শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৩

আমরা মাইনর, আপনি মেজর


১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত ১৭ দিনের যুদ্ধের কথা অনেকেরই মনে আছে। তখন আমি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। যুদ্ধ কী জিনিস তার কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা তখন প্রথম অর্জন করেছিলাম। ৬ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ বাধল কাশ্মিরের কিছু ঘটনা নিয়ে। আমাদের ছোট ফেনী শহরেও সন্ধ্যায় ব্ল্যাকআউটÑ মানে বাতি নিভিয়ে রাখা বা আলো ঘরের বাইরে যেতে না দেয়া, সিভিল ডিফেন্স মহড়া, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের দীর্ঘ মিছিল ইত্যাদির কথা মনে পড়ে। বোধ হয় বিমান হামলার সময়ে আত্মরক্ষার জন্য পরিখাও খুঁড়েছিলেন অনেকে। তখন একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর তরুণ বৈমানিক এবং আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আবদুল মুকিত বিমানবিধ্বস্ত হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। ঘটনাটা তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন বলে শুনেছি। ক্যাপ্টেন মুকিত পরে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন। তিনি ৭২ সালে বাংলাদেশ বিমানের সর্বপ্রথম ফাইটের বৈমানিকদের একজন। যা হোক, তখন টিভির আওতা ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। মানুষের ভরসা হিসেবে রেডিও ছিল খুবই জনপ্রিয়। চট্টগ্রাম বেতারের সম্প্রচার শক্তি সে সময় পর্যাপ্ত থাকায় এই কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেশের অনেক জায়গাতেই শোনা যেত। ৬৫ সালের যুদ্ধের সময়ে রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বিশেষ আকর্ষণ ছিল পুঁথিপাঠ। শত্রুদেশের সাথে লড়াইয়ে মানুষকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করা ছিল এর লক্ষ্য। বাঙালি মুসলিম সমাজে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পুঁথি ছিল সাধারণ মানুষের মাঝে খুবই জনপ্রিয়। এর রেশ রয়ে গিয়েছিল অনেক ক্ষেত্রে। ৬৫-এর যুদ্ধের আগে ফেনীতে আমাদের প্রতিবেশী এক বৃদ্ধকে বাড়ির সামনে গাছতলায় সুর করে পুঁথি পড়তে দেখেছি। ঢাকা বেতারে মাঝে মধ্যে সঙ্গীতশিল্পী আবদুল লতিফ পুঁথি পড়তেন। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বেতারের পুঁথিপাঠ আর ঢাকা বেতার হিং টিং ছটছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। সুর করে সত্যিকারের পুঁথির ভাষায় যিনি চলমান যুদ্ধে স্বদেশের সৈন্যদের বীরত্ব আর প্রতিপক্ষ ভারতের কাণ্ডকীর্তি বয়ান করতেন, তার নাম বেলাল মোহাম্মদ। তার পুঁথিপাঠ শোনার জন্য শ্রোতারা উন্মুখ হয়ে থাকত। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এটা ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এম আর আখতার মুকুল পঠিত চরমপত্র’-এর মতো। অথচ এই পুঁথিপাঠের বিষয়টি কেউ বেলাল মোহাম্মদ স্মরণে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেননি। যা হোক, বেলাল মোহাম্মদ সম্পর্কে জানার সুযোগ না হলেও তার ব্যতিক্রমী নামটা মনে গেঁথে রইল। তিনি আবার বেতার সম্প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তখন ১৯৭১ সালের মার্চ। আর বেতার কেন্দ্রটি রেডিও পাকিস্তাননয়, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। এর যে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠাতা, বেলাল মোহাম্মদ তাদের একজন। চট্টগ্রামে কালুরঘাটের এই বেতার থেকেই মেজর জিয়ার কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা শুনতে পেয়েছিল দেশের অসংখ্য মানুষ। শব্দসৈনিকবেলাল মোহাম্মদ বেশ কিছু দিন অসুস্থ থাকার পর গত ৩০ জুলাই ৭৮ বছর বয়সে ঢাকায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার মৃত্যুসংবাদ মিডিয়ায় গুরুত্ব পেয়েছে। বিভিন্ন মহল জ্ঞাপন করেছে শোক। বেলাল মোহাম্মদের জন্ম প্রাচীন জনপদ সন্দ্বীপের মূসাপুর গ্রামে। এটা উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম জনক, প্রবাদতুল্য ব্যক্তিত্ব কমরেড মুজাফফর আহমদেরও (১৮৮৯-১৯৭০) জন্মস্থান। ১৯৫৩ পর্যন্ত সন্দ্বীপ ছিল নোয়াখালী জেলার একটি থানা। সন্দ্বীপে অনেক আলেমের জন্ম। মুজাফফর আহমদ বাল্যে মাদরাসার ছাত্র ছিলেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে। বেলাল মোহাম্মদের বাবার নাম মৌলভী মোহাম্মদ ইয়াকুব এবং তার এক ভাই বিখ্যাত আলেম বলে শুনেছি। যা হোক, সন্দ্বীপের দুই বেলালবাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সুপরিচিত ছিলেন। রেডিওতে বেলাল মোহাম্মদ এবং টিভিতে বেলাল বেগ (এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী)। ১৯৭৮ সালে বিটিভিতে বেলাল বেগ প্রযোজিত জ্ঞান জিজ্ঞাসাকুইজ অনুষ্ঠানে বিজয়ী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দলের একজন সদস্য হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বেলাল মোহাম্মদের শুধু বেতার-ভূমিকা নয়, ব্যক্তি হিসেবেও তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় এবং মনে রাখার মতো। সুন্দর সুদর্শন স্বাস্থ্যবান মানুষটির ঝাঁকড়া চুল আর ব্র্যান্ডতুল্য লুঙ্গি ছিল মনে রাখার মতো। তাকে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় দেখেছি বোধ হয় কোনো একটি অনুষ্ঠানে। এ দেশের গণমানুষের পোশাক হিসেবে লুঙ্গি তার প্রিয় ছিল। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীরও পোশাক ছিল লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। বেলাল মোহাম্মদের প্রিয় পোশাক ছিল ফতুয়া-লুঙ্গি-চটি। সহজ-সরল, অনাড়ম্বর জীবন কাটিয়ে গেছেন মানুষটি। বেলাল মোহাম্মদ যা বলতেন, আত্মবিশ্বাসের সাথে জোর দিয়ে স্পষ্ট করে ও অকপটে বলতেন। তার লেখাতেও এটা দেখা যেত। তার অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার নিয়ে লেখা তার বইটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এবার তার মৃত্যুর খবরে বিভিন্ন বইয়ের উল্লেখ থাকলেও একটি বইয়ের নাম বেশির ভাগ পত্রিকায় আসেনি। এর নাম আমানটোলার পয়গাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বন্দরনগরীর স্টেশন রোডে পুরনো বইপত্রের একটি দোকানে যেতাম মাঝে মধ্যে। সেখানে অনেক দুর্লভ দেশী-বিদেশী বইয়ের খোঁজ পাওয়া যেত। একদিন একটা বই পেলাম। আকারে ছোট; মলাট বেশ শক্ত। নাম আমানটোলার পয়গাম। ব্যতিক্রমী নামটির সাথে আকৃষ্ট করেছিল আমার বাল্যকালের পরিচিত সেই নামÑ বেলাল মোহাম্মদ। তিনিই এর লেখক। একপর্যায়ে তিনি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার আমানটোলায় এক আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে ছিলেন। তখন তিনি যে মানসিক প্রশান্তি পেয়েছেন, এর অভিজ্ঞতা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন বিস্তারিত জানিয়ে। গত মার্চ মাসে বেলাল মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দিয়েছিলেন তার জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারটি। এতে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে তিনবার দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। এর আগে কালুরঘাটের সেই সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে কয়েকজনের কণ্ঠে স্বাধীনতার বার্তা পঠিত হয়েছিল। বেলাল মোহাম্মদ বলেছিলেন, এ দিক দিয়ে জিয়া নবম ব্যক্তি হলেও মর্যাদার দিক দিয়ে তার অবস্থান ছিল শীর্ষে। কেননা আমরা তখন যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলাম, পাকিস্তানি আর্মি দ্বারা আক্রান্ত ছিলাম। বেঘোরে মারা যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বঙ্গবন্ধুর দলেও যে আর্মি আছে, তা জিয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়েই মানুষ বুঝতে পারে। জনগণের মনোবল বাড়ানোর জন্য জিয়ার ঘোষণা দরকার ছিল।বেলাল মোহাম্মদ মনে করেন, তখন আকস্মিক ঘটনাপ্রবাহে জিয়াসহ তারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তার ভাষায়Ñ সে দিন (২৭ মার্চ ৭১) দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় অবস্থানরত জিয়াকে আনতে গিয়েছিলাম। তাকে আমি বেতার কেন্দ্রে এসে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের প্রস্তাব করি। বেলাল মোহাম্মদ বলেন, ‘জিয়াকে সে দিন বলেছিলামÑ আমরা যারা বেতার কেন্দ্রে রয়েছি, আমরা মাইনর, আপনি মেজর। ২৭ মার্চে জিয়ার কণ্ঠে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা শোনা যায়। বেলাল মোহাম্মদ জানান, “২৮ মার্চ দুপুরে এবং ২৯ মার্চ শেষবারের মতো জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ২৮ তারিখের ড্রাফটটিতে নিজেকে প্রফেশনাল হেড এবং চিফ অব বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মিহিসেবে পরিচয় দিয়ে বিদেশীদের কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা বলা হয়। বোধ করি, ড্রাফটটি তৎকালীন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়াই লিখেছিলেন। জিয়া নিজেকে ওই পরিচয় দেবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে বোঝানো হয়, সাহায্য চাইতে হলে এমন পরিচয় দিতে হবে। এমন অবস্থায় জিয়া বিষয়টি নিয়ে আমার কাছে জানতে চাইলে আমি বলি, আপনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষের হয়ে তা বলতে পারেন।২৯ মার্চ জিয়ার পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণা প্রখ্যাত শিল্পপতি ও সাবেক রাজনীতিক আবুল কাসেম খান (এ কে খান) লিখে দিয়েছিলেন। বেলাল মোহাম্মদও এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। এ কে খান অতীতে মুসলিম লীগ করলেও ৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক ছিলেন। বেলাল মোহাম্মদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, জিয়াউর রহমানের গুরুত্ব ছিল বলেই তিনি নিজে চট্টগ্রাম শহর থেকে পটিয়া গিয়েছিলেন জিয়াকে আনার জন্য। তখন সেনাবাহিনীর মেজর পদও বাঙালির জন্য ছিল বড় ব্যাপার। একটি মহল অপপ্রচার চালিয়ে আসছে, ‘জিয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের এবং তাকে জোর করে রেডিও স্টেশনে ধরে আনা হয়। এমনকি সম্প্রতি রাজনৈতিক বিদ্বেষবশত বলা হয়েছে, জিয়া ছিলেন রাজাকার।আবার এটাও বলা হয়ে থাকে, ‘জিয়া নিজেই নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারে।এসব প্রচারণা কতটা সত্য এবং প্রকৃত ঘটনা কী, তা অনেকটা উপলব্ধি করা যায় বেলাল মোহাম্মদের লেখা থেকে। বিশেষ যে তথ্য তিনি দিয়েছেন, তা হলোÑ জিয়াকে লিবারেশন আর্মির প্রধান হিসেবে উল্লেখ করে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা লিখে দিয়েছিলেন সম্ভবত সুবিদ আলী ভূঁইয়া। তিনি চট্টগ্রামের কুমিরার লড়াইয়ের জন্য খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা। পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নাসিমের অভ্যুত্থানপ্রয়াস ব্যর্থ করে দেয়ার অন্যতম নায়ক। তিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগের একজন এমপি। বেলাল মোহাম্মদ ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে যোগ দেয়ার পরের বছরই ৬৫ সালের যুদ্ধের সময় তার নামটি সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল। সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সুনামও অর্জিত হয়েছিল সেই যুদ্ধের সুবাদে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাঞ্জাবের খেমকারান সেক্টরে জিয়ার নেতৃত্বে অকুতোভয় বাঙালি সৈন্যরা ভারতের সামরিক অভিযানকে যেভাবে নস্যাৎ করে দিয়েছিল, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাঙালি Martial Race বা যোদ্ধা জাতি নয়Ñ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর এ ধারণাকে সে দিন জিয়ার মতো সৈনিকেরা ভুল প্রমাণ করেছিলেন। মরহুম বেলাল মোহাম্মদ জিয়ার ভক্ত কিংবা তার দলের সমর্থক ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। এই প্রেক্ষাপটেই তার বক্তব্য মূল্যায়ন করতে হবে। তিনি ২৭ মার্চ ৭১ সালে জিয়াকে বলেছিলেনÑ ‘আমরা মাইনর, আপনি মেজর।এখানে মেজর বলতে নিছক পদবি নয়, জিয়া গুরুত্বপূর্ণÑ এটাই বোঝাতে চেয়েছেন। বাস্তবেও জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে এবং পরে এই স্বাধীনতা সুসংহত করার সংগ্রামে অখ্যাতনয়, প্রখ্যাত মেজরহয়ে উঠেছিলেন।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads