শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩

আমার দেশ’র পর দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি : বিপদ বাড়ছে গণমাধ্যমের



শুরুতে একটা গল্প বলবো। পাঠকদেরও অনেকের নিশ্চয়ই গল্পটা জানা আছে। বৃদ্ধ এক ব্যক্তির বাবা মারা গেছেন। জানাযা-দাফন সবই হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনরাও যার যার বাড়ি-ঘরে ফিরে গেছে। কিন্তু লোকটির কান্না থামার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেঁদেই চলেছেন তিনি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে আশপাশের লোকজন তাকে ঘিরে ধরলো। বুঝিয়ে বললো, যথেষ্ট পরিণত বয়সেই মৃত্যু হয়েছে তার বাবার। অনেকে তো আরো কম বয়সে মারা যায়। সুতরাং তার এত দুঃখ ও কান্না মোটেও শোভা পায় না। তার বরং সবকিছু মেনে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করা উচিত। যুক্তিসঙ্গত হলেও কথাগুলো শুনে লোকটি কিন্তু হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন। সবাই তো অবাক। এভাবে কান্নার কারণ জানতে চাইলে বললেন, বাবার শোকে নয়, তিনি কাঁদছেন আসলে এজন্য যে, মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইল (আ.) বাড়িটি চিনে গেছেন। অতএব অবারও এবং বারবার তিনি আসতে থাকবেন আর বাড়িতে একের পর একজনের মৃত্যু ঘটতে থাকবে। তিনি নিজেও মারা যাবেন। সে দুশ্চিন্তাতেই তার পক্ষে কান্না বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
নিতান্তগল্প হলেও এর মধ্যে খুবই শিক্ষণীয় কিছু বিষয় রয়েছে। কিন্তু ওই শিক্ষার ব্যাপারে জানাতে হলে দু-একটি বিশেষ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে বলা দরকার। গ্রেফতার এবং রিমান্ড এরকম দুটি বিশেষ প্রসঙ্গ। সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান দুটিরই প্রধান উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। গত ১১ এপ্রিল সকালে রীতিমতো কমান্ডো স্টাইলে অপারেশন চালিয়ে সরকার আমার দেশ অফিস থেকে গ্রেফতার করেছিল তাকে। মূলত গুম হওয়ার ভয়ে ১১৯ দিন ধরে অফিসেই কাটাচ্ছিলেন তিনি। কি এমন ‘অপরাধ’ করেছিলেন তিনি, যার কারণে তাকে বাসা-বাড়ি ফেলে অফিসে কাটাতে হচ্ছিল? কারণটি ছিল ‘আন্তর্জাতিক’ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের কিছু স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করে দেয়া। এসব সংলাপে ওই বিচারপতি বিদেশে বসবাসরত একজন আইনজ্ঞ বন্ধুর সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে মতবিনিময় করেছেন এবং একথা পর্যন্ত বলেছেন যে, ক্ষমতাসীনরা নাকি তার কাছে শুধু ‘রায়’ চাচ্ছেন! কোন্্ ধরনের রায় সেটাও জানিয়েছিলেন বিচারপতি নাসিম। তিনি এমনকি ওই প্রবাসী আইনজ্ঞ বন্ধুকেই রায়টি লিখে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে সংলাপের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল বিশ্ববিখ্যাত সাময়িকী দি ইকনোমিস্ট। সাময়িকীটি স্কাইপ সংলাপ প্রকাশও করে দিয়েছিল। মাহমুদুর রহমানের ‘অপরাধ’, তিনি দি ইকনোমিস্ট-এর প্রকাশ করা সংলাপের কিছু বিশেষ অংশ দৈনিক আমার দেশ-এ ছাপিয়েছিলেন। ক্ষমতাসীনদের জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তেজগাঁও থানায় মাহমুদুর রহমানের নামে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন তারা। অভিযোগও যেমন-তেমন ছিল না, সোজা রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন মাহমুুদুর রহমান। অন্যদিকে সিনিয়র আইনজীবীসহ আইন বিশেষজ্ঞরা কিন্তু আইনের ধারা-উপধারা উল্লেখ করে করে জানিয়েছিলেন, স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করার মাধ্যমে মাহমুদুর রহমান কোনো অপরাধই করেননি। এর কারণ, বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো ‘উইকিলিক্স’ থেকে ভারতের ‘তেহেলকা ডট কম’ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অসংখ্য সংস্থা বহু বছর ধরে এ ধরনের সংলাপ এবং রাষ্ট্রীয় গোপন নথিপত্র প্রকাশ করে চলেছে।
দ্বিতীয় কারণ, আমার দেশ-এরও আগে স্কাইপ সংলাপ দি ইকনোমিস্টসহ বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং এ নিয়ে কোনো মামলাই চলতে পারে না। তৃতীয়ত, স্কাইপ কেলেংকারির প্রধান নায়ক এবং ‘আন্তর্জাতিক’ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করায় অভিযোগের সত্যতাই শুধু প্রমাণিত হয়নি, মামলার মেরিটও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চতুর্থত, মামলা করতে হলে ওই বিচারপতিকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার, যিনি সংবিধান লংঘন ও চাকরির শপথ ভঙ্গ করে এর-ওর কাছে মামলার গোপন তথ্য ফাঁস করেছেন এবং একে-ওকে রায় পর্যন্ত লিখে দিতে বলেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনরা বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে উল্টো প্রমোশন দিয়েছেন এবং গায়ের জোরে অভিযোগ এনে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে ছেড়েছেন। মামলাও দিয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহের! অথচ আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, স্কাইপ সংলাপ বা কোনো তথ্য প্রকাশ করার কারণে আর যা-ই হোক, রাষ্ট্রদ্রোহের মতো গুরুতর অভিযোগে মামলা করা যায় না। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এই সহজ কথাটুকু না বোঝার ভান করেছেন। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তারা আসলে যে কোনোভাবে মাহমুদুর রহমানের ওপর পুরনো কোনো রাগের ঝাল মেটাতে চেয়েছেন। আমার দেশকে চেয়েছেন ‘একহাত’ দেখিয়ে দিতে।
এ জন্যই ১১ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়েছিল মাহমুদুর রহমানকে। কথা শুধু সে কারণে ওঠেনি। সেদিনই একদিকে আরো তিনটি মামলায় ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল তাকে, অন্যদিকে  রাতের বেলায় পুলিশকে দিয়ে আমার দেশ-এর ছাপাখানায় তল্লাশির নামে ‘গণতান্ত্রিক’ ডাকাতি করিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন আমার দেশ-এর ছাপাখানায়। এরপর পত্রিকাটি ছাপানো হচ্ছিল আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসে। কিন্তু আইনসম্মতভাবে হলেও সরকার শুধু ছাপানো বন্ধ ও পত্রিকা জব্দ করেনি, দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক, প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদ এবং মাহমুদুর রহমানের বৃদ্ধা মায়ের বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকেছে। পুলিশ একই সঙ্গে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ১৯ জন গরিব বাইন্ডারকেও। অথচ এই বাইন্ডারদের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, তারা নেহায়েতই পেটের দায়ে চাকরি করে। সরকারের বদৌলতে তারাও জেলের ভাত খেতে বাধ্য হয়েছে। কয়েকদিন পর আদালত অবশ্য অনুগ্রহ করে তাদের জামিন দিয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফলে সরাসরি আক্রান্ত আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার তাই বলে আমার দেশকে ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করেনি। এই না করার কারণ, এ ব্যাপারে সংবিধানের ৩৯(২)(খ) অনুচ্ছেদে নিষেধ রয়েছে। এজন্যই বাঁকা পথে হাঁটতে শুরু করেছেন ক্ষমতাসীনরা।
অন্যদিকে সরকারের এই ফ্যাসিস্ট নীতি ও কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল-সমাবেশ, অনশন ও মানববন্ধন করেছেন। মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সবখানে এবং দেশের বাইরেও। গত ১৫ মে’ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সমাবেশে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সাংবাদিক নেতারা ঘোষণা করেছেন, ১৯ মে’র মধ্যে মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি না দেয়া হলে ২০ মে থেকে শুরু হবে লাগাতার বৃহত্তর আন্দোলন। জাতীয় প্রেস ক্লাব যে বিভিন্ন সময়ে ‘গণতন্ত্র স্কয়ারে’র ভূমিকা পালন করেছে এবং সেখানে উপস্থাপিত সব দাবিই যে আদায় করা হয়েছে সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নেতারা। তারা জোর দিয়ে বলেছেন, মাহমুদুর রহমানকে মুক্ত করার মাধ্যমে বর্তমান পর্যায়ের আন্দোলনেও তারা সাফল্য অর্জন করবেন। তারা আরো বলেছেন, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায় করতে হলে সরকারকে নতি স্বীকার করতে হবে, যার পরিণতি ক্ষমতাসীনদের জন্য হবে লজ্জাকর। এ জন্যই সাংবাদিক নেতারা সময় থাকতে মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দেয়ার, আমার দেশ-এর প্রেস খুলে দেয়ার এবং জনপ্রিয় দুই টিভি চ্যানেল দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন।
সাংবাদিকরাই শুধু আন্দোলন করছেন না, আন্দোলনরত সাংবাদিকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। তারা মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা প্রত্যাহার করে অবিলম্বে তাকে মুক্তি দেয়ার এবং আমার দেশ-এর প্রেস খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও একই দাবি উচ্চারিত হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে) ৩ মে পালিত বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রাক্কালে এক রিপোর্টে দৈনিক আমার দেশ এবং মাহমুদুর রহমানের ব্যাপারে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে। ২০১২-১৩ সালে বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে আইএফজে বলেছে, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ক্রমাগত ‘রাজনৈতিক ক্রসফায়ারের’ শিকার হচ্ছে। আমার দেশ এবং মাহমুদুর রহমান প্রসঙ্গে সরকারের দেয়া ব্যাখ্যাও প্রত্যাখ্যান করেছে আইএফজে। সংস্থাটি বাংলাদেশের কয়েকটি সাংবাদিক সংগঠনের ভূমিকারও সমালোচনা করেছে। বলেছে, সরকারসমর্থক সাংবাদিকরা শুধু মাহমুদুর রহমান সম্পর্কেই মুখ বন্ধ রাখছেন না, সরকারের পদক্ষেপে শত শত পেশাদার সাংবাদিক পথে বসার উপক্রম হলেও তারা প্রতিবাদ করছেন না।
গল্প দিয়ে শুরু করার কারণ রয়েছে এখানেই। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, গণমাধ্যমেরই একটি বিশেষ গোষ্ঠী প্রতিবাদ জানানোর এবং মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠার পরিবর্তে উল্টো সরকারের সমর্থনে ভূমিকা পালন করে চলেছে। সাংবাদিক নামধারী বিশেষ একজন তো মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার আগে থেকেই রীতিমতো ‘কাছা দিয়ে’ নেমে পড়েছিলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে আওয়ামী স্টাইলে ‘এক বস্তা’ অভিযোগ তুলে ধরে মাহমুদুর রহমানকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না তার কারণও জানতে চেয়েছিলেন তিনি। কা-জ্ঞান হারানো উন্মাদের মতো বলেছিলেন, মাহমুদুর রহমান নাকি সাংবাদিকই নন! সময়ের এই সাহসী সম্পাদকের বিরুদ্ধে আরো অনেক বিষোদ্গারও করেছেন তিনি। অন্যদিকে দৈনিক সংগ্রাম ও নয়া দিগন্ত’র সম্মানিত সম্পাদক, ফেডারেল ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও সম্পাদক এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ওই সাংবাদিক নামধারীর বক্তব্যকে কুরুচিপূর্ণ আখ্যায়িত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, মাহমুদুর রহমান বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেন বলে এ ধরনের বক্তব্য গোটা সাংবাদিক সমাজকে লজ্জিত, ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। তাদের মতে সাংবাদিকতার নিয়ম-নীতি তো বটেই, ওই সাংবাদিক নামধারী বিশেষজন রাজনৈতিক বিদ্বেষেরও সীমা লংঘন করেছেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে নিজের অসভ্য মনেরই পরিচয় দিয়েছেন। মাহমুদুর রহমান সম্পর্কিত বক্তব্য প্রত্যাহার করার জন্যও তার প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন দুই সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতারা। 
বলা দরকার, ওই সাংবাদিক নামধারী যা-ই বোঝাতে চেয়ে থাকুন না কেন, তার উদ্দেশ্য আসলে ছিল সে সময় শাহবাগে তৎপর চরম ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার গোষ্ঠীর সেবাদাসের ভূমিকা পালন করা। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে হুংকার দিয়ে ওঠার কারণও গোপন করেননি তিনি। সে কারণটি হলো, তরুণ প্রজন্ম নামের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে সুমহান আল্ল¬াহ, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং পবিত্র আল-কুরআন ও ইসলাম সম্পর্কে অত্যন্ত অসভ্য ভাষায় মন্তব্য করার ও কুৎসা রটানোর যে অভিযান চালানো হচ্ছিল, মাহমুদুর রহমান সে অভিযানের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। এজন্য শাহবাগ থেকে তাকে ‘খতম’ করার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে ওই সাংবাদিক নামধারীর ‘বন্ধু’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও উল্টো মাহমুদুর রহমানকেই গ্রেফতারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সাংবাদিক নামধারী হিসেবে দায়িত্ব যেখানে ছিল বিপন্ন সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের পক্ষে দাঁড়ানো, ওই বিশেষজন সেখানে দলবাজির নির্লজ্জ ভূমিকায় নেমেছিলেন। নেমেছিলেনও কোমরে ‘কাছা’ দিয়ে!
এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি যারা করেন তাদের পক্ষে ন্যায়-নীতি ও সত্যের পক্ষে অবস্থান নেয়াটা কঠিন শুধু নয়, অসম্ভবও বটে! কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকের ধারণা ছিল, মনের ভেতরে সাংবাদিকতার ন্যূনতম চেতনা থাকলেও কারো পক্ষে এতটা ন্যক্কারজনকভাবে আরেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে লম্ফঝম্ফ ও তারস্বরে চিৎকার করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। সেটাও করে দেখিয়েছিলেন ওই বিশেষজন। তা তিনি দেখাতেই পারেন, কিন্তু জনগণ অবাক হয়েছে এজন্য যে, নোংরা আবর্জনা খেয়ে বেঁচে থাকার কারণে যে কাককে মানুষ ঘৃণা করে, সে কাকও স্বজাতি কাকের মাংস খায় না। অন্যদিকে নিজে সাংবাদিক নামধারী হয়েও আরেক সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। এজন্যই না বলে উপায় থাকেনি যে, ঘৃণিত ‘পক্ষী’ কাককেও লজ্জা দিয়েছিলেন ওই সাংবাদিক নামধারী বিশেষজন। হতে পারে, সাংবাদিকতার জগতে মাহমুদুর রহমানের আগমন খুব বেশি দিন আগে ঘটেনি, সাংবাদিকতায় বিশেষজনদের মতো চুল-টুলও পাকিয়ে ফেলেননি তিনি। কিন্তু জড়িত তো রয়েছেন সাংবাদিকতাতেই। প্রকৃত সাংবাদিকরা কিন্তু মনেই করেন না যে, কে সাচ্চা সাংবাদিক আর কে ননÑ এ বিষয়ে অন্তত সাংবাদিক নামধারী কোনো সুবিধাবাদী রাজনৈতিক সেবাদাসের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া জাতীয় স্বার্থে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করার ও ইতিবাচক অবদান রাখার সবদিক থেকেই মাহমুদুর রহমান অনেক আগেই বহু বছরের ‘ঝানু’ কিছু সাংবাদিককে ছাড়িয়ে গেছেন। এখনও এগিয়ে যাচ্ছিলেন বলেই তাকে প্রতিহত করার জন্য নানামুখী তোড়জোর শুরু হয়েছিল। এটা ভারি লজ্জার কথা যে, সাংবাদিক নামধারী ওই বিশেষজনও বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন এবং অসভ্য মনের পরিচয় দিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। দাবি জানিয়েছিলেন ফ্যাসিস্টের সুরে।
একই কারণে দেশের ভেতরে শুধু নয়, বিদেশেও প্রচুর সমালোচিত হয়েছেন তিনি। মূলত তার মতো লোকদের ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতেই আইএফজে পর্যন্ত বাংলাদেশের কয়েকটি সাংবাদিক সংগঠনের ভূমিকার সমালোচনা না করে পারেনি। আইএফজে শুধু নয়, অতি সম্প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবীসহ দেশের বিশিষ্টজনেরাও গণমাধ্যমের ওই বিশেষ গোষ্ঠীর ভূমিকাকে উস্কানিমূলক ও দুঃখজনক হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা বলেছেন, দেশে গণতন্ত্রের পাশাপাশি গণমাধ্যমের বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে বাধাহীন রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট সবার এখন ঐক্যবদ্ধভাবে মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়া উচিত। একই সঙ্গে উচিত আমার দেশ-এর প্রেস খুলে দেয়ার এবং দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেয়া। না হলে পর্যায়ক্রমে অন্য সব গণমাধ্যমও সরকারের শিকারে পরিণত হবে এবং দেশে স্বাধীন কোনো গণমাধ্যমই টিকে থাকতে পারবে না। মূলত অমন আশংকার পরিপ্রেক্ষিতেই দেশের রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং আইএফজে ও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের মতো প্রভাবশালী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনও সরকারের মিডিয়া দলনের নীতি ও কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দেয়ার ও আমার দেশ-এর প্রেস খুলে দেয়ার পাশাপাশি দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্যও তারা দাবি জানিয়েছে।
পাঠকদের কাছে এতক্ষণে নিশ্চয়ই শুরুতে বলা গল্পের কারণ ও তাৎপর্য পরিষ্কার হয়েছে। মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার এবং আমার দেশ-এর প্রেসে তালা ঝুলিয়ে দেয়াসহ ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেছে, গণমাধ্যমেরই একটি বড় অংশ উল্লসিত হয়ে উঠেছেন। সাংবাদিকদের নেতা নামধারী কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন, মাহমুদুর রহমান নাকি ‘ঠিক’ সাংবাদিক বা সম্পাদক নন! কোনো কোনো দৈনিক আবার সম্পাদকীয় পর্যন্ত লিখে সরকারের প্রশংসা করেছে! অথচ তাদের লক্ষ্য করা দরকার ছিল, আমার দেশ সরকারের প্রথম শিকার তথা ‘টেস্ট কেস’ মাত্র। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যরাও আক্রান্ত হবে, আরো অনেক সম্পাদককেই মাহমুদুর রহমানের ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে। তখন তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন, গল্পের লোকটি কেন মৃত্যুর ফেরেশতা বাড়ি চিনে যাওয়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ-এর ব্যাপারে কেন তাদের উচিত ছিল প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠা। আমরা মনে করি, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ ও চিন্তার বাইরে এসে দেশের সব গণমাধ্যমেরই মাহমুদুর রহমানের মুক্তি, আমার দেশ-এর প্রেস খুলে দেয়া এবং দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠা উচিত। সাংবাদিকসহ গণমাধ্যমকর্মীদের প্রত্যেকের উচিত আন্দোলনে অংশ নিতে এগিয়ে আসা। কারণ, গণতন্ত্রের জন্য তো বটেই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই। সরকার কোনোভাবে ‘টেস্ট কেস’-এ সফলতা অর্জন করতে পারলে আরো অনেক গণমাধ্যমকেই ফ্যাসিস্ট নীতির শিকার হতে হবে। সম্পাদকরাও যে রেহাই পাবেন না বরং মাহমুদুর রহমানের চাইতেও কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়বেন সে ব্যাপারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তো কিছুদিন ধরে জানান দিয়ে চলেছেন।  সুতরাং সময় থাকতে সবারই উচিত সাবধান হওয়াÑ অন্তত মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করায় উল্লসিত না হওয়া।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads