মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০১৩

উত্তর-আধুনিকতার স্বরূপ


তীব্র যন্ত্রণা মানুষকে অনুভূতিহীন করে ফেলে। এর দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা এখন যেন এই পর্যায়ে। অবশ্য ুদ্র ক্ষমতাবান গোষ্ঠী এ হিসাবের বাইরে। কারণ তাদের সৃষ্ট এই যন্ত্রণার সায়রেই নিমজ্জিত ও নিথর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। মানুষ এক যন্ত্রণার রেশ কাটিয়ে উঠতে-না-উঠতেই আর এক যন্ত্রণার সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন এই যন্ত্রণার আলয় সৃষ্টি করছে ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাসীনেরা। সাভারের ভয়াবহ ঘটনার যাতনার মাঝেই আবার সৃষ্টি হলো শাপলা চত্বরের ঘটনা। রিমান্ডে নেয়া দুর্ভাগা অভিযুক্তদের ক্রমপর্যায়ে নিথর-অনুভূতিহীন হয়ে যাওয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে এসব ভয়াবহতা। দেখা যায়, রিমান্ডে অত্যাচারের মাত্রা এমন অবস্থার মাঝ দিয়ে পরিচালনা করা হয় যেন অভিযুক্তের অনুভূতি নিথর না হয়। যদি তা হয়, তাহলে তাকে ফেলা হয় সরিয়ে। এটা আধুনিক কালের উন্নত প্রযুক্তির ফসল।

আজকের ভাবনা এই আধুনিক ও উত্তর-আধুনিকতা নিয়েই। সাভারের দালান ধসে এবং তার সাথে মৃত্যুর ভয়াবহ অবয়বের ধীর প্রকাশ সারা বিশ্বকেই চমকে দিয়েছে। বিশ্বসংবাদমাধ্যমে এটাকে এখন সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ঘটনা নানা প্রশ্নের যেমন জন্ম দিয়েছে, তেমনি ক্ষমতাবান-ক্ষমতাসীনদের সত্যিকার স্বরূপের কিঞ্চিত স্পট ছবিও উপহার দিয়েছে। বলা হয়, মানুষ তার সবচেয়ে দুঃসময় ও সবচেয়ে আনন্দের সময়ে তার চরিত্রের বিপরীতমুখী স্বরূপের খণ্ডাংশের সঠিক প্রকাশ অজান্তেই করে থাকে। এবারের সাভারের ও শাপলা চত্বরের ঘটনাবলিতে এর প্রতিফলন ঘটল। ক্ষমতাবানেরা তাদের চেহারার একটু ঝলক দেখাল। আর ক্ষতিগ্রস্তরা হলো নির্বাক, নিথর; যেন রিমান্ড ফেরা অভিযুক্ত। ঠিক এমন চিত্রই বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক দার্শনিক জুলিয়েন বেন্ডা এঁকেছিলেন তার সাড়া-জাগানো ‘লা থ্রাইসোঁ দে কার্ক’ (বুদ্ধিজীবীদের বিশ্বাসঘাতকতা) বইটিতে। বেন্ডা ইহুদি বংশোদ্ভূত। কিন্তু তিনি ছিলেন মানবতার প্রবক্তা। বিশেষ করে তিনি ুব্ধ ছিলেন বুদ্ধিজীবীদের ওপর। ‘যে মানুষেরা কাজ করবে জনগণের আবহমান মূল্যবোধ নির্মোহ অবস্থার মাঝ দিয়ে যেন সাধারণ মানুষ জীবনের সত্যিকার স্বাদ পায়, তারাই বুদ্ধিজীবী। কিন্তু এরা এখন জাগতিক স্বার্থের জন্য এ দায়িত্ব শুধু এড়িয়েই যাচ্ছে না, বরং তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে’, বেন্ডা মন্তব্য করেছেন। তিনি রাজনীতিতে নৈতিকতার প্রবল প্রবক্তা ছিলেন। যেমন প্লেটোর অবস্থান ছিল ‘নৈতিকতা রাজনীতি নির্ধারণ করে।’ এমনটি মেকিয়াভ্যালির সময় পর্যন্ত চালু ছিল। মেকিয়াভ্যালি বলল, ‘রাজনীতির সাথে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নাই এবং এর মূল চালিকা হলো শক্তি।’ তার শিক্ষা এবং বক্তব্য বিশ্বরাজনীতির ভয়াবহ স্বরূপের সাহায্যকারী হয়ে উঠল এবং ক্রমান্বয়ে গতিময় হলো। আর এতে ঘৃণাও যোগ হলো। দার্শনিক-লেখক মশিয়েঁ চার্লস সরোসের তত্ত্ব ফরাসি তথা পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিই নৈতিকতার বিধায়ক।’ বেন্ডা মন্তব্য করেছেন, ‘এর ফলে রাজনীতির মন্দকে (ইভিল) ভালো ভাবতে বাধ্য করা হয়।’ অর্থাৎ রাষ্ট্র যখন অন্যায় করে অথবা সরকার ক্ষতিকারক কিছু করলে, তখন তাকে নৈতিকতার নিরিখে না দেখে, ‘রাজনীতি’ হিসেবে গণ্য করার তাগিদ আসে। তাই সরকার অথবা রাষ্ট্র যদি তার স্বার্থ অথবা ক্ষমতাকে নিরুপদ্রব রাখতে অন্যায়, হত্যা ইত্যাদির আশ্রয় নেয়, তখন তাকে রাজনীতি বলে চালিয়ে দেয়া হয় এবং এতে বুদ্ধিজীবীরা (একাংশ) অংশগ্রহণ করে বলে বেন্ডা নিন্দা করেন। কারণ তার মতে, বুদ্ধিজীবীরা হলো ন্যায়পরতা, সততা, সুবিচার ও অনুসন্ধানের স্বাধীনতার ধারক, বাহক এবং মুখপাত্র। অথচ তাদের এই ভূমিকা পরিত্যাগ করে আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা রাজনৈতিক উঞ্ছবৃত্তিতে মনোনিবেশ করে জনজীবন অস্থির করে তুলছে বলে বেন্ডা নিন্দা করেছেন। এখন বুদ্ধিজীবীরা কায়েমি স্বার্থবাদী ও ভোগবাদী রাজনীতির আজ্ঞাবহ, ধারক ও বাহক হয়েছেন। জনকল্যাণকামী সত্যসন্ধানী প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে তারাই স্তব্ধ করতে চাইছেন।
জুলিয়েন বেন্ডার বক্তব্যের প্রতিফলন যেন ঘটল সাভার ও শাপলা চত্বরের জীবনধ্বংসী ভয়াবহ ঘটনাগুলোর মাঝদিয়ে। এখানে সবাই দর্শন করল সেই প্রাজ্ঞ গ্রিক বক্তব্যের সঠিক প্রকাশ। ‘মানুষ তার সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে খারাপ সময়ে তার স্বরূপের এক ঝলক দেখায়।’ এখানে অত্যাচারিতরা জীবন দিতে বাধ্য হলো, চিরাচরিত অভ্যাসের মতো সৃষ্টিকর্তার কাছে স্বস্তি ও শান্তির জন্য প্রার্থনা করল, অবশেষে জীবনের প্রান্ত থেকে হারিয়ে গেল। অন্য দিকে এ ভয়াবহ ঘটনার নায়কেরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান। তারা নৈতিকতাকে ভয় পায়, এমনকি ঘৃণা করে। তারা নিজেদের চরিত্রের ঝলক দেখাল। হিটলারের নীতি অনুসরণ করে মিথ্যাচার করল, দোসরদের লেলিয়ে দিলো। যেহেতু রাষ্ট্রশক্তি তাদের সেবায় নিয়োজিত, তাই প্রতিবাদী কণ্ঠও নীরব হয়ে গেল। অর্থাৎ সেই ‘সুপ্রিম টেস্টে’ ক্ষমতাবানেরা তাদের চরিত্রের প্রধান ও প্রথম ঝলক শক্তির অপব্যবহার, মিথ্যা ও অশিষ্টাচারের ঝলক দেখাল। তারা ধ্বংসের জন্য দায়ী করল অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও ক্ষতিগ্রস্তদেরকেই। বেন্ডার ভাষায়, তাদের বুদ্ধিজীবীরাও একই তরঙ্গে বক্তব্য দিলো। সাধারণের যন্ত্রণাকে আরো তীব্র করল।
ঐতিহাসিকভাবেই দেখা গেছে, অত্যাচারিত মানুষ নীরবে যন্ত্রণা সয় এবং আত্মার কাছে সান্ত্বনা খোঁজে। কেউ সেই সান্ত্বনার বাণী শোনালে সেখানে ছুটতে থাকে। আর আত্মার সান্ত্বনা শুধু ধর্ম শেখায়। রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষমতাবান অংশ সেখানে অনুপস্থিত একই কারণে। তারা ব্যস্ত থাকে ক্ষমতার প্রয়োগ ও রক্ষায়। প্রতিটি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় নিজেদের লাভ-লোকসানের নিরিখে। এখানে নৈতিকতা, মানবিকতা, জীবনের সত্যিকারের মূল্যায়ন অনুপস্থিত।
এবারো পুরনো নাটকের বিভিন্ন অঙ্কের অভিনয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এক অঙ্কে সেই প্রাজ্ঞ গ্রিক বর্ণনার মতো কর্মকাণ্ড হচ্ছে। এখানে ভীতির রাজ্য কায়েম করা হয়েছে। গ্রিক প্রজ্ঞায় বলা হয়েছিল, ‘ক্ষমতাবানেরা যখন অনুধাবন করতে শুরু করে যে, তাদের ক্ষমতা-শোষণের বলয় সীমিত হয়ে পড়ছে কেননা, অত্যাচারিতরা সংগঠিত হচ্ছে, তখন তারা পাগলামি শুরু করে এবং নানা অসম্ভব ও অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। অস্থিরতা, অত্যাচার ও অনাচার দিয়ে ভীতির রাজ্য কায়েম করে নিজেদের রক্ষার প্রয়াসে। এ রাজ্য অবশেষে তাদেরকেও গ্রাস করে।’
অন্য একটি অঙ্কে ক্ষমতাবান-তাদের সুশীলসমাজসহ নানা বক্তা দু’টি শব্দ জোরালোভাবে ব্যবহার করছেন। শব্দ দু’টি হলো ‘সন্ত্রাস’ ও ‘মধ্যযুগ’। এ দু’টির ব্যবহার নানা আঙ্গিকে বিভিন্ন যুগে করা হয়েছে। অধুনা এর প্রয়োগে প্রধান উদ্যোক্তা ও প্রবক্তা পশ্চিমা শক্তিবর্গ। তাদের অন্যায় অধিকার ও শোষণকে ঢাকতে নিজেদের সন্ত্রাসকে অত্যাচারিত ও শোষিতদের ওপর চাপিয়ে দেয়। প্রচার ও শাসন তাদের কাছে বন্দী বলে সত্য প্রকাশ সম্ভব হয় না এবং প্রতিবাদকে ‘সন্ত্রাস’ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য এ কর্মকাণ্ডে আধুনিক কালের প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব পারঙ্গম।
আবার ‘মধ্য’যুগের সাথে ‘সন্ত্রাস’কেও জুড়ে দেয়া হচ্ছে। যেমন ক্ষমতাবানেরা ধার্মিক বা নৈতিকতা ও মানবতার প্রবক্তা এবং অত্যাচার-অনাচারের প্রতিবাদীদের শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত করে তা নির্মমভাবে স্তব্ধ করে দেয়া হয়। প্রচার এমন তুঙ্গে নেয়া হয় যে, সাধারণ পাঠকেরা ভাবতে শুরু করেÑ এসব প্রতিবাদীর জীবনের প্রয়োজন নেই। তখন রাষ্ট্র ও ক্ষমতাবানেরা ক্ষমতা রক্ষার জন্য এসব প্রতিবাদীকে জীবন থেকে সরিয়ে দেয়। শুধু যে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতালোভীরাই এমন কর্মকাণ্ড করছে তা নয়। ধনী দেশের ক্ষমতাবান ও তাদের সুশীলসমাজ জীবনের মূল্যায়ন ‘আমরা এবং ওরা’ দিয়ে নির্ধারণ করছে। মার্কিনি ওয়েব স্লেটের অন্যতম লেখক ম্যাট ইগলেসিয়াস সম্প্রতি বাংলাদেশের গার্মেন্টকর্মীদের হত্যাকাণ্ডের ওপর লিখতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘একজন বাংলাদেশী গার্মেন্টকর্মীর জীবনের মূল্যের সাথে একজন মার্কিন কর্মীর জীবনের মূল্যের তুলনা করা ঠিক হবে না। কারণ বাংলাদেশীরা গরিব।’ অবশ্য এ বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করেছেন একজন বিখ্যাত কলামিস্ট রিচার্ড এসকো। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা যখন কোনো জীবনকে সস্তা করো, তখন সব জীবনকেই সস্তা করে ফেলো।’ বক্তব্যটি অত্যন্ত সত্য ও শক্তিশালী। তবে ক্ষমতাবানদের কাছে সত্য সদা অগ্রহণীয় এবং তিক্ত। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের নির্বাচিত স্বৈরাচারী শাসকদের কাছে। তাই সংবাদমাধ্যম ও সব প্রচারযন্ত্রের কড়া নিয়ন্ত্রণ তারা করে থাকে। যে সংবাদমাধ্যম সামান্যতম সত্য বলার চেষ্টা করে, হয় তাকে স্তব্ধ করে দেয় নতুবা তীè নজরদারিতে রাখে। অবশ্য এসব স্বৈরাচারী ক্ষমতায় থাকতে হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক অথবা বিশ্বমোড়লদের কিছু এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হয়। যেমন এখন কোনো মুসলমান হলেই তাকে জঙ্গি বা মৌলবাদী বা তালেবান হিসেবে নাজেহাল করতে হবে। যে-কেউ তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে জীবনধারণ করতে চাইলে তাকে তালেবান বা জঙ্গি বলে নির্মম অত্যাচারের শিকার হবে বা রাতের অন্ধকারে হত্যা করলেও আঞ্চলিক বা বিশ্বমোড়লেরা কিছু বলবে না। আর স্বৈরাচারী ক্ষমতাবানেরা চালিয়ে যেতে পারবে তাদের শোষণ-শাসন-লুণ্ঠন। ফলে তৃতীয় বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে একই সময়ে বিপরীতমুখী কর্মকাণ্ডের সম্মুখীন হয়ে নিরবিচ্ছন্ন অসন্তোষ ও অশান্তির মাঝে জীবন যাপন করতে হয়।
এবারের শাপলা চত্বরের ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাবানেরা এবং তাদের সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা এবং সংবাদ-প্রচারমাধ্যম ‘মধ্যযুগের’ মাতম তুলেছেন। শাপলা চত্বরের বিশাল বিশ্বাসী জমায়েত ক্ষমতা দখল করতে চায়নি। তারা বিশ্বাসের ভিত্তিতে জীবনধারণের অধিকার চেয়েছিল। ক্ষমতাবান ও তাদের বুদ্ধিজীবীরা বলতে শুরু করলেন, এরা দেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে চায় এবং দাবি করা হলো, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যেন এ জমায়েতকে নির্মূল করে ফেলে এবং তা বাস্তবেও করা হলো। এ নির্মমতার সঠিক চিত্র হয়তো কোনো দিন জানা যাবে না। তার নমুনা ক্ষমতাবানদের মিথ্যাচারের আকার দেখেই বোঝা যায়।
এরা মধ্যযুগের কথা কেন বলছে? এ প্রশ্নের জবাব পেতে মধ্যযুগের ইতিহাস, সাহিত্য ও অন্যান্য আলোচনায় দৃকপাত করতেই বেরিয়ে আসে বিস্ময়কর চিত্র। তা হলো, মধ্যযুগের শেষাংশ ছিল প্রাচীন যুগের অব্যবস্থা ও অন্ধকারকে সরিয়ে এক সুন্দর সুস্থ জীবন ও সুষম সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের সময়। এ সময়েই ধর্মের ও নৈতিকতার উন্মেষ ও প্রসার ঘটে। পশ্চিমা পণ্ডিতরা মধ্যযুগকে তিন ভাগে ভাগ করে এর সূচনার কাল নির্ধারণ করেছিলেন ৪৭৬ খ্রি: যখন রোমানদের পতন ঘটে। তার পরের দুই শ’ বছর খ্রিষ্টান চার্চ সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালনা করত। এ সময়টাকে তারা কেউ কেউ পশ্চাৎপদ সময় বলেছেন। তবে তারাই বলেছেন, ইউরোপ যখন স্পেনের মাধ্যমে ইসলামের সংস্পর্শে এলো, তখন শুরু হলো মানবতার স্বর্ণোজ্জ্বল সময়। এরপর অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের জয়জয়কার। তারা ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল সময়কে কৌশলে ইতিহাস থেকে সরিয়ে তাদের অতীতের মধ্যযুগের অন্ধকার সময়টিকে সামনে এনে নিজেদের ধার করা কৃতিত্বকে প্রচার করতে থাকল। তারা আধুনিক যুগ বলে যাকে অভিহিত করল, তা বিজ্ঞানের ফসলের যুগ। অথচ এই বিজ্ঞানের উন্মেষে পূর্ণ কৃতিত্ব ইসলাম ও মুসলমানদের। স্পেনে ১৪৯২ খ্রি: মুসলমানেরা চূড়ান্তভাবে হেরে যাবার পর ইউরোপীয় শক্তি কখনোই মুসলমানদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেয়নি। যখনই এমন সম্ভাবনা দেখা গেছে, তা নানা কৌশলে, এমনকি শক্তি প্রয়োগে নির্মূল করে দেয়া হয়েছে। সামরিকভাবে কখনোই মুসলিম শক্তির অভ্যুদয় মেনে নেয়া হয়নি।
পশ্চিমা শক্তি বর্ণিত ‘আধুনিক যুগ’ বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে শেষ হয়েছে। এ সময়ে পশ্চিমা বর্বরতার কাছে সর্বকালের সব সহিংসতা হার মেনেছে। যেমন, ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সাড়ে ৩০০ বছর আমেরিকার দেড় কোটি রেড ইন্ডিয়ানের সংখ্যা ২৫ হাজারে  নামিয়ে আনে। প্রতি বছর তারা গড়ে চার লাখ রেড ইন্ডিয়ান হত্যা করে এ সংখ্যায় পৌঁছেছে। এ ছাড়া সাম্রাজ্য নির্মাণের জন্য যে হত্যা ও ধ্বংস, তার তুলনা নেই। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির সব জনপদসহ শহরগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাহলে মধ্যযুগের অবস্থা আধুনিক যুগের বর্বরতার কাছে কি হার মানে না? এ প্রশ্ন করেছেন বিখ্যাত লেখক মাইক জেড। মাইক একটি মজার মন্তব্য করেছেন, জার্মানির হিটলার তার হত্যাকাণ্ডের ফর্মুলা তৈরি করেছিলেন রেড ইন্ডিয়ান নিধনের কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করে।
আর আজকের উত্তর-আধুনিক (পোস্টমডার্ন) কালের অবস্থা কেমন? তথাকথিত আধুনিক যুগে যেমন যুক্তি ও বিচার হার মেনেছিল প্রযুক্তির হত্যার নেশার কাছে, তেমনি উত্তর-আধুনিক যুগে মানুষ নিজের ব্যক্তিত্বকেই হারিয়ে ফেলছে। লেখক ফাদার অ্যান্থনি থিসেলটন তার ইটি গ্রেটিং গড অ্যান্ড পোস্টমডার্ন সেলফ বইয়ে বলেছেন, ‘প্রযুক্তি এখন জীবনকে সবচেয়ে অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত করেছে। মানুষ তার পরিচয়, স্থিতিশীলতা ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ডুবে আছে… ফলে সে প্রতিদিনই বিচ্ছিন্নতা, অনির্দিষ্টতা এবং তীব্র অবিশ্বাসের মাঝদিয়ে সত্যিকারের সত্য ও নৈতিকতা থেকে দূরে চলে গেছে’ (Life in the Postmodern world is one of instability… the losses of stability, identity and confidence breed deep uncertainty, insecurity and anxiety… the postmodern self lives daily with fragmentation, indeterminacy and intense distrust).
এ সময়ে মানুষের কোথাও নিরাপত্তা নেই। কেননা রাষ্ট্রই তাকে হত্যা করছে। মধ্যযুগেও যে বিচার মানুষ পেত, তা এখন স্বপ্নের ব্যাপার। কারণ বিচারব্যবস্থা শুধু ক্ষমতাবানদের সুবিধার জন্য। অধ্যাপক জিন এডওয়ার্ড ভেইথ (Gene Edward Veith) তার Postmodern Times বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘উত্তর-আধুনিক কাল শুধু ক্ষমতাবানদের। অত্যাচারিতরা কোনো সান্ত্বনা পাচ্ছে না। তাদের জীবনধারণের নির্দেশ অন্য কেউ দিচ্ছে, তার নিজের কোনো অধিকার নেই।’ তাই যদি কেউ সুন্দর জীবনের জন্য বিশ্বাসের, বিশ্বনিয়ন্তার কাছে যায়, সেটাই স্বাভাবিক এবং ক্ষমতাবান ও তাদের দোসরেরা এটা নির্মূল করতে চাইবে, তা-ও স্বাভাবিক। তবে এটা স্পষ্ট, আজকের বর্বতার কাছে মধ্যযুগের বর্বরতা বলে পরিচিত ঘটনাবলি লজ্জায় মুখ লুকায়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads