শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৩

সাংবিধানিক সরকার বনাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার


বর্তমান সরকারের আমলে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সাধারণ নির্বাচন বা জাতীয় সংসদের নির্বাচন আদৌ হবে কি না এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী, লেখক, রাজনীতিবিদ ও প্রবন্ধকার কম-বেশি সংশয় প্রকাশ করেছেন। কেননা বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ও বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রীর ইদানীংকার কর্থাবার্তা, বক্তৃতা, বিবৃতি এই আশঙ্কাকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। এক দিকে বিরোধী দলের নেতা তথা ১৮ দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা যে নামেই হোক একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে মর্মে দাবি জানাচ্ছে। অপর দিকে যারা বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এবং দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের মালিক, সেই দল যারা পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন করে সরকারের যে রূপরেখা তৈরি করেছেন তার ভিত্তিতে তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চান। অর্থাৎ উভয় জোট বা মহাজোট যদি তাদের স্ব স্ব অবস্থানে অনড় থাকে তাহলে এ দেশের সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? আমাদের দেশের নামীদামি লেখক, রাজনীতিবিদ ও কলাম লিখিয়েরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে, টকশোর মাধ্যমে সরকার ও বিরোধী দলকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন এই দেশটা আমাদের, আমরা এই দেশের জনগণ আর জনগণের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের অর্থাৎ সরকারের। যদি সত্যিকার অর্থে আমরা জনগণকে ভালোবেসে থাকি, জনগণের কল্যাণে রাজনীতি হয় তাহলে কখনোই কোনো দেশপ্রেমিক সরকার বা বিরোধী দল কেউই অনড় মনোভাব পোষণ করে যার যার অবস্থানে নিশ্চুপ থাকতে পারে না। আশা করব, এ দেশের জনগণের কথা ভেবে অবশ্যই উভয় দল বা জোট একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। আজকে সাংবিধানিক সরকার বনাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা অবশ্য এক দিনে তৈরি হয়নি। বর্তমান সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে দীর্ঘ দিনের পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবে আজ এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমেই অনুরোধ করব সরকারি দলের নেতা যিনি আজকের প্রধানমন্ত্রী, তার মনের মধ্যে যদি কোনো ইগো কাজ করে, তাহলে দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে তিনি সেটা মন থেকে মুছে ফেলবেন। অপর দিকে বিরোধী দলের নেত্রীকেও অনুরোধ করব যদি আপনার মনের মধ্যেও কোনো ইগো কাজ করে আপনি সেটা দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে মন থেকে মুছে ফেলবেন। উভয়ে জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে একে অপরকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করুন, দেখুন আর কোনো সমস্যা সৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকারি দল ও বিরোধী দলের সাথে কিছু মৌলিক বিষয়ে মতভেদ আছে, যা দল দুটোকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এই মতভেদগুলো স্থায়ীভাবে সমাধান হওয়া প্রয়োজন। তাহলে দল দুটির যে মতভেদ বা বৈরিতা তা অনেকাংশে দূর হবে বলে মনে করি। তবে এই মুহূর্তে সেটা দূর করা সম্ভব নয়। কারণ দেশ একটি উত্তপ্ত কড়াইয়ের ওপর বসে আছে। সে বিষয়টি নিয়েই আগে আমাদের ভাবতে হবে। আমাদেরকে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাংবিধানিক সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে বিতর্কে না গিয়ে কিভাবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়া যায়, সে বিষয়ে চিন্তা করার জন্য মহাজোট সরকারপ্রধান ও ১৮ দলীয় জোট নেত্রীকে অনুরোধ করব। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে উদাহরণ টেনেছেন। আমি এখানে সব রাষ্ট্রের নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করব না, শুধু আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচনকালীন অবস্থার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করব। ভারত সর্ববৃহৎ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। তাদের কৃষ্টি, কালচার, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পরীক্ষিত। কিন্তু আমাদের দেশ সেই চর্চা করার সুযোগ পায়নি। কেন পায়নি সেই বিতর্কে যাবো না। তবে এটুকু বলতে পারি, গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে গেলে নিয়মতান্ত্রিকতা ও পরমতসহিষ্ণুতা দরকার সেটা আমাদের মধ্যে বড়ই অভাব। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার সাথে সাথে মন্ত্রিসভা ও পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হয় এবং রাষ্ট্রপতির অনুরোধক্রমে নিয়মতান্ত্রিক সরকারপ্রধান হিসেবে বা রাষ্ট্রীয় রুটিনওয়ার্কগুলো সম্পন্ন করার জন্য এবং নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনসংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী। এখানে উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তখন নির্বাচন কমিশনের প্রধান ছিলেন টি এম সেশন। তার আমলে ইন্দিরা গান্ধীর দল কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছিল। নির্বাচনে জিতে মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে জনতার মোর্চা সরকার গঠন করেছিল। কাজেই আমাদের দেশেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায় (আলোচনার মাধ্যমে) তাহলে বাংলাদেশেও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। তবে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচন করার যে রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে তা বহাল রেখে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন বা নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সদিচ্ছা বর্তমান সরকারকেই দেখাতে হবে এবং বর্তমান পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন করে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন ও একটি নির্বাচনকালীন নিয়মতান্ত্রিক সরকারের রূপরেখা রেখে সংবিধান সংশোধন অবশ্যই প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যদি দেশে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে চান তাহলে তিনি যে অপশক্তির কথা বলছেন তা পরিহার করার জন্য হলেও দেশে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে, সেই ব্যাপারে তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। সময় খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে। যা করার চলতি অধিবেশনেই পদক্ষেপ নিতে হবে সংসদের। তা না হলে আশঙ্কা যদি সত্যে পরিণত হয় তাহলে কেউ রক্ষা পাবে না। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads