বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৩

উৎপাদনের রাজনীতি ও জিয়াউর রহমান


পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসব্যাপী রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আওয়ামী লীগ মতায় গিয়ে শাসনকার্য পরিচালনায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল। পরে সেনাবাহিনীর একাংশের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। এতে সপরিবারে শেখ মুজিব নিহত হন। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এর এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া বন্দী হন। কিন্তু ৭ নভেম্বর সাধারণ সেনাসদস্যরা তাকে মুক্ত করেন। এরপর জিয়া মতাকে আরো সুসংহত করেছিলেন। এ সময় জিয়া উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ লাভ করেন। পরবর্তীকালে এক ঘোষণার মাধ্যমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়াবিরোধী কয়েকটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান সত্ত্বেও সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এতে জনগণের  মধ্যে তার একটি ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। ১৯৭৬-এর জুলাই মাসে দেশ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিকাশের এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। এক বছর বিরতির পর সামরিক সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কর্মতৎপরতা পুনরায় শুরু করার অনুমতি দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি সায়েম কর্তৃক ঘোষিত রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে দলগুলোকে দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনাসহ দলের ল্য, উদ্দেশ্য, কর্তব্য এবং বাস্তব সম্ভাবনা সুস্পষ্টভাবে সরকারের সামনে উপস্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় মতায় অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং অর্থনীতি পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতি জিয়ার বিভিন্ন পদপে দেশ ও বিদেশে প্রশংসিত হয়।
জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। তিনি সব সময় ভাবতেন, কিভাবে নিজস্ব আঙ্গিকে জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলা যায়।
তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সৈনিক নেতা, অর্থনৈতিক েেত্র বৈপ্লবিক সংস্কারক ও সর্বোপরি রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন। দেশের উন্নয়নের ল্েয যে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, তার আলোকেই দ্বিবার্ষিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রণীত হয়েছিল। এর উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৭৮ সাল থেকে কার্যকর হওয়া পরিকল্পনা কমিশনের দলিলে। বিএনপি গঠনের পর ১৯ দফাকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯ দফা কর্মসূচি এখানে তুলে ধরা হলো :
সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রা। ২. সংবিধানের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলিত করা। ৩. সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। ৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে উন্নয়ন কার্যক্রমে ও আইনশৃঙ্খলা রার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা। ৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যেন ভুখা না থাকে তার ব্যবস্থা করা। ৭. কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সবার জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা। ৮. কোনো নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে তার ব্যবস্থা করা। ৯. দেশকে নিররতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। ১০. সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ১১. সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং যুবসমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা। ১২. অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান। ১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। ১৪. সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তি উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন। ১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ। ১৬. সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বিশেষ জোরদার করা। ১৭. প্রশাসন ও উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। ১৮. দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতি ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। ১৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা।
১৯ দফা কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ছিল : উন্নয়নের হার বাড়ানো, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ল্েয পরনির্ভরশীলতা কমানো, আয়ের সুষম বণ্টন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এ জন্য দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ, নিররতা দূরীকরণ, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রফতানি আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামের জনগণকে সম্পৃক্ত করে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত করা ছিল পরিকল্পনার অন্যতম ল্য। বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের অগ্রণী ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এ ছাড়াও ব্যাপক খাল খনন কর্মসূচি, স্বনির্ভর প্রকল্প এবং বৃরোপণ কর্মসূচিরও তিনি ছিলেন প্রধান প্রবক্তা।
গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন : জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার উৎস ছিল গ্রামবাংলা। এ চিন্তাধারা থেকেই তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সূচনা করেন। তার পদেেপই গ্রামসরকার, ভিডিপি, যুব কো-অপারেটিভ কমপ্লেক্স নামক গ্রামকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম শুরু করে। পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। এর ফলে গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সূচিত হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
বিশেষ ঋণ বিতরণ কর্মসূচি : পল্লীর সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য জিয়ার আগ্রহে ১৯৭৭ সালের ফেব্রয়ারিতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য কৃষকদের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ১০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ বিতরণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। একজন কৃষক নির্ধারিত ঋণ পরিশোধ করে বছরে তিনটি ফসলের জন্য ঋণ নিতে পারতেন। এই কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য ছিল, ঋণ নেয়ার জন্য জমি ব্যাংকে দেয়ার প্রয়োজন হতো না এবং বর্গাচাষিসহ জমির মালিক চাষিও এ ঋণ নিতে পারতেন।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি : ভিুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি জাতীয় আন্দোলন হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচির সূচনা।
খাল খনন কর্মসূচি : জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির েেত্র এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লব হিসেবে দেশ ও বিদেশে অভিহিত হয়েছিল। এর আওতায় তিনি খাল খনন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা, সেচের পানির স্বল্পতা, পানিসম্পদ সংরণ এবং উপযুক্ত ব্যবহারের অভাব ইত্যাদি দৃষ্টিকোণ েেত্র খাল খনন কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী পদপে। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে জিয়াউর রহমান সারা দেশে এ কর্মসূচির সূচনা করেন।
গ্রামসরকার প্রতিষ্ঠা : গ্রামসরকার শহীদ জিয়ার গ্রামকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনারই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৭৬ সালে গ্রাম পরিষদ গঠন করা হলেও তা পার্লামেন্টারি অ্যাক্ট ৯-১এর আওতায় ১৯৮০ সালে গ্রামসরকার হিসেবে কাজ শুরু করে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে জিয়া গ্রামকে মৌলিক ইউনিট হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রামসরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
শহীদ জিয়াউর রহমানের গ্রামকেন্দ্রিক এ ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচিকে বিশ্লেষকেরা উৎপাদনের রাজনীতি হিসেবে অভিহিত করে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে তা ব্যাপক অবদান রেখেছিল বলে জিয়ার প্রশংসা করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জনকল্যাণমূলক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ও  গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে। এ জন্য দেশ ও বিদেশে তার শাসনামল যথেষ্ট প্রশংসিত হয়।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads