শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩

আগামী নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে


যেকোনো নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জানতে পারলে সেটি রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বর্তমানে একটি রাজনৈতিক দল সামনের নির্বাচনে তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে গেছে। তাই আগামী নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল দুই মেরুতে অবস্থান করছে। ফলে আগামী নির্বাচন যথাসময়ে হবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে। সবার মধ্যেই একটা অজানা শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা কাজ করছে। একাধিক রাজনৈতিক নেতা দেশে নির্বাচন না হওয়ার আশঙ্কা করছেন। হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলছেন, দেশে নির্বাচন না-ও হতে পারে, কাজী জাফর আহমদ ও কর্নেল অব: অলি আহমদ দেশে নির্বাচন না হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন; এরা অভিজ্ঞ রাজনীতিক, তাদের কথার অবশ্যই তাৎপর্য আছে। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি ফয়সালা না করে সংসদ ভেঙে দিলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা ভেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা রীতিমতো আতঙ্কিত। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন এক ভয়ানকপর্যায়ের দিকে চলে যেতে পারে যে, তখন কারো কাছেই কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না; নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারে ওঁৎ পেতে থাকা বাইরের অপশক্তির হাতে। সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে নির্বাচন না হওয়ারই ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে সংসদে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক চাইলে দেশে নির্বাচনই হবে না। তার এ কথায় রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এটি পরোভাবে নির্বাচন না হওয়ারই আলামত হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে প্রতীয়মান হয়। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের সমীকরণও একটি জটিল অঙ্কে রূপ নিয়েছে। চারটি প্রতিষ্ঠিত ভোটব্যাংক এক দিকে রোখ নিয়েছে। জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকলেও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা ১৮ দলীয় জোটের পে অবস্থান নিয়েছেন। তাই এরশাদ মহাজোটে থাকলেও তার ভোটব্যাংক ১৮ দলীয় জোটের দিকেই থাকবে বলে প্রতীয়মান হয়; গাজীপুর সিটি নির্বাচন সেই ইঙ্গিতই দিয়েছে। অন্য দিকে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামÑ এই তিন শক্তির ভোটব্যাংকও এখন এক প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ। সামনের জাতীয় নির্বাচনে এই চার ভোটব্যাংক এক পে থাকলে, এটিকে মোকাবেলা করার মতাসীন দলের জন্য অসাধ্য। কেননা তাদের মাত্র একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। ১৪ দলে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দলের ভোটব্যাংক নেই। সুতরাং চারটি ভোটব্যাংক মোকাবেলা করা মতাসীন দলের পে নিঃসন্দেহে অসম্ভব। ভোটব্যাংকের এ জটিল অঙ্কের হিসাবে, নির্বাচনের আগেই ফল কী হবেÑ তা আঁচ করা অসম্ভব নয়। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচন নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা থাকাই স্বাভাবিক। নির্বাচন না হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে স্বপদে বহাল থাকার এখতিয়ার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সুনিশ্চিত করা হয়েছে। এ সংশোধনী একটি দুরভিসন্ধিকে সামনে রেখেই করা হয়েছে; যাতে দেশে নির্বাচন না হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অনন্তকাল পদে বহাল থাকতে পারেন। এমন সুধিবা সংবিধান যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে, সেখানে পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে কেন তিনি নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে যাবেন? প্রধানমন্ত্রী যখন মনে করবেন তার দল নির্বাচনে জেতার মতো পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখন তিনি নির্বাচনের কথা চিন্তা করতে পারেনÑ ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইলে দেশে নির্বাচন হবে না’ এ কথার তাৎপর্য এখানেই। এখন প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী কি দেশে নির্বাচন না দিয়ে পারবেন? তখন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কি তার হাতে থাকবে? দেশের জনগণ নির্বাচনের পে অবস্থান নিলে তিনি একা কী করবেন? মনে রাখতে হবে, নদীর স্রোত ও বাতাসের গতিবেগ যেমন আটকে রাখা যায় না, তেমনি মানুষের আবেগও আটকে রাখা যায় না; নির্বাচনের জন্য মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছে, চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ততা তার সুস্পষ্ট উদাহরণ। নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো পথে পা বাড়ালে, জনগণ দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত বলেই প্রতীয়মান হয়; কাজেই একটি পপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই চলমান সঙ্কট সমাধানের একমাত্র পথ, এর মাধ্যমেই শান্তিপূর্ণভাবে মতার হাতবদল হতে পারে। দেশ ও মানুষের ভালো চাইলে এ পথকেই অনিবার্য মনে করতে হবে মতাসীনদের। বাংলাদেশকে ঘিরে পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তির বিশেষ তৎপরতা লণীয়। মতার হাতবদলকে পুঁজি করে তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া। এ সময়কে এরা মোম সময় মনে করে মতার হাতবদলকে জটিল করার কাজে রত আছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এরা চায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে কর্তৃত্ব কায়েম করতে; এরা চায় বাংলাদেশের তেল-গ্যাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। আর এসব করতে হলে রাজনীতিকে অশান্ত করে তুলতে হবে; মতার হাতবদলই রাজনীতিকে অশান্ত করার মোম সময়। অশান্ত রাজনীতিই সব কিছু তছনছ করতে পারে, তৈরি করতে পারে সুযোগের ত্রে; আর এ সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করতে প্রস্তুত পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তি। এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা কি তাদের এ সুযোগ তৈরি করে দেবেন? যদি না দিতে চান তাহলে জাতীয় স্বার্থে অন্তত রাজনীতিবিদদের এক হতে হবে, মতার হাতবদলকে শান্তিপূর্ণ করতে হবে; প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করতে হবে, পরমতসহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে হবে। গণতন্ত্রকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ও গণমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ কায়েমÑ এসব একসূত্রে গাঁথা; এসব পূর্বপরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। এ পরিকল্পনামাফিকই শাসকদল অগ্রসর হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না এলে অসাংবিধানিক সরকারের হুমকি দিচ্ছে। শাসকদলের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, রাজনীতিতে অশুভ শক্তির উথানের পথ প্রশস্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়; কেননা খোদ রাজনীতিবিদদের জন্যই তা ভয়ঙ্কর, আগে-পরে রাজনীতিবিদেরাই এর শিকার হবেন। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এসব নিঃসন্দেহে অশনি সঙ্কেত! রাজনীতিতে যদি পরমতসহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রতিষ্ঠিত না হয়, তা হলে কোনোভাবেই দেশে শান্তি বিরাজ করবে না। আর শান্তি বিরাজ না করলে, একটি দেশ তার নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে সামনে অগ্রসর হতে পারবে না। দেশটি আলোর মুখ দেখার পরিবর্তে ঘোর অনিশ্চয়তা ও অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবেÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাস্তবেও আমরা তাই দেখছি! অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতি সুকৌশলে উসকে দেয়া হচ্ছে। রমজান মাসেও মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেয়া হচ্ছে না। এ পবিত্র মাসেও নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে। এটি নিঃসন্দেহে রাজনীতির অনিশ্চিত গন্তব্যের আলামত। অনিশ্চয়তার মধ্যেই হয়তো মতাসীনেরা একটা নিশ্চয়তার পথ খ্্ুঁজতে পারে, যেমনটি এক-এগারোতে হয়েছিল। এই বিপজ্জনক পথে মতাসীনেরা যদি দেশকে ধাবিত করে, তাহলে তাদের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন দেখা দেবে। গণমাধ্যম তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেবে। তাই গণমাধ্যমকে কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে কিছু গণমাধ্যম বন্ধ করা হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় গত কয়েক মাসে প্রচুর সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, প্রচুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একই জাতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে এই আত্মঘাতী ঘটনা খুবই দুঃখজনক। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে বোঝা যায়, মতার পালাবদলকে কেন্দ্র করে কৌশলে জাতিকে ভয়ানক বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে; যাতে এ জাতি বিপন্ন জাতিতে পরিণত হয়। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ; জনগণকে বিপন্ন করে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না, এর ফলে এক সময় এ রাষ্ট্রও বিপন্ন হবে। কাজেই রাজনৈতিক সহিংসতায় আর যাতে কোনো প্রাণ ঝরে না যায়, আর যাতে কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads