০-৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর অধীনে কাউকেই জেলে যেতে হয়নি। কিন্তু ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএ ম হাসানকে আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ ভাবতে পারেনি বলে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার সুযোগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দানবীয় রূপে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হয়েছিল। আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে বিচারপতি হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি তরুণ বয়সে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং গত বিএনপি সরকার বিচারপতিদের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে বিচারপতি হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। অর্থাৎ বিচারপতি হাসান যেহেতু তরুণ বয়সে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তাই তিনি নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন করতে পারবেন না। সে সময় বিচারপতি হাসান যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে না পারেন তাহলে এখন প্রধানমন্ত্রী কিভাবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় রয়েছে। কারণ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি সরকারি দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। বিচারপতি হাসান অতীত জীবনে বিএনপি করার কারণে যদি নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে কাজ করতে পারেন এমনটি ভাবা হয় তাহলে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হলে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করবেন না এমনটা নিশ্চিতভাবে ভাবার কোনো উপায় আছে কি? ইতিহাস বলছে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে কখনো জেতেনি বিরোধী দল। আর বিশিষ্টজনদের অভিমত হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের উপযুক্ত নয়। তারা বলছেন, এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সম্মানবোধ নেই। এ দিকে জনগণের দৃষ্টিতে যেটি বিস্ময়কর তা হচ্ছে, যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য এত আন্দোলন সংগ্রাম করলেন তারা কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিরোধী হয়ে গেলেন এবং কেনই বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দানবের সাথে তুলনা করছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার সময় সরকারের পক্ষ থেকে শুধু একটিই কারণ দেখানো হয়েছিল এবং তা হচ্ছে আদালতের রায়। ভাবখানা এমন ছিল যে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধী নয়, কিন্তু আদালত যেহেতু একে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করে দিয়েছেন তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা রাখার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বর্তমানে এসে যখন বলা হচ্ছে যে আদালত তো আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দিয়েছেন সে ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে বাধা কোথায়Ñ তখন সরকারের পক্ষ থেকে ভিন্ন কারণ দেখানো হচ্ছে। সরকার বলছে, বাংলাদেশে এখন দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে এরা উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বলছেন। কিন্তু এসব নির্বাচনে যেহেতু ক্ষমতায় পালাবদল হয় না সেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি থেকে বিরোধী দলগুলো একচুলও সরে আসেনি। এ দিকে প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে নির্বাচনই হবে না তখন জনগণ শঙ্কিত হয়। জনগণের প্রধান চাওয়া হচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, কোনো কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব না হলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে যাবেন। এতে জনমনে শঙ্কা আরো বেড়ে গেছে। বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীকে একই সাথে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করার কথাও ভাবতে হচ্ছে আবার দানবীয় রূপে যাতে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার না আসে সেটিও লক্ষ রাখতে হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, সরকারের প্রথম পছন্দ কোনটি। আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করা নাকি দানবীয় রূপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন রোধ করা। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হওয়ায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করাটা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সরকারের উচিত হবে নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের বিষয়টিকে জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়ে বরং কিভাবে অসাংবিধানিক সরকারের হাত থেকে দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করা যায় সে দিকে মনোযোগী হওয়া। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা ঠিক করাই সরকারের জন্য সঠিক কাজ হবে। পাশাপাশি বিরোধী দলকেও ছাড় দিতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান কে হবেন সে বিষয়ে সমঝোতা হওয়ার পাশাপাশি আরো কিছু বিষয়ে সরকারি দলের সাথে বিরোধী দলের সমঝোতা হতে হবে। যেমন ক্ষমতায় গেলে সরকারি দলের অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতির বিচার করা হবে বলে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যেসব আগাম বক্তব্য দেয়া হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বর্তমান সরকারি দলকে কোনোরূপ হেনস্তা করা হবে না তার নিশ্চয়তা দিতে হবে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে বর্তমান সরকারি দলের নেতাকর্মীরা যে নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হবেন তা থেকে তাদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে ইত্যাদি। এ ছাড়া দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে উভয় দলকে একমত হতে হবে এবং প্রতিহিংসা ও সহিংস রাজনীতি বন্ধে একমত হতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে তাদের মুক্তি দিতে হবে। অর্থাৎ সমঝোতাটি এমন হতে হবে যাতে সরকারি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিরাপদ প্রস্থান করতে পারে এবং নির্বাচনের সময় যাতে সব দলই লেভেল প্লেইং ফিল্ডের সুবিধা ভোগ করতে পারে। বলা হচ্ছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নেগেটিভ ভোটে বিএনপি জয়লাভ করেছে। অর্থাৎ ভোটারেরা বিএনপিকে ভালোবেসে ভোট দেয়নি বরং সরকারি দলের প্রতি অনাস্থা জানাতেই বিএনপিকে ভোট দিয়েছে। এই অনাস্থার কারণ সরকারের সাড়ে চার বছরের দুর্নীতি, দুঃশাসন, অন্যায়, অবিচার ইত্যাদি। শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিডিআর বিদ্রোহ, ভাড়াবিদ্যুৎ, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, টিপাইমুখ বাঁধ, ট্রানজিট, ধর্মদ্রোহী ব্লগার, শাহবাগ আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম, দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বচ্ছতা, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, ছাত্রলীগের সহিংসতা ও বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড, রানা প্লøাজা ধস, আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ ও সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনকারীদেরকে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা, বিরোধী দল-মত দমন ইত্যাদি নানা ইস্যুতে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমে গেছে। ফলাফল হয়েছে এমন যে, মানুষ ভাবছে এ সরকারের হাতে দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অর্থনীতি, মানবাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্ম ইত্যাদি নিরাপদ নয়। এখন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতাসীনরা পরাজয়ের কারণ খুঁজছেন এবং জনগণের কাছে আরেকবার সুযোগ চাইছেন। তবে পরাজয়ের কারণ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারলে জনগণের কাছে হাজারবার সুযোগ চেয়েও কোনো লাভ হবে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ দুই নেত্রীকে সম্মানের চোখে দেখে থাকি। আমরা নিশ্চিত দুই নেত্রী কোনো ভুল করে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইলে জনগণ ক্ষমা না করে পারবে না। আর ক্ষমতাসীনদের উচিত হবে জনগণের এ মনোভাবটিকে কাজে লাগানো। এখনো আওয়ামী লীগের কোটি কোটি ভোটার আছে। তাই সিটি করপোরেশন নির্বাচন ভরাডুবি হলেও জাতীয় নির্বাচন তা না-ও হতে পারে তবে এ ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হচ্ছে, উৎসবমুখর পরিবেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার বিষয়টি। একটি জাতীয় দৈনিকের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান দেখতে চায়। এ দিকে নির্দলীয় সরকার নিয়ে সরকারকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, আমরা দেশে শান্তি ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। আমরা এখনো দাবি করব, নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে আলোচনায় বসুন। আলোচনা না করতে চাইলে আপনারা নিজেরাই সংবিধানের ওই ব্যবস্থা পুনর্বহাল করুন। নইলে আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ তা বাস্তবায়ন করবে। সরকারি দলকে বুঝতে হবে শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে বাধ্য হলে সরকারের নিরাপদ প্রস্থানের বিষয়টি ঊহ্য থেকে যেতে পারে। তাই আমরা মনে করি, শেষ পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে অবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে বিরোধী দলের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে সেই সরকারের প্রধান কে হবেন তা নিয়ে সংলাপের আয়োজন করা। সরকারের এই একটি সিদ্ধান্তই পারে তৃতীয় শক্তির হাত থেকে নিজেদের এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে। সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads