মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০১৩

সরকারের মিডিয়া পলিসি



গত রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় সম্মানিত সম্পাদকরা রাজনৈতিক সঙ্কট ও হত্যাকা-সহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তাদের বক্তব্যে বিরোধী দলের ওপর চালানো দমন-নির্যাতনের পাশাপাশি প্রাধান্য পেয়েছে বিশেষ করে হত্যাকা- এবং মিডিয়া। তারা জনপ্রিয় দুটি টিভি চ্যানেল দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন নিষিদ্ধ করার এবং দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথারীতি সরকারের ভাষ্যই তুলে ধরেছেন। বলেছেন, দৈনিক আমার দেশ নাকি সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দিয়েছিল বলেই এর সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়েছে। দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন প্রসঙ্গে তিনি অবশ্য পাশ কাটিয়ে গেছেন। আমরা বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, গত ৬ মে গভীর রাতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী যখন মতিঝিলে অবস্থানরত হেফাজত কর্মীদের ওপর অভিযান চালাচ্ছিল তখনই হঠাৎ করে দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণসংস্থা বিটিআরসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে গোয়েন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা সরাসরি গিয়ে কন্ট্রোল রুমে ঢুকে পড়েছেন এবং চ্যানেল দুটির সুইচ বন্ধ করে দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশের চিঠি দেখানো দূরে থাকুক, চ্যানেল দুটির কাউকে কোনো কথা বলারও সুযোগ দেননি তারা। পরদিন তথ্যমন্ত্রী কারণ সম্পর্কে যা জানিয়েছেন সেটাও গ্রহণযোগ্য হয়নি। এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন নাকি ‘দায়িত্বশীলতার’ পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে! বন্ধ করার ব্যবস্থাটাও নাকি সাময়িক! তথ্যমন্ত্রী না বললেও সত্য বেরিয়ে আসতে কিন্তু দেরি হয়নি। জানা গেছে, ক্ষমতাসীনদের ও তাদের সমর্থকদের মালিকানাধীন টিভি চ্যানেলগুলো যেখানে ‘এমবেডেড’ রিপোর্টারদের দিয়ে যৌথ বাহিনীর ইচ্ছানুযায়ী অভিযানের সীমিত ও খুবই বাছাই করা কিছু দৃশ্য দেখাচ্ছিল দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের রিপোর্টাররা সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিযানের বিভিন্ন দৃশ্য দেখানোর পাশাপাশি সবিস্তারে ঘটনার বর্ণনা করছিলেন। এটাই আসলে ছিল দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের ‘অপরাধ’! এমনটি করেছিল বলেই চ্যানেল দুটির বিরুদ্ধে ‘দায়িত্বশীলতার’ পরিচয় না দেয়ার বিচিত্র অভিযোগ আনা হয়েছে। ওদিকে দৈনিক আমার দেশ-এর ব্যাপারেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সত্য বলেননি। দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের আসল কারণ সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দেয়া নয়। ঘটনাপ্রবাহে জানা গেছে এবং প্রমাণিতও হয়েছে, তাকে আসলে অন্য একটি বিশেষ কারণেই গ্রেফতার করা হয়েছে। সে কারণটি বহুল আলোচিত স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করা। সে অভিযোগে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মতো গুরুতর একটি মামলা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকার আমার দেশ-এর প্রেসেও তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। স্কাইপের সংলাপের জন্য মূল দায়ী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে বিচারপতি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। সরকার উল্টো তাকে হাই কোর্টে বসিয়ে দিয়েছে। আমার দেশ এবং মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে এর আগেও অভিযোগ আনা হয়েছে। তারও আগে-পরে চ্যানেল ওয়ানকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। যমুনা টিভিকে আলোর মুখ দেখতে দেয়নি। শীর্ষ নিউজসহ আরও কয়েকটি গণমাধ্যম সরকারের কালো থাবার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এভাবে সব মিলিয়েই প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গণমাধ্যম মোটেও স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারে না। এ শুধু এখনকার জন্য সত্য নয়, স্বাধীনতার পর শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আমলেও একই অবস্থা দেখা গেছে। বর্তমান সরকার সবদিক থেকে তার পূর্বসূরিকেই অনুসরণ করে চলেছে মাত্র। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর মধ্য দিয়ে আরও একবার এ সত্যই প্রমাণিত হলো যে, আওয়ামী লীগ সরকার আসলেও ফ্যাসিস্ট নীতি অনুসরণ করে চলেছে। এজন্যই সরকারকে গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরার ব্যাপারে সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন দেখা যাচ্ছে। সরকার এমনকি সংবিধানের নিষেধাজ্ঞারও তোয়াক্কা করছে না, যেখানে পরিষ্কার ভাষায় লেখা আছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং কোনো গণমাধ্যমকে বন্ধ করা যাবে না। সরকার মিডিয়ার ব্যাপারে সংবিধানও লংঘন করেছে। আমরা মনে করি, পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় সম্মানিত সম্পাদকরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সরকারের উচিত তার প্রতি যথোচিত মনোযোগ দেয়া এবং গণমাধ্যমের ওপর হামলা ও নিষ্ঠুর আচরণ বন্ধ করা। সরকারকে একই সঙ্গে অবিলম্বে দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে হবে, মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে এবং খুলে দিতে হবে দৈনিক আমার দেশ-এর ছাপাখানা। আমরা আশা করতে চাই, মিডিয়ার স্বাধীন অবস্থানের প্রশ্নে দেশের সম্মানিত সম্পাদক এবং সাংবাদিকরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠবেন এবং দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন ও দৈনিক আমার দেশ-এর পক্ষে দাঁড়াবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads