শনিবার, ১১ মে, ২০১৩

সাভার ট্র্যাজেডি : এ কি শুধুই দুর্ঘটনা?


রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভার। বাসস্ট্যান্ডের কাছে রানা প্লাজা। আটতলা ভবন, ৯ তলার নির্মাণকাজ চলছে। নিচের তিনতলা বাদ দিলে বাদবাকি পুরোটা তৈরী পোশাক কারখানা। ২৪ এপ্রিল, বুধবার সকাল ৯টায় এই ভবনে ঘটে গেল এক অভাবনীয় মহাবিপর্যয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, হঠাৎ করেই ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ কম্পন অনুভূত হয় আর সাথে সাথেই বিকট শব্দে ধসে পড়ে রানা প্লাজার ওপরের পাঁচটি তলা। বিধ্বস্ত হলো চারটি তৈরী পোশাক শিল্পকারখানা কাজে যোগদানকারী সব শ্রমিকসহ, যাদের বেশির ভাগই নারী।
মানুষের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কাটতেই শুরু হলো আতঙ্ক, আর্তচিৎকার, আহাজারি ও কান্না। ভারী হয়ে উঠল আকাশ-বাতাস। আত্মীয়স্বজনের শোক ও হাহাকারে সান্ত্বনার ভাষা হারিয়ে ফেললেন সমব্যথীরা। গণমাধ্যমের ত্বরিত তৎপরতায় দেশবাসী জানতে পারলেন এ মহাবিপর্যয়ের কথা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লাশের মিছিল বের হতে থাকে ধসে যাওয়া ভবনের ভেতর থেকে। উদ্ধারকারী বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থা হাজির হয়ে যায় এক সময়ে। শুধু তারাই নয়, আশপাশের সাধারণ মানুষেরা এ উদ্ধার কাজে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখেন ও এখনো রাখছেন। মৃতদেহ ও আহতদের উদ্ধারকাজ চলছে পুরোদমেই, তবে গতি শ্লথ। দালান ভাঙার জন্য পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সহযোগিতার অভাবেই এমনটি হচ্ছে। তবে আটকে পড়া শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিবেচনা করেও সতর্কতার সাথে কাজ করতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
পোশাক শিল্পকারখানায় দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ড নতুন নয়। তবে এবারের ঘটনাগুলো ভিন্ন প্রকৃতির।
প্রথমত, আগের দিনেই ভবনটির ফাটল দৃষ্টিগোচর হওয়ায় সে দিনই কারখানা বন্ধ করে কর্মচারীদের ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। ভবনটি যে বিপজ্জনক, তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয়ত, আকস্মিকভাবে ওই দিন রাতেই শ্রমিক-কর্মচারীদেরকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ২৪ তারিখে ১৮ দলীয় জোটের হরতালের মধ্যে কাজে যোগদানের জন্য আসতে বলা হয়। ঘটনার দিন সকালেও মাইকিং করে শ্রমিকদের যথারীতি কাজে আসতে আহ্বান জানানো হয়। বিবিসির ভাষ্য মতে, তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে জোরপূর্বক ভবনে প্রবেশ করতে শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়। সংবাদপত্রে এসেছে, তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। গরু, ছাগল যেভাবে খোঁয়াড়ে তোলে; কিছুটা সেভাবেই লাঠি উঁচিয়ে তাদের ভবনে ঢোকানো হয়েছিল। পরবর্তী ঘটনা ভয়াবহ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ভবনটি ধসে পড়ে। এখন শত শত প্রাণহানির দায় কে নেবে? অবশ্যই নিতে হবে।
তৃতীয়ত, গার্মেন্টের মেয়েরা আগে থেকেই ভীত ছিল। হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে ২৭ এপ্রিল যে মহাসমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছিল, সে সমাবেশে গার্মেন্ট শিল্পকারখানা থেকে চার লাখ নারীশ্রমিককে হাজির করার জন্য মালিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। তাদের উপস্থিতি ছিল বাধ্যতামূলক। এতে করে তারা ছিল হয়রানিতে এবং চাকরি হারানোর ভয়ে মহাভীত। তাই ২৪ এপ্রিল সকালে কারখানায় তাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
চতুর্থত, মালিক গোষ্ঠী অর্থলিপ্সা, হৃদয়হীনতা, শ্রমিকদের মানবেতর মনে করার মানে হয় না। চূড়ান্ত অবহেলা, অবিচার, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনাও মুখ বুজে সহ্য করে নেয়াই এদের নিয়তি।
আমাদের দেশের নারী অধিকার সংরক্ষণ কমিটিসহ আরো অনেক নামে, ব্যানারে বহু নারী সংগঠন আছে; কিন্তু গার্মেন্টকর্মীদের মৌলিক অধিকার হরণ ও নানাবিধ নির্যাতন নিয়ে তাদের বড় একটা সোচ্চার হতে দেখা যায় না। এই দুর্দিনে তারা এবং মানবাধিকারবাদীরা আজ কোথায়? জাতির অর্ধাংশ নারীর দুর্যোগে আজ নিশ্চুপ কেন? তারা কি শুধুই ধর্মবিরোধী কার্যকলাপে ইন্ধন দেয়ার জন্য। ফ্যাশন শো, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার নামে সামাজিক মূল্যবোধকে লাঞ্ছিত করার জন্যই কি সব সংগ্রাম-সাধনা? ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারি না।
একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে সাভার হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার দাবি করছি। সচেতন সবাই সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছেন। আমরা এ দেশে বহু তদন্ত কমিটি দেখেছি, কাজের কাজ দেখিনি কখনো। তদন্ত রিপোর্ট বহু ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট। এবারের গণহত্যায় অভিযুক্ত সোহেল রানা ও তার দলবল সাভারে অতিপরিচিত ও ক্ষমতাধর। আওয়ামী লীগের পোস্টারে তার ছবি সবাই দেখেছে। তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়, তা দেখতে দেশের মানুষ তাকিয়ে আছি।
পোশাকশ্রমিকদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাদের যাবতীয় মানবিক, সামাজিক ও আর্থিক সমস্যার সমাধান করে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার দেয়া হোক অবিলম্বে।
সাভারের মহাবিপর্যয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, সেসব নারী-পুরুষের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে মাগফিরাত কামনা করছি; আল্লাহ তাদের জান্নাতবাসী করুন। যারা আহত হয়েছেন আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন। তাদের পরিবারের জন্য সহমর্মিতা ও সহানুভূতি প্রকাশ করছি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads