বুধবার, ২২ মে, ২০১৩

আপনারা সব পারেন

আমার দেশ এবং মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আক্রোশের একটা কারণ জনগণ বুঝে নিয়েছে। এ জন্য পনের জন সম্পাদককে দুষে লাভ নেই। কাউকে ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হয় না মাহমুদুর রহমানের ওপর সরকার এতটা জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে কেন? মানুষ জানে দাম্ভিক রাষ্ট্রশক্তির মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস সবার থাকে না। সরকারের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরার হিম্মতও সবার হয় না। যাদের হয় তারা মাহমুদুর রহমানের মতোই হয়। কিন্তু জনগণ বুঝতে পারছে না দিগন্ত  ও ইসলামিক টিভি কেন বন্ধ করে দেয়া হলো। কেনইবা পুনঃসম্প্রচারে যেতে দেয়া হচ্ছে না। মন্ত্রী আইনের প্রশ্ন তুলছেন না, তাদের সন্তুষ্টির কথা বলছেন। জনগণের ভাষায় বলতে গেলে বলতেই হয়, দুটি চ্যানেল বন্ধ করে সরকার সব বেসরকারি চ্যানেলকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। চ্যানেল দুটি বন্ধ করে জনগণের কাছে যে বার্তা পৌঁছিয়েছে, সেটিও সরকারের জন্য সুখকর নয়। সরকার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, দুটো ছাড়া অবশিষ্ট সব চ্যানেল সরকারের অনুগত কিংবা সরকারের পোষ মেনে চলতে দায়বদ্ধ। সরকার যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে চ্যানেল দুটিকে নোটিশ দিয়ে জানাত তাদের অপরাধ কী এবং সেসব অভিযোগ যদি বিশ্বাসযোগ্য ও বোধগম্য হতো তাহলে জনমনে জাগ্রত হওয়া কিছু জিজ্ঞাসার অন্তত অবসান হতো। শাপলা চত্বরের ক্র্যাকডাউন সরাসরি সম্প্রচারের অভিযোগ যুক্তির ধোপে টেকে না। সরকার দাবি করছে এরা মিডিয়া সাথে নিয়ে অ্যাকশনে গেছে, যদিও মানুষ এটা মেনে নেয়নি, বিশ্বাসও করেনি। গভীর রাত ৪টায় দিগন্ত টিভি যেখানে অবস্থিত সেই বহুতল ভবনের গেটের তালা ভেঙে, মালিকের বসানো সিসি ক্যামেরাগুলো বধ করে ৪টা ১০ মিনিটে দিগন্ত টিভির যন্ত্রপাতি খুলে নেয়া হলো। শাপলা চত্বরে অপারেশনের ফলোআপই কি দিগন্ত টিভি বন্ধ করার একমাত্র কারণ! তাহলে প্রশ্ন ওঠে, দিগন্ত টিভি কী বিশেষ কর্মসম্পাদন করল, অন্য চ্যানেল যা করল না। সমান্তরাল প্রশ্ন ওঠে সরকার কী গোপন করতে চেয়েছেÑ যার অন্তরায় হয়েছে দিগন্ত টিভি। এ দুটি মৌলিক প্রশ্নের জবাব জনগণ পায়নি। অথচ এ প্রশ্ন দুটির জবাব শুধু জরুরি নয়Ñ সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য অপরিহার্যও বটে। এ দুটি প্রশ্ন থেকে অসংখ্য গুজব, কানকথা ও সন্দেহের ডালপালা মেলার সুযোগ পেয়েছে। নিজেদের স্বার্থেই সরকারের উচিত অবস্থান স্পষ্ট করা। তথ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে ওদিকটায়  গেলেনন না কেন?
মিডিয়াকর্মী হিসেবে যত দূর জানি, ইসলামিক টেলিভিশন একটি নিরীহ টিভি স্টেশন, যে স্টেশনটি বিভিন্ন ইসলামি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করত। বিভিন্ন ইসলামি দলের ধর্মীয় কর্মতৎপরতাও আগ্রহের সাথে প্রচার করত। মাসলা-মাসায়েল ও ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্নোত্তরের অনুষ্ঠান করত। গজল, হামদ-নাত ও কেরাতের প্রতিযোগিতার আয়োজন করত। দেশ-বিদেশের ইসলামি বিশেষজ্ঞদের অভিমত সংবলিত বক্তৃতা, টকশো ও আলোচনা ডাবিং করে প্রচার করত। ইসলামের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র, যা বিশ্বজুড়ে নন্দিত তাও ডাবিং করে প্রচার করা হতো। বিশেষত গণনন্দিত পিস টিভির কিছু অনুষ্ঠানও চ্যানেলটির সম্প্রচারের তালিকায় ছিল। ইসলামিক টিভি সংবাদ পরিবেশনে বেশি আগ্রহ দেখায়নি। রাজনৈতিক বিতর্কেও কম উৎসাহ প্রদর্শন করেছে। এ ধরনের চ্যানেল দেশে আর একটিও নেই। ইসলাম বন্ধের কিংবা ইসলামি আদর্শকে বাঁকা চোখে দেখার বদখেয়াল না থাকলে এই ধর্মভিত্তিক চ্যানেলটি বন্ধ করার নেপথ্যে আর কোনো কারণ দেখি না। বিশেষ কোনো কারণও খুঁজে পাই না। চ্যানেলটির মালিক ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ এস্কান্দার। মরহুম সাঈদ বিএনপির রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এটা অপরাধ হলে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।
দিগন্ত টিভি আর ১০টি চ্যানেলের মতোই অনুষ্ঠানাদি প্রচার করে আসছিল। কিছু ধর্মীয় মূল্যবোধ লালন ছাড়াও এই চ্যানেলের সংবাদ পরিবেশনায় কিছু বাড়তি বিশেষত্ব ছিল। এটি একমাত্র চ্যানেল, যেখানে সব দল ও মতের সংবাদ ঠাঁই পেত। অন্যান্য চ্যানেলে বিরোধী দল কম গুরুত্ব পায়। দিগন্তে কিছুটা বাড়তি গুরুত্ব যেমন পেত তেমনি সংবাদ পরিবেশনার একটা নির্মোহ ও নিরপেক্ষ অবস্থানও ধরে রাখত। মন্তব্যধর্মী কিংবা কটাক্ষ করে সংবাদ পরিবেশনা, সংবাদে উদ্দেশ্যমূলক অভিমত দেয়া কিংবা একপেশে ভাব কমই পরিলক্ষিত হতো। তাই অন্যান্য চ্যানেলের সংবাদে যা পাওয়া যেত না, তা-ও দিগন্তে পাওয়া যেত। আবার অন্যান্য চ্যানেলে যা পাওয়া যেত তা তো থাকতই। এর ফলে জনগণ রিমোট হাতে স্বাধীনভাবে সংবাদ ফিল্টার করে নিতে পারত। তাছাড়া বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য উৎসাহীরা দিগন্তের সংবাদের সাথে মিলিয়ে অন্য চ্যানেলের সংবাদের পরখ করার সুযোগ নিত। এটা যেন অন্য চ্যানেলের সংবাদ কতটা সঠিক তা সত্যায়িত করার ও বিশ্বাসযোগ্যতার দুর্লভ বৈশিষ্ট্যটি অর্জন করেছিল দিগন্ত টিভি। এটাই চ্যানেলটির জন্য কাল হয়ে থাকলে সরকারের জন্য কোনো ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় রয়েছেন দুডজন পরিচালকের পরিচালনায় শত শত সাধারণ শেয়ারহোল্ডার, যারা বিভিন্ন দলের ও মতের। পরিচালকেরা বিভিন্ন দলের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলেও তাদের আসল পরিচয় সবাই স্বনামখ্যাত ব্যবসায়ী।
তাছাড়া দিগন্তের কয়েকটি টকশো ছিল নন্দিত অনুষ্ঠান। সবার উপরে দেশ, বিবিধ প্রসঙ্গ, রাউন্ডটেবল ও আজকের সংবাদপত্রÑ উপস্থাপনায় ব্যতিক্রমী কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো। অন্যান্য চ্যানেলের জনাতিনেক উপস্থাপক ছাড়া বাকিরা কৌশলে কিংবা প্রকাশ্যে সরকারি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। অতিথি নির্বাচনসহ আলোচনাকে বিশেষ মত ও সরকারের পক্ষপুটে নেয়ার আগ্রাসী উপস্থাপনার মতলব সহজেই ধরা পড়ে এবং বোধগম্য কারণেই দর্শক-শ্রোতাকে বিরক্ত করে। সরকারি দলের লোক, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও মতান্ধদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন এরাই একমাত্র বুদ্ধিমান, এদের মতই দেশ-জাতির মত। তা ছাড়া বিশেষ মত চাপানোর জোর জবরদস্তিটা দলীয় ক্যাডারদেরও হার মানায়। ম্যানেজ করা টকশোতে মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের উপস্থাপনা করে জনগণের আই ও ব্রেইন ওয়াশ করার বিষয়টিও জনগণ ভালো চোখে নেয় না। ওসব চ্যানেলের উপস্থাপক নিজেই খেলোয়াড়, রেফারি বা আম্পায়ার নন। কোনো একটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক নিজেই হয়ে যান টকশোর উপস্থাপক। ভিন্ন মতের লোকদের এমনভাবে কোণঠাসা ও উপহাস করার ব্যবস্থা করা হয়Ñ যা রীতিমতো বিব্রতকর। অতিথি ও রিসোর্স পারসনদের চেয়ে উপস্থাপক যেন বেশি জানেনÑ এমন ভাব প্রদর্শন করে শেখানোর একটি অশোভন আচরণও পরিলক্ষিত হয়। মান্যগণ্য লোক ভিন্নমতের হলে তার ওপর উপস্থাপক উপযাচক হয়ে শিক্ষকতা ফলানো ছাড়াও একই মতের লোকদের নিয়ে হামলে পড়ার বিষয়টি একেবারেই সাধারণ বিষয় বানানো হয়েছে। দিগন্ত এ ক্ষেত্রে একটি আলাদা মেজাজ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, যা দর্শক-শ্রোতারা পছন্দ করেছেন। দিগন্ত এ ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন ধারাও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এখানকার উপস্থাপকেরা আগ্রাসী হননি। নিজস্ব মত চাপাননি। আলোচনাকে বিশেষ টার্গেটে পৌঁছানোর জন্য দৃষ্টিকটুভাবে পক্ষপাতদুষ্টও হননি। ভিন্নমতের প্রতি এমন শ্রদ্ধা প্রদর্শন অন্যান্য চ্যানেলে উৎপীড়িত দর্শক-শ্রোতারা মানসিক চাপমুক্ত থেকে এখানে উপভোগ করতেন।
দিগন্তের সম্পাদকীয় নীতি এতটা উদারনৈতিক যে অন্যান্য চ্যানেল আগ্রাসী সাংবাদিকতার কারণে নিজেরাই এজেন্ডা বাস্তবায়নধর্মী সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচার করে বিব্রত হতে বাধ্য হয়। এটা ঠিক, অন্যান্য চ্যানেলের কয়েকটি ছাড়া অবশিষ্টগুলো ইসলামি মূল্যবোধের ব্যাপারে যতটা অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে, দিগন্ত ততটাই সংবেদনশীলতা দেখাত। এটাই লাখ লাখ দর্শক-স্রোতাকে দিগন্তমুখী করে তুলেছিল, যার ভেতর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তারই চিন্তার প্রতিধ্বনি শুনতে পেত।
যে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক, চ্যানেল দুটি বন্ধ করার পর সরকার আক্রমণ ভাগে খেলার সুযোগ হারিয়েছে। মিডিয়াবান্ধব প্রমাণের সুযোগও হাতছাড়া করেছে। ভিন্নমত গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এ সত্যটি গলা টিপে সরকার নিজেই হত্যা করেছে। এখন শতমত বিকশিত হতে দাও, শতফুল ফুটতে দাওÑ এমন গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের কথা একেবারে অচল করে দিয়েছে সরকার। একই সাথে অন্য চ্যানেলগুলোকে অনুগত সাজানোর দায় নিয়েছে। ভিন্নমত, স্বাধীন গণমাধ্যম ও এ সরকার একসাথে যায় না, এটি এখন প্রমাণিত সত্য। জনমনে গেঁথে যাওয়া এমন ধারণা পরিবর্তন না করতে পারলে অসংখ্য চ্যানেল সরকারকে ওয়াকওভার দেবে না। যেমন বিটিভির ওপর থেকে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিশ্বাসও হারিয়েছে। সেই বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার স্বার্থেই চ্যানেল দুটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত। এটা কে না জানে জনগণ বাধ্য না হলে বিটিভির ছায়াও মাড়ায় না। অন্যান্য চ্যানেলও ভিন্নমতকে যতটা জায়গা দেয় জনমনে ততটাই জায়গা পায়। বাকিটা চাপালেও জনগণ গ্রহণ করে না। কারণ রিমোট থাকে দর্শক-শ্রোতার হাতে, যেখানে সরকার ও অনুগতদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
এটি তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের উৎকর্ষের যুগ। সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্কও এককালের রেডিও টিভির গণ্ডি অতিক্রম করে গেছে। এখন যে চোখ বন্ধ করে রাখবে সে-ই শুধু অন্ধকার দেখবে। অন্যদের সামনে তথ্যপ্রবাহ অবাধ বিচরণ করবে। সরকার এক দরজায় খিল দিলে হাজার দরজা খুলে যায়। এক মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করলে অন্য মাধ্যমে তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। দিগন্ত সম্প্রচারে থাকলে শাপলা চত্বরের ঘটনাপ্রবাহের রক্ষণশীলভাবে হলেও দুপীঠ প্রচারিত হতো। জনগণ ভ্রান্তি কিংবা বিভ্রান্তিতে পড়ত না। এখন সরকারের বক্তব্য, প্রেসনোট, বিবৃতি ও মন্ত্রীদের শতমুখে হাজার কথা, বিজিবি ও পুলিশ কমিশনারের সাফাইয়ের মুখে একটি বড় কিন্তু ও জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিগন্ত ও ইসলামি টিভি বন্ধ কেন। তাদের হাতে কী সত্য লুকিয়ে আছে। এ জিজ্ঞাসার বাইরে নেই অন্যান্য চ্যানেলের বস্তুনিষ্ঠতার বিষয়টিও। সরকার ও অন্য চ্যানেলগুলোর জন্য এ যেন এক অসহনীয় গ্লানি বহনের ব্যাপার। অন্যান্য চ্যানেল কর্তৃপক্ষের উচিত বন্ধ করা চ্যানেলগুলো চালু করতে চাপ সৃষ্টি করা, এতে তারা যে খুশি হয়নি তাও প্রমাণিত হবে। আবার সরকার যেন মিডিয়ায় হাত দিতে কিংবা কামড় দিতে সাতবার ভাবে তারও একটা সুফল তারা পাবে। এর মাধ্যমে পেশাদারিত্বের বিষয়টিও সামনে আসবে। বস্তুনিষ্ঠতার অভাব ও সরকারের অনুগত হওয়ার দায়ও ঘুচবে। ভবিষ্যতে তাদের ওপর খড়গ নেমে এলে অন্যরা পাশে দাঁড়াবে।
ইতোমধ্যে সরকারের নানা মহল বলে বেড়াচ্ছে, এ দুটি চ্যানেল বন্ধের ডিজায়ার ছিল প্রধানমন্ত্রীর। এখন যা হবে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়, যা হবার তা-ই হবে। এর কত ভাগ সত্য কথা, আর কত ভাগ নফর ও পাইক-পেয়াদার বচন তা আমরা জানি না। তবে সব দায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপানোর এই কৌশল প্রধানমন্ত্রী জানেন কি? এভাবে শরীরের সব রক্ত মাথায় তুলে দিলে এমনিতেই রোগী বাঁচবে না। তাতে দায়মুক্তিও ঘটবে না। অতএব সব বন্ধ মিডিয়া চালু করে দিন। তাতে বলতে পারবেন আপনারা সব পারেন।।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads