মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০১৩

ঘটনা ঘটে আবার ধামাচাপা পড়ে


কথায় আছে অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। এই ইস্পাত কঠিন মন নিয়ে বলতে চাই আর কাঁদব না। কিন্তু অভাগা দেশের অভাগা রাজনীতি চার দশক ধরে বলে আসছে ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ কেন? লিঙ্কন কিংবা মার্টিন লুথারের জন্য আমেরিকনাদের কেউ কাঁদতে বলেনি। গান্ধী বা নেহরুর জন্য ভারতীয়রা কাঁদে না। চীনে মাও সে তুংয়ের জন্যও তো জাতিকে কাঁদিয়ে বিব্রত করার চেয়ে আদর্শ আর কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে গড়ে তোলা হয়েছে তাদের জাতিকে। আর আমরা শুধু কাঁদার নির্দেশনা পাই।

এবার অভিশপ্ত সেই প্লাজার কথায় আসি। আমি সোহেল রানার কোনো শাস্তি চাই না। কারণ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি যুবলীগের কমিটি দেখেছেন, ওখানে তার নাম নেই। আসলে মাছের পচন ধরে মাথায়, আমাদেরও মাথায় গলদ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে দেখে শুধু অনুকরণ করতে মন চায়। লিখতে বসছি কিছুটা গার্মেন্ট সেক্টরের প্রকৃত প্রোপট তুলে ধরব বলে আর সমাধানের জন্য কয়েকটি সুপারিশ দিয়ে ইতি টানব। কিন্তু বারবার মনে পড়ে প্রতিশোধের আগুন। মানুষ বাঁচাবো আগে, নাকি রানাকে মারব আগে। জাতিকে দুশ্চিন্তামুক্ত করব আগে, নাকি বিচারের দাবি তুলে দেশটাকে তোলপাড় করে তুলব। এখন পুরো দেশে ৫০ লাখ গার্মেন্টশ্রমিকের মধ্যে তুষের আগুন জ্বলছে, চাইলে দেশকে জ্বালাও পোড়াও এর আন্দোলনে মাতিয়ে রাখা যায়। কিন্তু বিরোধী দলের শরীরে হরমোন ঠেলে না।
আমাদের এ প্রজন্ম আসলেই সামনের দিকে এগোতে চায়Ñ বিবাদ, ফ্যাসাদ, গিবত ইত্যাদি শব্দ এখন নির্বাসিত হচ্ছে আস্তে আস্তে। যতই ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সরকার ইস্যু সৃষ্টি করুক আর বিরোধী দল হরতাল ডাকুক মানুষ তা মোটেই গ্রহণ করতে চায় না। আজ দেখেন ভারতে রেলদুর্ঘটনা হলে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করে যেখানে কারো কোনো হাত নেই। ওই ঘটনায় বা আগাম বোঝার উপায়ও নেই তবুও শুধু মানুষের মনে স্বস্তি আনার জন্যও জনগণের কথা ভেবে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেয়। আর আমরা এত বড় ঘটনার আগাম পূর্বাভাস জানা সত্ত্বেও একটু         সান্ত্বনার জন্য হলেও দোষ স্বীকার করতে চাই নাÑ কী বিচিত্র কুৎসিৎ মানসিকতা। তার ওপর একই দিনে সরকারের আরেকটি কর্মসূচি পড়ে যায়, তা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ যেন শোক আর শপথ একই প্ল্যাটফর্মের যাত্রী। সরকারকে বিষয়টি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে কি না জানি না, তবে আমাকে বিব্রত করেছে। আমি টিভি সেটের সামনে আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম যত সংপ্তি সময়ে সম্ভব শেষ হোক দুঃখী মানুষগুলোর শোকের কষ্ট যাতে না বাড়ে। যদিও অনেকেই সমালোচনা করেছে যে, শপথটি পেছানো দরকার ছিল। কিন্তু দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই সরকারকে তার রুটিনমাফিক সব কর্মই পরিচালনা করা দরকার।
পোশাক পরা অবস্থায় আর পেশায় থাকাকালীন অবস্থায় দায়িত্বকে প্রাধান্য দিয়ে আবেগকে দমন করাই নৈতিকতা। এত বড় দুর্ঘটনায় বিজিএমইএ যদি অপরাধীর বিষয়ে পদপে না নেয় তাহলে অবশ্যই বলব তাহলে বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। তারা তো কোনোভাবেই শ্রমিকদের স্বার্থ দেখে তাদের ঘরের লোকের তি করবে না। তারা যতটুকু লোকদেখানো মায়াকান্না দেখায়, তা শুধু জনগণকে বোকা বানানোর জন্য আইওয়াশ। এত শ্রমিক সংগঠন আর এত শ্রমিক নেতা, তারা কোনো শ্রমিকের পাশে শক্ত হাতে আসে না। কেন তারা তহবিল সংগ্রহ করে প্রতিটি পরিবারের জন্য অনুদানস্বরূপ কিছু দিতে পারে না। শ্রমিকনেতারা শুধু পারে মালিকদের তাঁবেদারি করতে। বিজিএমইএর আরবিট্রেশন কমিটি থেকে মালিকদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন, আইএলওতে গিয়ে নিজের নাম লেখানো, বিদেশে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের জন্য বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থার অ্যাফিলিয়েশন নেয়ার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। কখনো শুনিনি শ্রমিক বাঁচানো, শিল্প বাঁচানো এ দু’টি প্রত্যয় মাথায় রেখে প্রাণান্ত কোনো চেষ্টা করা।
এই যে এতগুলো প্রাণ গেল তার আগের দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যদি ভবনটা সিলগালা করতেন  তাহলে হয়তো এই বিপর্যয় হতো না। এই তো সে দিন তেজগাঁওয়ের ফিনিক্সে ২২ জন, সাভারের স্পেকটার্মে ৭৬ জন, তাজরীনে ১৫৪ জন নিঃশেষ হয়ে গেলÑ মনে হয় যেন মিছিলের লোক পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণ, তিন গুণ, চার গুণ আকারে বাড়ছে। তবে আগের ঘটনার সাথে পার্থক্য হচ্ছে আমরা ওই গার্মেন্টগুলোর মালিকের নাম জানতাম কিন্তু ভবনের মালিকের নাম নিয়ে কোনো জিজ্ঞাসা ছিল না। এবার ভবনের মালিক হয়েছেন মূলনায়ক। এমনকি সে যে হিন্দুকে অত্যাচার করে, নির্যাতন করে বের করে দিয়েছে তার নামও রবীন্দ্রনাথ সাহা। হিন্দু সম্পত্তির ওপর আওয়ামী লীগের একটা জন্মগত নজর রয়েছে। তবে তাদের ভোটাধিকার রায়ও আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বটে। আমরা এই ব্যাটা রবীন্দ্রনাথকে ভাগ্যবান পুরুষ বলতে চাই, তা না হলে আজ যদি সে জায়গার মালিক হিসেবে তার শেয়ার থাকত তাহলে দুর্ঘটনার দায় তার ঘাড়ে এসে পড়ত। আসলে আমরা এত বড় ঘটনাকে কী বলবÑ দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড। দুর্ঘটনা হঠাৎ করে হয় এবং কোনো আগাম ইঙ্গিত দিয়ে আসে না। কিন্তু রানা প্লাজায় ঘটেছে হত্যাকাণ্ড।
জোর করে চাকরিতে যোগদানে বাধ্য করা এবং প্রত্যেকটি বিষয়ই হত্যাকাণ্ডের জন্য পর্যায়ক্রমিক ধস। আমরা একটি বিষয় আমলে আনতে পারি যে, শ্রমিকদের জোর করে কাজে যোগদানের েেত্র মালিক বা ব্যবস্থাপনা শাখার বাইরে বহিরাগতদের প্রভাব কতটা প্রাধান্য পায়, তাহলে সব গার্মেন্টের একটি সরল চিত্র ভেসে উঠবে। গার্মেন্টমালিকেরা সারা বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের মদদদাতা তথা পৃষ্ঠপোষক এবং ঢাকা শহরে সব নামীদামি সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল গার্মেন্টের ঝুট ব্যবসায়  করে যেখানে প্রচুর টাকা উপার্জন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মালিকেরা তাদের স্বার্থে শ্রমিক ঠেকানোর জন্য বহিরাগতদের দিয়ে নিজের প্রভাব বিস্তারের স্বার্থে এই কাজ করে নাকি গার্মেন্টমালিকেরা বাধ্য হয়ে পরিস্থিতির শিকার হয়ে সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি থাকে বা দু’জন দু’জনার। প্রায় সব গার্মেন্টে  দেখবেন মালিকেরা শ্রমিকের বেতন আটকে রাখে এবং গোপনে স্টকলটের কাপড় বিক্রি করে যার পুরো দায়িত্ব পালন করে স্থানীয় সন্ত্রাসী। তাই তো প্রতিটি গামের্ন্টে রয়েছে বহিরাগত দাপটশালী বহিঃশক্তি। অনেক সময় শ্রমিকেরা মালিকের কথা না শুনলেই মালিকের পোষ্য সন্ত্রাসীর কথা শুনতে তারা বাধ্য, তা না হলে বেতন পাবে না, নিরাপদে অফিসে আসতে পারবে না। রানা হচ্ছে একটি উদাহরণ, আমরা রানার কথা ভাবেলই সারা বাংলাদেশের তথ্যচিত্র পাবো। এই শিল্প বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন অবয়বে রানাকে গবেষণার বিষয়ে পরিণত করলে দেশের আর্থসামাজিক প্রোপটে পোশাক অর্থনীতির তথ্য-উপাত্ত বের করতে পারব। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে এবং এই সাপকে মেরে ফেলা হবে দায়িত্ব ও শপথ নিয়ে কাজগুলো করতে হবে।
অনেকেই ইতোমধ্যে টকশোতে বলা শুরু করেছেন পোশাক শিল্পের ধ্বংস অনিবার্য বা এ শিল্প হুমকির মুখে। যদিও প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয়বারের মতো টকশোতে যেতে বারণ করে সতর্কবাণী দিয়েছেন। জানি না থার্ডটাইম কথা না শুনলে কার কপালে কী হয়? তবে এ বিষয়ে আমি একটু চিত্র তুলে ধরতে পারি যে, বাংলাদেশে ৫৮০০ গার্মেন্ট যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ হিসেবে খ্যাত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর বাংলাদেশ ৪৯০ কোটি ডলারের পণ্যসামগ্রী রফতানি করে থাকে। এর মধ্যে জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্ত পণ্য রফতানি হয় মাত্র দুই কোটি ছয় লাখ ডলার মূল্যের, যা মার্কিন বাজারে মোট রফতানিযোগ্য পণ্যের শূন্য দশমিক ৫৪ ভাগ। কিন্তু এর পরও জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে তা বাংলাদেশের ইমেজের েেত্র মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের পে ১৯টি প্রশ্ন জিএসপি বিষয়ে উত্তর দেয়ার শেষ সময় ছিল ২৪ এপ্রিল। আর সে দিনই আমাদের হতভাগ্য শ্রমিকদের লাশের মিছিলে অংশ নিতে হলো। এখন আবার হয়তো নতুন প্রশ্ন আসবে, কালো পানির পরিবর্তে রক্তের লাল রঙে উত্তর পাঠাবো আর বলব, এ বিপর্যয় কোনো নির্দিষ্ট দেশের, না বিশ্বমানবতার। তাই সমাধানের দায়িত্ব সবার।
২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল সাভারে এক ভবন ধসে মারা যান ৮০ জন শ্রমিক। ২০০৫ সালে ২৪ মে বিচারপতি আবদুল মতিন এবং এ এফ এম আবদুর রহমান একটি রুল জারি করেন। আদালত সেই দিন নির্দেশ দিয়ে দুই মাসের মধ্যে ভবন ত্র“টির বিষয়ে রাজউক ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের সমন্বয়ে সরকারের তদন্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে। একই সাথে নির্দেশ দেয়া হয় রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ ভবন ও সম্পত্তি বিক্রি বা স্থানান্তর না করতে কিন্তু এত বছর পেরিয়ে গেলেও বিজিএমইএ ছাড়া অন্য কোনো কর্তৃপ আজ পর্যন্ত আদালতে রিটের জবাব দেয়নি। ২০০১ সালের ৩১ মে হাইকোর্ট এক আদেশে গার্মেন্টগুলোর তদারকির জন্য জাতীয় কমিটি গঠন করতে বলে। প্রায় এক যুগেও সেই কমিটি হয়নি। তাজরীনের ঘটনার পর দায়ের করা রিটের রুলে জাতীয় কমিটি গঠনে কী  পদপে নেয়া হয়েছে উচ্চ আদালত তা জানতে চায় কিন্তু আজ পর্যন্ত বিবাদিরা এই রুলের জবাব দেয়নি।
যে সংস্থা তার নিজের ভবন নির্মাণ করেছে জাল জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে তার সদস্যরা যে কারখানায় পোশাক উৎপাদন করবেন তাতে যে অনিয়ম থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। গোড়ায় যেখানে গলদÑ আমি বলছি বিজিএমইএর ভবনের কথা। এখন আইন যে রা করবে সেই ভঙ্গকারী। রকই ভক, অন্যের দোষ দিয়ে লাভ কী? আমার শুধু মায়া হয় পুরো জাতি পাঁচজন গার্মেন্টমালিককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। তারা তো ভাবে সব মালিকই তো একরকমÑ বিপদ হলে সবার হবে, কিন্তু না আল্লাহর লটারিতে বাটে পড়েছে পাঁচজন। এখন তারা হেয় হচ্ছে পরিবার, পরিজন, স্ত্রী, সন্তানসহ সবার কাছে। এ দশা তো আমার আরেক আত্মীয়রও হতে পারে। আসলেই আমরা নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর বলয় সৃষ্টি করতে পারিনি। যে কারণে ঘটনা ঘটে আবার ধামাচাপা পড়ে যায়। বিচার হয় না, শাস্তি হয় না, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে তদন্ত বা সুপারিশমালার ফাইল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads