রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৩

নির্বাচনের আগে দেশে আরো রক্ত ঝরবে?


 সমূহ সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ এখন নানা সমস্যার দেশ। সমস্যা সমাধানের চেয়ে সমস্যাকে আরো জটিল করে তোলায়ই যেন আমাদের আগ্রহ সমধিক। ফলে সমস্যাগুলো রূপ নিচ্ছে সঙ্কটে। সঙ্কট থেকে জনমনে সৃষ্টি হচ্ছে সংশয়-শঙ্কা। এই সংশয় আর শঙ্কা জাগছে প্রধানত রাজনৈতিক জটিলতা থেকেই। সংবিধান অনুযায়ী আমাদেরকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে আসছে ডিসেম্বর-জানুয়ারির দিকে। কিন্তু এ নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটছে না। যারা এ অনিশ্চয়তা কাটানোর দায়িত্ব বহন করেন, তাদের কথাবার্তায় মনে হয় এরা এর সমাধানে আগ্রহী নন। বরং এরা এমন সব কথাবার্তা বলছেন, যা সংশয়-সন্দেহের মাত্রা শতগুণে বাড়িয়ে তোলে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এমন একটি বক্তব্যের অবতারণা করেন, যা নিয়ে আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারপক্ষের ভাবসাব বেশি ভালো নয় বলেই মনে হয়। মনে হচ্ছে ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। তিনি বলেছেন, তার কাছে তথ্য আছে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় থাকবে। বিরোধী দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে তার কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছেÑ যেখানে সম্প্রতি পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের কাছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা গো-হারা হেরেছেন, সেখানে সজীব ওয়াজেদ এমন কী জাদুর কাঠি পেলেন, যা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে দেবে? এ প্রশ্নের উত্তর সজীব ওয়াজেদ দেননি। তবে এর উত্তর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের আরো কয়েকজন শীর্ষ সারির নেতা। তবে আশ্চর্যজনক হলো, তাদের কারো জবাবের সাথে কারো জবাবের বিন্দুমাত্র মিল নেই। এতে করে মনে হয়, বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে যে বলা হলো, সজীব ওয়াজেদের এই বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, সরকার আগামী নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে, তা অমূলক নয়। নইলে ওইসব নেতার বক্তব্য ভিন্ন ভিন্ন হবে কেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা ষড়যন্ত্র করে অভ্যস্ত, তারাই সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথায় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতেই আমার ছেলে জয় বলেছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসবে। তিনি বলেন, জনমত জরিপে দেখা গেছে, জনমতের দিক থেকে আওয়ামী লীগ এগিয়ে আছে এবং এই দলের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা আছে। জরিপ মতে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভালো করবে এবং নির্বাচনে জিতে আবার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেননি তিনি কোন জরিপের কথা বলছেন। আর জরিপ কারা পরিচালনা করেছে। আর জরিপটি যদি এতটাই নির্ভরশীল জরিপ হয়, তবে তা প্রকাশ করা হলো না কেন? প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, জরিপের তথ্য আছে যে আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় আসবেÑ দলটির পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য দেয়া হচ্ছে কেবল তাদের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে। কিন্তু এতে তাদের হারানো উদ্যম ফিরে আসবে না। মিডিয়ায় প্রকাশিত জরিপের সাথে সরকারের জরিপের কোনো মিল নেই। অপর দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন ভিন্ন কথা। তার কাছে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে তিনি নির্বাচনে তার দলের বিজয়ী হওয়ার গন্ধ পাচ্ছেন। দেশের সাধারণ মানুষ আসলেই জানে না, তার এ গন্ধ পাওয়ার শানে নজুল কী! গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনে চরমভাবে পরাজিত হওয়ার পরমুহূর্তেই যখন সৈয়দ আশরাফ বিজয়ের গন্ধ পান, তখন জনমনে নির্বাচন নিয়ে সরকারি দলের ষড়যন্ত্রের সন্দেহ আরো জোরালো হয়। প্রধানমন্ত্রী যেখানে বললেন তার দলের কাছে জনমত জরিপের তথ্য আছে সেখানে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বললেন, তার কাছে কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি কি রহস্যময় এক বৈপরীত্য নয়? তিনি কথাটা বলেছেন এভাবেÑ ‘আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে বলতে পারি, আগামী দিনে নির্বাচন হবেই। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে গন্ধ পাচ্ছি আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় যাবে।গোটা জাতি জানে না আগামী নির্বাচন হবে কি হবে না। হলেও কিভাবে হবেÑ দলীয় সরকারের অধীনে না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। সে প্রশ্নের সমাধান হলো না। সরকারি দল বলছে, দলীয় সরকারের অধীনেই হবে আগামী নির্বাচন। বিরোধী দল বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেÑ আগামী নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে আরো রক্ত ঝরতে পারে। আর তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা চলতি বছরের শেষ দিকে। এর পরও সৈয়দ আশরাফ কোন খুঁটির জোরে বলছেন, আগামী নির্বাচন হবেই আর সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে আবারো ক্ষমতায় যাবে? আসলে তার বক্তব্য সংশয়ের মাত্রা আরো বাড়ায় বৈ কমায় না। অর্থমন্ত্রীর কথাও সংশয় বাড়িয়ে তোলে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, সে ধরনের কোনো তথ্য তার কাছে নেই। তবে তার বিশ্বাস আছে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে। তিনি জয়ের বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলেন, তার বক্তব্যের দুটি অর্থ হতে পারে। হয়তো তার কাছে কোনো জরিপ আছে। অন্যটি ভাষার ব্যবহার। সে অন্যভাবে বলতে পারত যে, আমার বিশ্বাস বা আমার মনে হয় আবার ক্ষমতায় আসবে আওয়ামী লীগ। এভাবে একেক নেতার একেক কথা সংশয় কাটানোর পথে বাধা হিসেবেই কাজ করছে। এ ধরনের সংশয় জাগার যথেষ্ট কারণ আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক পর্যবেক্ষকসহ অনেকেই মনে করছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংশয় সৃষ্টির পেছনে বেশ কিছু যৌক্তিক কারণও রয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বর্তমানে যে সংবিধান রয়েছে, তা নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করলে প্রথমত সেখানেই বড় ধরনের হোঁচট খেতে হয়। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ ভেঙে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বর্তমান সংসদ, প্রধানমন্ত্রীসহ তার মন্ত্রিসভা সব কিছুই এখন যেভাবে আছে, নির্বাচনের সময় সে রকমই থাকবেÑ সংবিধানে সোজাসাপটা এ কথাই বলা আছে। সংবিধানে স্পষ্টভাবে এও বলা আছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পরবর্তী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। কিন্তু সংসদ ভেঙে নির্বাচন করতে হলে কিভাবে কখন নির্বাচন হবে। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, সেই সরকারের হাতে কী কী ক্ষমতা থাকবে বা সেই সরকারের দায়িত্বই বা কী হবে, সংবিধানে এর কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়। যদি কোনো কারণে যথাসময়ে কিংবা কয়েক বছরেও নির্বাচন না হয় তাহলে কী হবে, সে ব্যাপারেও সংবিধানে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই বলে অভিমত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। সেদিকে সরকারপক্ষের কোনো নজর নেই। রাতদিন শুধু একই জপÑ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, এর বাইরে আর কিছুই মানা হবে না। কিছু দিন আগে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের চরম পরাজয়ের ঘটনা থেকে এরা শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের পথ রচনা করবেÑ এমনটিই প্রত্যাশা করেছিল দেশের মানুষ। কিন্তু সরকারি দলের ক্রিয়া-বিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, সরকার আগের পথ থেকে এক পা-ও সরে আসেনি। বিরোধী মত-পথের দল-গোষ্ঠী দমনে এখন এরা আরো বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সরকারবিরোধী ইসলামপন্থী অনেক দল-সংগঠনকে এখন ইফতার মাহফিল পর্যন্ত করতে দেয়া হচ্ছে না। সার্বিক দিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে, সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিরোধী দল বিএনপির বিজয়ের বিষয়টি এক দিক থেকে বিরোধী দলের জন্য ক্ষতিই হয়ে গেল। কারণ, সরকারি দল-জোট এ নির্বাচনের ফল দেখে ধরে নিয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ ও এর নেতৃত্বাধীন জোটের নিশ্চিত ভরাডুবি হবে। তাই সরকার কিছুতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নিতে রাজি হচ্ছে না। বরং বলা যায়, তা করতে সাহস পাচ্ছে না। পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস, সরকার যদি এই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে, তবে চলতি বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশের রাজপথে আরো রক্ত ঝরতে পারে। এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচও। এই আশঙ্কা প্রকাশ করে সংস্থাটির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের আগে আরো রক্তক্ষয়ী সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী প্রায়ই রাজপথে বিক্ষোভের বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে। যে কারণে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নিহত হয়েছে অন্তত ১৫০ জন। আহত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু দেশটির সরকার সত্যিকার অর্থে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহির ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে চলতি বছর রাজপথে আরো অনেক রক্ত ঝরবে। অপর দিকে ব্রিটিশ পত্রিকা ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে ভবিষ্যতে আরো রক্তক্ষয়ী হিংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, গত কয়েক মাসে রাজপথে অনেক প্রাণহানির পর আগামী জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আরো হিংসাত্মক পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মীরা। গত বৃহস্পতিবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর ওয়েবসাইটে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজপথে বিক্ষোভ ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কিত ৪৮ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রিপোর্টটির শিরোনামÑ ‘ব্লাড অন দ্য স্ট্রিট : দ্য ইউজ অব এক্সেসিভ ফোর্সেস ডিউরিং বাংলাদেশ প্রটেস্টস। এই প্রতিবেদনটি তৈরির পদ্ধতি-প্রকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে পরিচালিত গবেষণার ওপর ভিত্তি করে। সংস্থাটি ঘটনার শিকার ব্যক্তি, পরিবার সদস্য, বিভিন্ন সাক্ষী, মানবাধিকার কর্মী, কূটনীতিক ও আইনবিদের ৯৫টি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রিপোর্টটি তৈরি করে। সংস্থাটি এ প্রতিবেদন তৈরিতে বিভিন্ন সরকারি ভাষ্য ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্য উদঘাটনমূলক রিপোর্ট ব্যবহার করে এসবের ওপর নিজেদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাপেক্ষে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সংস্থা সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনার টেলিভিশন ও ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করে। বহু বিতর্কিত হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের ক্র্যাকডাউনের ব্যাপারে এই সংস্থা এই সিকিউরিটি অপারেশনের সংবাদ সংগ্রহে যুক্ত আটজন সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার নেয়। এসব সাংবাদিক সরকার-সমর্থক ও সরকারবিরোধী উভয় ধরনের গণমাধ্যম সংস্থায় কর্মরত। সেই সাথে এদের মধ্যে আছেন আন্তর্জাতিক মিডিয়া আউটলেটের সাংবাদিকও। তা ছাড়া এরা হাসপাতালের রেকর্ডপত্র পরীক্ষা করাসহ চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে। যারা সাক্ষাৎকার ও সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা যাতে সরকারের রোষের শিকার হয়ে শাস্তি না পান, সে জন্য এই সংস্থা তাদের নাম প্রকাশে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের সাক্ষাৎকার ও সাক্ষ্য গ্রহণ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরো অসংখ্য অভিযোগ পায় এই সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সদস্যদের খুন, গুম ও গণগ্রেফতারের। কিন্তু রিসোর্স ও লজিস্টিকের সীমাবদ্ধতার কারণে এই সংস্থা এসব অভিযোগ স্বতন্ত্রভাবে তদন্ত করে দেখতে পারেনি। এই প্রতিবেদনে তাই তাদের অভিযোগের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই সংস্থা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি দিয়ে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। এই চিঠির একটি কপিও উল্লিখিত প্রতিবেদনে সংযোজিত হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই ৪৮ পৃষ্ঠার সুদীর্ঘ প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায় সংশ্লিষ্ট বিক্ষোভ ও সহিংসতা, হেফাজতের বিক্ষোভ সমাবেশ ও সহিংসতা, বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন, গণমাধ্যমের ওপর সরকারি চাপ ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে সরকারের কাছে একটি সুপারিশমালাও পেশ করা হয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ফেব্রুয়ারিতে বৃহত্তম বিক্ষোভ হয়। জামায়াতে ইসলামের এক সিনিয়র নেতাকে মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলে এর প্রতিবাদে অনেক লোক রাস্তায় নেমে আসে। জামায়াতের সমর্থকেরাও পরে হরতালের ডাক দেয়। এতে সহিংসতার সৃষ্টি হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যু দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সারা দেশের গ্রামগঞ্জ ও শহরের লোকেরা রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। নিরাপত্তা বাহিনী ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত জামায়াতের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে কয়েক ডজন লোককে হত্যা করে। এতে আহত হয় আরো শত শত মানুষ। এসব বিক্ষোভকারীরা ছিল নিরস্ত্র। তাদের কাছে ছিল ভাঙা ইটের ঢিল ও লাঠিসোটা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ ও ৬ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ঘটে। নিরাপত্তা বাহিনী লাখ লাখ বিক্ষোভকারীর মোকাবেলা করে। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ দৃশ্যত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে, তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে পুলিশের বল প্রয়োগ ছিল বেআইনি। এ ঘটনায় অন্তত ৫০ জন নিহত ও দুই হাজারেরও বেশি আহত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানতে পেরেছে, পুলিশ আটক লোকদের পিটিয়েছে, অনেককে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেছে। ১২ বছরের একটি ছেলে জানায়, দুই গজ দূর থেকে তার বুকের ওপর ছয়টি গুলি করে তাকে মৃত ভেবে অন্যান্য লাশের ওপর ফেলে রাখা হয়। বিক্ষোভকারী ও গণমাধ্যমের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছে এ ঘটনার পর। বিরোধী দলের সমর্থক দুটি টেলিভিশন- ইসলামিক টিভি ও দিগন্ত টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পুলিশ গ্রেফতার করেছে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। বিরোধী দলের পত্রিকা অফিসে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সুদীর্ঘ এই প্রতিবেদনের বিস্তারিতে যাওয়ার অবকাশ নেই এই লেখায়। তবে এই প্রতিবেদনে যা প্রকাশ করা হয়েছে, তা সরকারের বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। হেফাজতের ঘটনা সম্পর্কে সরকারি দলের নেতাদের নানাজনকে নানা কথা বলতে শোনা গেছে। কেউ বলেছেন, হেফাজতের সমাবেশে একটি গুলিও চলেনি। কিন্তু দৈনিক যুগান্তর লিখেছে, ৫ মের অপারেশনে প্রায় এক লাখ ৫৫ হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ খরচ হয়। এর বেশির ভাগই খরচ হয় অপারেশন সিকিউরড শাপলায়। অভিযানের সময় আহতাবস্থায় হেফাজতের অনেক নেতাকর্মীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। অথচ সরকারি দলের নেতাদের কেউ বলেছেন, ওই ক্র্যাকডাউনে একটি লোকও মারা যায়নি। একজন এমপি বলেছেন, হেফাজতের সমাবেশে একজনও মারা যাওয়ার কথা প্রমাণ করতে পারলে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। জানি না, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই প্রতিবেদন পড়ে এখন তিনি কী করবেন। তা ছাড়া আমরা জানি না, দ্রুত একটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও স্বাধীন কমিশন গঠন করে ব্যাপক হত্যা ও আহত হওয়ার এ ঘটনা তদন্ত করার যে সুপারিশ করা হয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে, সরকার তাতে সাড়া দেবে কি না। সর্বোপরি এই সংস্থা আগামী নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে আরো রক্ত ঝরার যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, সে আশঙ্কা দূর করার লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বিরোধী দলের সাথে একটি সমঝোতার প্রয়াস নেবে কি না। মনে করিয়ে দিই, সরকার সমর্থক একটি জাতীয় দৈনিকের জরিপ মতে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ চায় আগামী নির্বাচন হোক নির্দলীয় সরকারের অধীনে। জানি না, এ ব্যাপারটি সরকারি দল কতটুকু আমলে নেবে। তবে জানা দরকার, দেশের মানুষ এখন উন্মুখ হয়ে আছে আগামী নির্বাচন সব দলের অংশ নেয়ার মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হওয়ার প্রত্যাশায়। এরা মুক্ত হতে চায় নির্বাচন সম্পর্কিত যাবতীয় আশঙ্কা থেকে। জানি না, এ ক্ষেত্রে যার যা করণীয়, তা তারা করবেন কি না।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads