শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩

শান্তি-স্বস্তির অভাব প্রকট হয়ে উঠছে



রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ক্রমবর্ধমান সহিংস ঘটনা, বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মী হত্যা ও একের পর এক প্রাণহানিতে জনমনে নিরাপত্তার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। সেই সাথে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, ছাত্র-যুবক, সাংস্কৃতিক কর্মী, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার, অপহরণ, গুম, খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, দখলবাজি এবং সরকারের নির্দেশে দেশব্যাপী পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্যের মতো নজিরবিহীন ঘটনা নাগরিক উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে গেছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, কয়েক মাস ধরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে উপরের নির্দেশে পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের কর্মকর্তা ও সদস্যদের সদা সর্বদাই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এ কারণে অপরাধ পরিস্থিতি দিনের পর দিন খারাপ হচ্ছে। পাশাপাশি আওয়ামী সরকারের শেষ সময়ে এসে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুলিশের মধ্যে একশ্রেণীর আওয়ামীপন্থীদের চরম বাড়াবাড়ির কারণে গোটা বাহিনীতে অসন্তোষ ও শিথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অবনতিশীল পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, সারাদেশে সশস্ত্র সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, দখলবাজি, অপহরণ, খুন ও গুমের মতো গুরুতর অপরাধকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করলে বর্তমান পরিস্থিতি চূড়ান্তভাবে খারাপের দিকে। অথচ দেশের চলমান বাস্তবতাকে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি বলে মানতে চান না আওয়ামী স্বৈরশাসক ও মহল এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহল। তারা মনে করেন, এক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যা ঘটছে তাতে কোনো কিছু ব্যাহত হচ্ছে না। তবে পুলিশের সাবেক একজন আইজিপি মনে করেন, কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মনে করেন, জনমনে যখন নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতির সৃষ্টি হয় তখন তা মানবাধিকার পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শংকাহীন জীবনের অধিকার, মানবাধিকার। এটি যখন মুখ্য হয়ে উঠে তখন অন্য অধিকারগুলো গৌণ হয়ে যায়। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, দেশে এ অবস্থা চলতে থাকলে উৎপাদন ও রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কাজেই পরিস্থিতির উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ও সরকারি মহলকে দ্রুত বাস্তবোচিত কার্যকর উদ্যোগ, পদক্ষেপ নিতে হবে।
বর্তমান আওয়ামী সরকারের শাসনামলে খোদ রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অপহরণ, খুন, গুম ও পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য নতুন কোনো অপরাধ নয়। গত চার বছরেরও বেশি সময় ধরেই এসব অপরাধমূলক ঘটনাবলী নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গত কয়েকদিনে সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই আহমেদ মিরাজ, কুমিল্লার বিএনপি নেতা ইব্রাহীম আলী মৃধা, নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মোহাম্মদ ত্বকীসহ কয়েকটি খুনের ঘটনা নতুন উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও ২০১২ সালে বনানীর রাস্তা থেকে গাড়ীচালকসহ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলম এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী ছাত্রসহ গত কয়েক বছরে শত শত ব্যক্তির গুম হওয়ার ঘটনা এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। জাতীয় সংসদে দেয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবরণ অনুযায়ী, ২০১২ সালে দেশে ৪ হাজার ১১২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১১ জনের বেশী মানুষ খুন হয়েছে। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৯৬৫ জন এবং ২০১০ সালে ৩ হাজার ৯৮৮ জন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, ২০১১ সালে ৭২৫ জন অপহৃত হয়েছে। ২০১২ সালে শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অপহৃত হয়েছে ৫৬ জন। র‌্যাবের সূত্র অনুযায়ী, গত বছর অপহরণ ছাড়াই নিখোঁজ রয়েছে ১৫০ জন। অপহরণের পর খুন হয়েছে ২৪ জন। এ বছর শুধু জানুয়ারী মাসেই ২৩ জন অপহরণ ও নিখোঁজ হয়েছে। অপহরণের পর খুন হয়েছে ৬ জন। এদিকে গত পক্ষকালব্যাপী সারাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ, সহিংসতার প্রেক্ষিতে সরকারি দলের কর্মী-ক্যাডার নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও পুলিশের নির্বিচার গুলী, হত্যা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের নজিরবিহীন গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। জামায়াত-ছাত্রশিবির ও বিএনপির নেতা-কর্মী, সমর্থকসহ সাধারণ মানুষকে গণগ্রেফতারের পাশাপাশি চলছে গ্রেফতার বাণিজ্যও। উল্লেখিত সময়ে জামায়াত-ছাত্রশিবির ও বিএনপির ১২৫ জন নেতা-কর্মী পুলিশের গুলীতে নিহত হয়েছেন। সরকারি হিসাবে জামায়াত-ছাত্র শিবির ও বিএনপির ১৪ হাজার ২৫৮ জন নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অন্যদিকে ঐ সময়ের ৬২টি মামলায় জামায়াত-ছাত্রশিবির ও বিএনপিসহ ১৮ দলীয় গণতান্ত্রিক জোটের ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৮০ জন নেতা-কর্মীকে আসামী করে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সহায়তায় একশ্রেণীর আওয়ামীপন্থী পুলিশ রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে গ্রেফতার বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে। মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মুসল্লি, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, আলেম-ওলামা, নানা বয়সের যুবক, নিরীহ পথচারীসহ নির্বিচারে পুলিশী গ্রেফতারের ফলে এই বাণিজ্য রমরমা বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রের নাগরিকদের জানমালের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের সংবিধানিক দায়িত্ব হওয়া সত্ত্বেও আধিপত্যবাদী আগ্রাসী অপশক্তির গোপন মদদে বর্তমানে উদ্বেগজনক বাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে বলে সচেতন নাগরিকদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। বর্তমান সরকারের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করণের হীন উদ্দেশ্যে দলীয় নেতা-কর্মী নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছে ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের ওপর। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন ও জামায়াত-ছাত্রশিবির-বিএনপির আটক নেতা-কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, সভা-সমাবেশের ওপর পুলিশের নির্বিচার বাধাদান, গুলীবর্ষণ, হত্যা, ভাংচুরের ঘটনায় জনগণ হতবাক হয়ে পড়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশব্যাপী রাজনৈতিক খুন, গুম, অপহরণের অবসানের পরিবর্তে বেড়ে যাওয়ার ফলে দাগী সন্ত্রাসীরা আস্কারা পাচ্ছে। রাজনৈতিক মূল পরিস্থিতির ফায়সালা সরকার এগিয়ে এসে না করলে সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতি আশা করা যায় না। তবে সরকারের ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক কারণে দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ অহেতুক ভোগান্তি পোহাবে এটাও কোনো বিবেচনাতেই কাম্য হতে পারে না। ইতোমধ্যেই নিরাপত্তাহীনতার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে।
আশংকা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকেই যাবে। আওয়ামী সরকার ও মহল লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার হীন উদ্দেশ্যে গণগ্রেফতারের জন্য পুলিশকে বেপরোয়া ক্ষমতা দান, গ্রেফতার বাণিজ্যের অন্যতম কারণ। সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের নির্দেশে পুলিশ গণতন্ত্রকামী জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলী চালিয়ে গণহত্যার মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করার প্রবণতায় নাগরিক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি করেছে। এই অবস্থায় নাগরিক জীবনে শান্তি, স্বস্তি প্রতিষ্ঠায়, গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায়, নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে, মানবাধিকার সুরক্ষায়, আটক বিরোধীদলীয় সকল নেতা-কর্মীর নিঃশর্ত মুক্তি দান, সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করার জন্য সরকার ও সরকারি মহলকেই দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ, পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads