শনিবার, ২৫ মে, ২০১৩

রাজনীতিতে তারেক রহমানের পুনরাবির্ভাব : আওয়ামী লীগে হৃদকম্প সৃষ্টি


আজ রোববার ২৬ মে। বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। ঘরের বাইরে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া, এমনকি মানববন্ধনের মতো একটি নির্জীব কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, নির্বাচনকালে নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে ১৮ দল হরতাল আহ্বান করেছে। হরতাল ডাকার আধঘণ্টার মধ্যেই আওয়ামী লীগের তরফ থেকে রাগান্বিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে যে, বিএনপি একদিকে সংলাপের জন্য ‘আবেদন’ করছে, অন্যদিকে হরতাল ডাকছে। আওয়ামী লীগের রাগ আর অভদ্র কথাবার্তার শেষ নাই। উত্তরবঙ্গে ‘শশকুড়া’ নামে একটি লতা পাতার গাছ আছে। এই গাছের পাতা কোনো ব্যক্তির শরীরে ঘষলে মনে হবে যে তার শরীরে ছোট ছোট অনেক কাঁটা ফুটেছে। ফলে তার শরীরের ঐ স্থান খুব জ্বলতে থাকবে। এই জন্য কাউকে কোনো কথা বললে সে যদি আবোল-তাবোল বলে তাহলে বলা হয় যে ঐ লোকটিকে শশকুড়ার ঘষা দেয়া হয়েছে। ১৮ দলীয় জোট হরতাল ডাকার ফলে মনে হচ্ছে যে আওয়ামী লীগের গায়ে শশকুড়ার ঘষা লেগেছে। তাই তারা আবোল-তাবোল বকছে। সাবেক আওয়ামী মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বিএনপিকে বলেছেন যে, আপনারা ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই করতে পারেননি। যেহেতু আপনারা আলটিমেটাম দিয়েছিলেন তাই আপনাদের আর বিশ্বাস করা যায় না। এখন আর আপনাদের সাথে সংসদের বাইরে কোনো আলোচনা করা হবে না। সংসদের বাইরে আলোচনার সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। আপনারা যদি আলোচনা চান তাহলে সংসদের ভিতরে আসুন এবং নিঃর্শত আলোচনা করুন। কোনো শর্ত দিলে আপনাদের সাথে আলোচনা হবে না।
প্রায় সাড়ে ৪ বছর পর লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান লন্ডনে দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে মিলিত হন এবং রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন। সাড়ে ৪ বছর পর এটি তার প্রথম প্রকাশ্য জনসমক্ষে আগমন এবং রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান। অন্য কথায় সাড়ে ৪ বছর পর সেদিন তিনি লন্ডনে প্রথম রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বর্তমান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থানরত এবং বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশী জনগণের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। জনাব তারেক রহমান বাংলাদেশের একজন বৈধ নাগরিক। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলার তার অধিকার অবশ্যই আছে। তার কথা গ্রহণ করা অথবা তার বক্তব্যের সমালোচনা করার অধিকার প্রতিটি বাংলাদেশের নাগরিকের রয়েছে। কিন্তু তাই বলে তার বিরুদ্ধে অশালীন ও অমার্জনীয় বক্তব্য ভদ্রলোকদের কাছ থেকে আশা করা যায় না।
 তারেক রহমানের লন্ডন বক্তব্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, তারেক রহমান একজন পলাতক (ফিউজিটিভ) আসামী। কারণ তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দু’টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাই তিনি একজন পলাতক আসামী। তাই তাকে ধরে বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে। অন্যদিকে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বিদেশের মাটিতে আবস্থান করে তারেক রহমান বাংলাদেশ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছেন। তাকে ধরে এনে দেশে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। আসল কথা হলো এই যে ৬ বছর পর রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তারেক রহমানের পুনরাবির্ভাব আওয়ামী লীগের হৃদকম্প সৃষ্টি করেছে। তাই একশ্রেণীর আওয়ামী নেতা প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন।
॥ দুই ॥
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এসব অশালীন বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপি’র নেতা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আগামীকাল যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তাহলে সেই নির্বাচনে বিএনপি তথা ১৮ দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এবং যে সরকার গঠিত হবে সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন জনাব তারেক রহমান। তিনি আরো বলেন, সেই ফকরুদ্দী- মইনউদ্দিনের সময় থেকে শুরু করে হাসিনার বর্তমান সময় পর্যন্ত ৬ বছর সময় পার হয়ে গেল। অথচ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও প্রমাণ করা যায়নি। সুতরাং আওয়ামী লীগ যখন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে লাগামহীন কথাবার্তা বলে তখন তাদের হুঁশ করে কথা বলা উচিত।
আওয়ামী লীগ নেতারা বড় অদ্ভুত যুক্তি দেখিয়েছেন। তারা বলেছেন যে, বিএনপি একদিকে সংলাপ চাচ্ছে, অন্যদিকে আবার হরতাল দিচ্ছে। এটা নাকি তাদের রাজনীতির স্ববিরোধিতা। আসলে এটি বিএনপি’র রাজনীতির স¦বিরোধিতা নয়। বরং এটি প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগ তাদের মুখ দিয়ে বের করা কথা পুনরায় গিলে খেতে ওস্তাদ। আইয়ুব খানের আমলে শেখ মুজিবুর রহমান আইয়ুব খান আহূত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখন বামপন্থীরা তার অনেক সমালোচনা করেন। তারা বলেন যে, সরকার যখন আওয়ামী লীগের সাথে বৈরী আচরণ করছে তখন আইয়ুব খানের সাথে শেখ মুজিবের বৈঠকে বসা ঠিক হচ্ছে না। তখন আওয়ামী লীগ এই বৈঠকে যোগদানের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন। তারা সেদিন বলেছিল যে, ভিয়েতনামীরা আমেরিকার সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। আমেরিকা বি-৫২ নামক অতিকায় বোমারু বিমান থেকে ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণ করছে। এই যুদ্ধের মধ্যেও আমেরিকা এবং ভিয়েতনামের মধ্যে আলাপ-আলোচনা বা সংলাপ চলছে। এখন আওয়ামী লীগের যুক্তি আওয়ামী লীগের নিকট ফেরত দিয়ে প্রশ্ন করতে হয়। তাদেরই যুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধ করার পাশাপাশি যদি সংলাপ করা যায় তাহলে রাজপথে হরতাল দিয়ে বা সংগ্রাম করলেও সরকারের সাথে সংলাপে বসা যাবে না কেন? আসল কথাটি ভিন্ন। আওয়ামী লীগ সংলাপ চায় না। বিদেশীদের চাপ আছে বলে মাঝে মাঝে সংলাপের প্রসঙ্গ তোলে এবং চাপ কমে গেলেই সেটি বেমালুম ভুলে যায়।
আওয়ামী লীগ বিএনপিকে বারবার বলছে যে, তারা তাদের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ফরমুলা নিয়ে আসুক এবং সংসদে এসে আলোচনা করুক। বিএনপি বলছে যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো ছিলই। ১৫ নং সংশোধনী এনে এই সরকার সেটি বাতিল করেছে। এখন ১৫ নং সংশোধনী বাতিল করলেই তো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসে। সেখানে ফরমুলা দেবার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সরকার এটি বাতিল করেছে। সুতরাং সরকারেরই দায়িত্ব সেটিকে ফিরিয়ে আনা। তারপরেও সরকার বলুক যে তারা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে প্রস্তুত। তাহলে বিএনপি এ ব্যাপারে কথা বলবে।
 বিএনপি’র এই কথাতো অত্যন্ত যুক্তি নির্ভর। এটি নিয়েতো অতো প্যাঁচানোর কিছু নাই। তারপরেও গত বৃহস্পতিবার বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বিষয়টি আরো পরিষ্কার করেছেন। গত শুক্রবার দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন যে, ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা দিয়েছিল, সেটিই আমাদের রূপরেখা। এর বাইরে আমরা কোনো রূপরেখা দেব না। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক গোলটেবিল আলোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন। জনাব মওদুদ আহমদের এই বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার। এখানে দ্ব্যর্থ বোধকতার কোনো অবকাশ নাই। নিজেদের রূপরেখা আওয়ামী লীগ নিশ্চয় জানে। সেটিই এখন বিএনপি’র রূপরেখা। এরপর আর বিষয়টি প্যাঁচানোর কোনো অবকাশ নাই। বরং আওয়ামী লীগও এই বিষয়টিকে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে জটিল করে তুলেছে।     
॥ তিন॥
একটি বিষয় আওয়ামী লীগকে স্পষ্ট করতে হবে। তারা কি পঞ্চদশ সংশোধনী অবিকল বহাল রেখে নির্বাচন করতে চায়? নাকি পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে নির্বাচন করতে চায়? নাকি পঞ্চদশ সংশোধনীর আংশিক সংশোধন করে নির্বাচন করতে চায়? এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত অত্যন্ত স্পষ্ট। ১৫ নং সংশোধনী অবিকৃত রেখে দেশে কোনো নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। ইংল্যান্ড বা ভারতের মতো বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে পঞ্চদশ সংশোধনীর মতো কিম্ভুত কিমাকার বস্তু নাই। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বর্তমানে যারা সংসদ সদস্য রয়েছেন তারা কিন্তু সংসদ সদস্য পদে বহাল থেকেই বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী পুনরায় নির্বাচন করবেন। গত শুক্রবার দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রধান সংবাদে যা বলা হয়েছে তার অংশ বিশেষ নিচে উদ্ধৃত হলো, ‘শুধু তাই নয়, নির্বাচনে পরাজিত হলেও সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল থাকবেন। ফলে একই সাথে দু’জন সংসদ সদস্যকে দেখা যাবে। এদের একজন নবনির্বাচিত, অন্যজন বিদায়ী। নবনির্বাচিতরা বিদায়ী সংসদ সদস্যের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শপথের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এটি বর্তমান সংবিধানেরই বিধান।’
সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদের (ক) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে।’ ওই বিধানের কারণে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশনকে আরেকটি সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে সংসদ সদস্যরা তাদের দায়িত্বে থাকবেন। এমনকি চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন সংসদের নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লেখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’ ফলে কোনো কোনো আসনে দু’জন সংসদ সদস্যকে দেখা যাবে। এদের একজন পরিচিত হবেন নবনির্বাচিত সংসদসদস্যরূপে, অন্যজন বিদায়ী সদস্য হিসেবে।
আওয়ামী লীগের তরফ থেকে একটি যুক্তি প্রায়শই দেয়া হয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই কারণে যে ঐ সরকার গঠিত হবে অনির্বাচিত ব্যক্তি দ্বারা। শেখ হাসিনা একবার বলেছিলেন যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য তিনি প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করবেন। তার কথা মোতাবেক সংসদ ভেঙে গেলে যে সরকার থাকবে সেই সরকারের মন্ত্রীরা সকলেই তখন অনির্বাচিত হয়ে যাবেন। তাহলে আর অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে নির্দলীয় সরকার গঠনে আপত্তি কেন? সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বাংলাদেশের সর্বনাশ করে গেছেন। তার ঐ রায়ের কারণেই আজ দেশে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। তার কারণেই আজকের এই হরতাল। এমনি হরতাল আগামীতে আরো কত হবে, কে জানে ?   

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads