শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

ষোল কোটি মানুষকে অসম্মান করবেন না


দেশের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটায় সরকারের শীর্ষ মহল হতাশায় নিপতিত হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছেন বলে পর্যবেক মহল মনে করছে। তার বক্তব্যে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বেশি কথা বলায় অভ্যস্ত প্রধানমন্ত্রী তার দলীয় প্রার্থী পরাজয় বরণ করায় ভোটারদের একহাত নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আপে করে বলেছেন, তার প্রার্থীরা সবাই সৎ ও যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও জনগণ তাদের ভোট না দিয়ে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের জয়যুক্ত করেছে। ুব্ধ হয়ে বলেছেন, তাহলে এত উন্নতি করলাম কেন? প্রয়োজনে রোজার পরে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং কুইক রেনটাল বন্ধ করে দেবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। এ ধরনের বক্তব্যে সারা দেশের মানুষ হতবাক। ভোট জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। বলা হয়ে থাকে, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব।’ এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত গর্বের সাথে বলেন, তিনি জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছেন। এর আগে সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশালে তার প্রার্থীদের মহাভরাডুবিকে হজম করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, দেখছেন না, আমরা ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছি। এই সরকারের অধীনে নিরপে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব, কিন্তু গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কী এমন ঘটল যে, তিনি দেশের ১৬ কোটি মানুষকেই হুশিয়ারি দিয়ে বসলেন। সরকারপ্রধান হয়ে এ ধরনের কথা কতখানি যুক্তিযুক্ত কিংবা ন্যায়সঙ্গত, তা নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ১৬ কোটি মানুষকে অসম্মান করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি আওয়ামী লীগ নেত্রী যা বলবেন, তা-ই মানতে হবে কিংবা যাকে সমর্থন দেবেন, তাকেই ভোট দিতে হবে? এ ছাড়া তিনি তার কথার মধ্য দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হেয় করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, জনগণ যাদের ভোট দিয়েছে, তারা দুর্নীতিবাজ এবং অসৎ চরিত্রের লোক। অথচ আইন অনুযায়ী, আদালত কর্তৃক কেউ দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যাবে না। সাধারণ লোক হয়তো নানা কথা বলতে পারেন, কিন্তু দেশের একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কী করে এ ধরনের বেআইনি কথা বলা সম্ভব? আমরা সংসদে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী নিজে অযৌক্তিকভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার জন্ম নিয়ে অত্যন্ত জঘন্য ও অরুচিকর ভাষায় কথা বলেছেন। সংসদ নেতা যখন সংসদে অসংসদীয় বক্তব্য রাখেন, তখন অন্যান্য এমপি চুপ করে থাকবেন কেন! তারাও আপত্তিকর ভাষায় সংসদে কথা বলার প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন। একপর্যায়ে সরকারি দলের তরুণ সংসদ সদস্য জুনাইদ আহমদ পলক প্রস্তাব দিলেন, আপত্তিকর বক্তব্যের জন্য প্রতি শব্দের বিপে ত্রিশ হাজার টাকা করে জরিমানার ব্যবস্থা করা হোক। পরের দিন বিএনপির পে ব্যারিস্টার মওদুদ যখন এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন, তখন সরকারি দল পিছু টান দেয়। মওদুদ বললেন, সংসদের রেকর্ড পরীা করে ব্যবস্থা নেয়া হোক। এই ব্যবস্থা নেয়া হলে সর্বপ্রথমে ফেঁসে যেতেন ক্ষমতাসীন নেতা-নেত্রীরাই। সম্ভবত বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে আর কথা বলেননি। তাকে অনেকেই বেশি কথা বলার জন্য সমালোচনা করেন। বিশেষ করে এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান লন্ডনে একটি মিডিয়ার সাথে সাাৎকালে এটা বলেছেন। এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর তিনি সরকার সমর্থকদের রোষানলে পড়েন। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালতে গড়ায়। মাফ চেয়ে কোনো মতে রা পান মাহফুজ। দলনেত্রীর অতি কথনে খোদ আওয়ামী লীগ নেতাদেরও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। শোনা যায়, প্রধানমন্ত্রীকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানকে ‘উপহার’ দিতে চেয়েছিলেন দলের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ। তার সাথে ছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তোফায়েল বলেছিলেন, গোপালগঞ্জের পরেই গাজীপুর আওয়ামী লীগের দুর্গ।’ তাই যে করেই হোক গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জয় তাদের চাই। তিনি এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে জানান, যদি প্রশাসন তার সাথে থাকেন’ তাহলে তিনি গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জয় এনে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী এতে সায় দেন এবং হাসিমুখে বলেন, ঠিক আছে, প্রশাসনের সহায়তায় জয় পেলে হয়তো সাময়িক বদনাম হবে। কিন্তু মেয়রতো আমরা পাব। (তথ্য সূত্র : দৈনিক মানবজমিন)। প্রধানমন্ত্রীর মতে, এখানে জয় পেলে এটা হবে সরকারের টার্নিং পয়েন্ট এবং জাতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। মোদ্দা কথা, গাজীপুরে জয় পাবেনÑ এমন নিশ্চিত ভরসায় তিনি লন্ডনের উদ্দেশে খুশি মনে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু গাজীপুরের জনগণ এই প্রত্যাশা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ান। প্রশাসনের হর্তাকর্তারা গণবিােভের ভয়ে বেশি দূর এগোতে পারেননি। ভোট কারচুপির জন্য চারটি পন্থা সরকারপ অবলম্বন করলেও জনগণের সচেতনতা ও ঐক্য তা ব্যর্থ করে দেয়। আওয়ামী ঘরানার লেখক, বহু আলোচিত-সমালোচিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লন্ডন থেকে একটি কলাম লিখলেন, যা ভোটের দিনেই (৬ জুলাই) দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। তিনি তাতে লিখেছেন, গাজীপুরে আওয়ামী লীগই গাজী হবে এবং সরকার একটি দিকনির্দেশনা পাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথিত কিনম্যান চরিত্রের উন্মোচন ঘটলেন। তিনি নাকি গাফ্ফার সাহেবকে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন, গাজীপুরে জয় আমাদের নিশ্চিত, গাফ্ফার ভাই, আপনি লন্ডনে অবস্থানরত নেত্রী শেখ হাসিনাকে এই সুখবরটি জানিয়ে দিন।’ এসব ঘটনার পরিপ্রেেিত যখন গাজীপুর হাতছাড়া হয়ে যায়, তখনি প্রধানমন্ত্রী ুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে উপরে উল্লিখিত বক্তব্যে। সরকারি নেতারা বলছেন, তারা পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন থেকে শিা নিয়ে ভুল-ত্র“টিগুলো শোধরাবেন। এ েেত্র বলতে হয়, জামায়াত-শিবিরের ওপর নজিরবিহীন নির্যাতন, মাওলানা সাঈদীর মুক্তির মিছিলে নির্বিচারে গুলিবর্ষণে গণহত্যা, ঢাকার মতিঝিলে শাপলা চত্বরে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে হেফাজতের সমাবেশে যৌথবাহিনীর গুলিবর্ষণ এবং অজ্ঞাতসংখ্যক আলেমকে হত্যা, এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারি মহলের হাস্যরস এবং সংসদে প্রধানমন্ত্রীর মর্মান্তিক তামাশা (তিনি বলেই বসলেন, হেফাজতিরা গায়ে রং মেখে শুয়ে ছিল এবং কোনো গুলিই ফোটেনি), হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হত্যা, গুম, বিরোধী দলের ওপর অকথ্য নির্যাতন, দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া, সারা দেশকে এক ধরনের কারাগার বানানো, ইত্যাকার বহু ঘটনা থেকে কি সরকার তথা আওয়ামী লীগ শিা নেবে? আত্মসমালোচনা না করে প্রতিপকে ধ্বংসের কিংবা নির্মূলের নকশা প্রণয়ন করে শেষ রক্ষা করা যায়ে না। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর কোনো নির্যাতক শক্তি সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। অন্যায় অবিচার যখন সীমা অতিক্রম করে, মজলুম জনতার আর্তনাদ যখন আল্লাহর আরশে পৌঁছে যায়, তখন প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। জোর যার মুল্লুক তারÑ এই নীতি কখনো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। জোর করে পাওয়া যায় না মানুষের ভালোবাসা। দেশের মানুষকে হুমকি দিলে মতা চিরস্থায়ী হয় না। ইতিহাসে এর অনেক স্যা বিদ্যমান। তাই অনুরোধ, মতার অহমিকায় আত্মশুদ্ধি যদি নাই করতে পারেন, অন্ততপে মানুষকে অসম্মান করবেন না। ইতিহাসের পাতায় অবিবেচক শাসকদের ঠিকানা সুখের হয়নি। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads