মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০১৩

ইনসাইড শাপলা ট্র্যাজেডি


টেলিভিশনের পর্দায় যারা কথা বলার সুযোগ পান বা যারা সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখেন তাদের অনেকেই ৫ মে হেফাজতে ইসলামের অবরোধোত্তর সমাবেশে কী ঘটেছিল তার ঘটনা-পরম্পরা জানেন বলে মনে হয় না। এ কারণে তাদের কথা বা লেখায় অনেক বাস্তব বিষয় অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে। ঘটনাক্রমে সে দিন সংঘর্ষের ঘটনাস্থলের কাছাকাছি একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে অফিসের কাজে গিয়ে পরদিন পর্যন্ত থাকতে হয়। এতে সে দিনের অনেক কিছুই ঘটনাক্রমে আমার চোখে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী এ দিনের ঘটনায় বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করার কথা বলেছেন। হুকুমটি কিসের? সে উত্তরও তিনি দিয়েছেন; বলেছেন কুরআন পোড়ানোর হুকুম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কেউ প্রশ্ন করেননি, কুরআন কখন পোড়ানো হয়েছে? ঘড়িতে তখন কয়টা বাজে? গণমাধ্যমে ফুটেজ কখন এসেছে? কুরআন পোড়ানোর স্থানটি কোথায়? সেখানে সংঘর্ষ কখন হয়েছে? কতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে হেফাজতকর্মীদের দখলে ছিল বা সেখানে তাদের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে? বেগম জিয়া কখন হেফাজতের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন? এসব প্রশ্নের বিশদ বিশ্লেষণে প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে।

সে দিন বেলা ১১টায় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগের অফিস সংলগ্ন গুলিস্তানে হেফাজতকর্মীরা একই সাথে পুলিশ ও যুবলীগের আক্রমণে পড়েন। শিকার হন নির্মম প্রহার ও নির্যাতনের। এরপর পর্যায়ক্রমে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ ক্রমে বাড়তে থাকে। দুপুর ১২টা থেকে পল্টন মোড়ে পুলিশ দু’টি স্থানে হেফাজতকর্মীদের দমন করতে গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। বিকেল নাগাদ এতে অন্তত চারজন নিহত হন এবং দুই হেফাজতকর্মীর লাশ শাপলা চত্বরের মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের বাধা ও সংঘর্ষের একটি স্থান হলো পল্টন থেকে উত্তরমুখী সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি আর অন্যটি পূর্বমুখী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট এলাকা। দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পল্টন মোড় থেকে নাইটিঙ্গেল মোড় কার্যত হেফাজতকর্মীদের দখলে ছিল। তবে এই পুরো সময়ই সেখানে ছিল ভয়ঙ্কর যুদ্ধাবস্থার মতো। প্রতি মিনিটে কী পরিমাণ রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে পুলিশ তা বলা দুরূহ। এই দীর্ঘ আট ঘণ্টা উত্তর গেট এলাকাও থেমে থেমে কোনো সময় হেফাজতের আবার কোনো সময় পুলিশের দখলে ছিল।
দৃশ্যত মনে হয়েছে, আন্দোলনকারীরা টিয়ার গ্যাসের শ্বাসরুদ্ধকর ধোঁয়ার জ্বালা থেকে বাঁচতে বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালায়। মুভি ক্যামেরা নিয়ে যেসব সাংবাদিক স্পটে ছিলেন, তারা দেখেছেন প্রায় প্রতিটি ভবন থেকে অপ্রয়োজনীয় কাগজ, কার্টন ও ককশিট দিয়ে জ্বালানি তৈরি করতে সাধারণ মানুষ কিভাবে তাদের সহযোগিতা করেছেন। এটি ছিল নির্যাতিত হেফাজতের প্রতি মানুষের সহানুভূতি। কার্যত সন্ধ্যা ৭টার পর পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে হেফাজতকর্মীরা পল্টন এলাকা ত্যাগ করে শাপলার মূল সমাবেশের দিকে চলে যান। তারা রাত ৮টার মধ্যে বিজয়নগর ও বায়তুল মোকাররম এলাকাও ছেড়ে দৈনিক বাংলার দিকে চলে যান। আর বেগম জিয়া হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান জানান রাত ৮টার পর। ফুটপাথের দোকানের বইপত্র ও পবিত্র কুরআনে অগ্নিসংযোগের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকা পুরোপুরি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বায়তুল মোকাররমের এ এলাকায় কিছু ছোট দোকানে পবিত্র কুরআন বিক্রি হয়। এসব দোকান মসজিদের দক্ষিণ গেটেই বেশি, যা আওয়ামী লীগের অফিসের কাছে। বেগম জিয়ার নির্দেশের সময় হেফাজতের অবস্থান যদি বিবেচনায় নেয়া হয় তাহলে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে কুরআন পোড়ানোর সাথে হেফাজতের যেমন কোনো সম্পর্ক নেই তেমনিভাবে বেগম জিয়াও হুকুমের আসামি হওয়ার প্রশ্ন আসে না। বেগম জিয়াকে অভিযোগ থেকে রক্ষা করাই এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কারণ বিরোধীদলীয় নেতার প্রতীকী হুকুমে হেফাজতে ইসলামের ক্ষতি হয়েছে। এই হুকুম প্রতীকী না হয়ে কার্যকর হলেও হেফাজতের কোনো লাভ হতো না। অন্তত রক্তস্নাত শাপলা ট্র্যাজেডির নির্মম প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ার মতো একটি নজিরবিহীন ঘটনা থেকে হয়তো রক্ষা পেতেন না তারা।
গভীর রাতের অপারেশনের আগে রাত ৯টা থেকে কার্যত পুলিশ দৈনিক বাংলা ও ফকিরেরপুল মোড় থেকে বাধা তৈরি করতে থাকে হেফাজতকর্মীদের। এ সময় হেফাজতকর্মীরা মতিঝিল সিটি সেন্টার ও আরামবাগের নটর ডেম কলেজ এলাকার মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে সে সময় জানা যায় তখন পুলিশের আক্রমণে অনেক লোক আহত হন কিন্তু কোনো অ্যাম্বুলেন্স সে দিকে যেতে পারেনি। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী যুদ্ধাবস্থায়ও যুদ্ধাহত ও যুদ্ধবন্দীদের সুচিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু হেফাজতের ক্ষেত্রে দেখা গেল তার ব্যতিক্রম।
অগভীর রাতে প্রচলিত অভিযানেই সরানো যেত হেফাজতের আন্দোলনকারীদের। তখন হেফাজতকর্মীরা শুধু শাপলাকেন্দ্রিক অবস্থানে ছিলেন। ছড়ানো যুদ্ধাবস্থাও তখন ছিল না। তাহলে প্রশ্ন আসে গভীর রাতে কেন চালানো হলো এই অভিযান? পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য অনুযায়ী হেফাজতকর্মীদের সারা দিন চেষ্টা করেও সরানো সম্ভব যদি নাই হয়ে থাকে তাহলে মাঝরাতে এমন কী করা হলো যে জিরো ক্যাজুয়েলিটিতে সবাই নীরবে চলে গেলেন?
পুলিশ কমিশনার আরো বলেছেন, তাদের কাছে তথ্য ছিল সচিবালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক হেফাজতকর্মীরা দখলে নেবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে সারা দিন সচিবালয়ের মাত্র ২০-২৫ গজ দূরে হেফাজতের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হলো তখন হেফাজত সচিবালয় দখলে নিতে পারল না আর রাতে যখন তাদের লোকজন কমে গেছে, অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছেন তখন সচিবালয় হেফাজতের দখলে যাওয়ার আতঙ্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাড়া করল? হেফাজতের কোনো কর্মীর হাতে কি তখন আগ্নেয়াস্ত্র ছিল? শত শত মুভি ক্যামেরা কি তাদের হাতে অস্ত্র দেখাতে পেরেছে? তাহলে কিসের জোরে তারা দখলে নেবে সচিবালয়? আরেকটি প্রশ্নÑ সারা দিন যখন শাপলা চত্বর উত্তাল ছিল যদি চাইত তখনই হেফাজতকর্মীরা বাংলাদেশ ব্যাংক দখলে নেয়ার চেষ্টা করতে পারত। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক হেফাজতকর্মীদের কর্মসূচির পাশেই ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি। এখান থেকেই স্পষ্ট হয় সচিবালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংক দখল তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। বলা হচ্ছে পুলিশ হেফাজত নেতাদের অনুরোধ করেছেন চলে যাওয়ার জন্য। তাদের এ নির্দেশনা তাৎক্ষণিকভাবে গণমাধ্যমে প্রচার হলো না কেন? আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কাই যদি পুলিশের অভিযানের উদ্দেশ্য হতো তাহলে সন্ধ্যা রাতেই গণমাধ্যমে জানাতে পারত যে, তারা শাপলা চত্বর খালি করতে অপরারেশনে নামবে। বলা হয়, এটি ছিল ১০ মিনিটের অপারেশন। আসলে কি সেটি সত্য? রাত ১১টার পর কার্যত পল্টন, বিজয়নগর, শান্তিনগর, ফকিরেরপুল, আরামবাগ, দৈনিক বাংলা, মতিঝিল ও টিকাটুলি অঞ্চলে কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হয়নি। অতি জরুরি কাজে এ অঞ্চলে যাদের বাসাবাড়ি বা অফিসের কাজে আসা-যাওয়া করতে হয় তাদের অনেকে সাংবাদিক, আইনজীবী, এমনকি সংসদ সদস্য পরিচয় দিয়েও প্রবেশ করতে পারেননি এই এলাকায়। এর উদ্দেশ্য ছিল শাপলা চত্বরে নতুন কারো প্রবেশ বন্ধ করা। তাহলে এই অতি নিরাপদ শাপলা চত্বরকে মুক্ত করতে এত রক্তপাত করা হলো কেন?
ঘটনার দিন শাপলা চত্বরের কাছাকাছি এক বাসা থেকে রাত ২টা ৪৭ মিনিটে ফোন করে এক বন্ধু জানান, এখানে ভয়ঙ্করভাবে গুলির শব্দ হচ্ছে! আমরা কি বেঁচে থাকতে পারব?
আমার জানা মতে, কোনো প্রচলিত যুদ্ধক্ষেত্রেও সে দিনের মতো এত বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ একই সময়ে একই স্থানে হয়নি। সে রাতের ঘটনা বর্ণনার জন্য সাংবাদিকেরা বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন করতে পারেন। শাপলা চত্বরের এক বর্গমাইলের মধ্যেই অন্তত লাখ দুয়েক মানুষের বাস। তারা সে দিনের ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন। আরো সাক্ষী হয়ে আছেন মতিঝিলে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবনের সিকিউরিটি গার্ড ও পিয়নেরা, যারা অফিসেই রাতযাপন করেন। প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকও রয়েছেন কেউ কেউ।
শাপলার অপারেশন ১০ মিনিটের ছিল না। রাত ২টা ৩০ মিনিটের পর থেকে দুই ঘণ্টা চলে তা ব। ভয়ঙ্কর সেই শব্দ কত হাজার ডেসিবল শব্দমাত্রা সৃষ্টি করে, তা প্রকৌশলীরা বলতে পারবেন। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণমাত্রার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভয়ঙ্কর ত্রাস সৃষ্টিকারী শব্দ হয়েছিল সে রাতে। হাস্যকর ব্যাপার হলো, ঠিক এর এক দিন আগে ১৮ দলীয় জোটকে শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিল শব্দদূষণ হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঠিক তার এক দিন পর মাঝরাতে, আবাসিক অঞ্চল বেষ্টিত একটি বাণিজ্যিক এলাকায় যে শব্দদূষণ করা হয়, তাতে অনেক সুস্থ মানুষও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা।
ইতোমধ্যে অনেক ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, সেগুলো ফটোশপে কাজ করা ছবি। ছয় বছর ধরে বিশ্বের সব অত্যাধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভিডিও ও স্থিরচিত্র নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, কোনটি ফটো-এফেক্ট আর কোনটি নয় তা বুঝতে অভিজ্ঞ কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া চিত্র, চিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড, থ্রি-ডাইমেনশন, ব্যাকগ্রাউন্ড বিল্ডিং, সাইনবোর্ড, রাস্তার ও দেয়ালের নকশা স্পষ্টত ইঙ্গিত করছে অপারেশনে শাপলা চত্বর হয়েছিল এক নির্মম মৃত্যুপুরী। কেন এই মৃত্যুপুরি বানানো হলো শাপলা চত্বরকে? শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ যদি ৯০ দিন অবস্থান করতে পারে, শাপলার জাগরণকে কেন ৯০ ঘণ্টা থাকতে দেয়া হলো না? এ প্রশ্ন অনেকের বিবেককে নাড়া দেবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads