মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০১৩

‘শাপলা চত্বর ট্রাজেডি’



গভীর রাতে ‘বর্বরতা’, ‘আলেম নিধন’, ‘শাপলা চত্বর ট্রাজেডি’ যে নামেই ডাকা হোক গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে মতিঝিলের ভয়ঙ্কর এ ঘটনা। কত মানুষের প্রাণ গেছে পুলিশের গুলীতে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। স্বদেশের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গভীর রাতের এ হত্যাযজ্ঞে প্রাণ গেছে রাজনীতি থেকে বহুদূরে থাকা আলেম-ওলামাদের। নবী (সা.)প্রেমী এই মানুষগুলো এসেছিল সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন’সহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে। কিন্তু তাদের ট্যাক্সের টাকায় কেনা বন্দুকের গুলীতেই প্রাণ হারাতে হলো অনেককেই। ১৯১৯ সালে ভারতবর্ষের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে বৃটিশ সেনাপতির নেতৃত্বে শিখ সম্প্রদায়কে হত্যার যে ঘৃণিত ইতিহাস সৃষ্টি হয়; সেটাকে ছাড়িয়ে গেছে গভীর রাতে মতিঝিল হত্যাযজ্ঞ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী মনে করেন বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে গভীর রাতে গণহত্যার নির্দেশ দেয়াকে সনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি না করলে দেশে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে। আইন-শৃংখলা রক্ষার নামে জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্র দিয়ে অন্ধকার রাতের ‘গণহত্যা’ মানুষ মেনে নেবে না।
মানবাধিকার নিয়ে যারা চোখের পানি ফেলেন তারা নীরব। বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী, এনজিওকর্মী যারা বছরের পর বছর ধরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে ‘ছবক’ দিচ্ছেন তারা গর্তে ঢুকে গেছেন। এমনকি প্রতিদিন যারা টকশোতে দেশ গেল দেশ গেল বলে মায়াকান্না করেন তারাও বধির হয়ে গেছেন। মানবাধিকার রক্ষার এই ব্যাপারীদের অনেকেই এধরনের ঘটনা পরিচালনায় সরকারকে উৎসাহিত করেছেন। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হকের মতো ব্যক্তিত্ব হেফাজতের কর্মীদের মতিঝিল থেকে উঠিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সরকারকে উষ্কে দেন। টকশোর কারণে হঠাৎ বুদ্ধিজীবী আবু সাঈদ খান তো হেফাজতকে প্রথমেই শেষ করে দেয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানের বিবেক এখন আর কাঁদে না। কারণ তিনি সরকারের কাছে ‘বিবেব বন্ধক’ রেখেছেন। র‌্যাবের গুলীতে কলেজ ছাত্র লিমন এক পা হারানোর পর সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। মানবাধিকার কমিশনের এই চেয়ারম্যান লিমনের এক পা হারানো ইস্যুতে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেন। আইন-শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে পা হারানোর বিচার হওয়া উচিত। লিমনের ব্যাপারে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের সেই দৌড়ঝাঁপ যৌক্তিক। কিন্তু মতিঝিলে পুলিশের গুলীতে এতোগুলো আলেম প্রাণ হারানোর পরও মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের ঘুম ভাংছে না কেন? তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও কী সরকারকে খুশি করতে নীরবতা পালন করছেন? আলেম সমাজের অনেকেই এ প্রশ্ন রেখেছেন বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত সমাজের উপর তলার বিবেকবান এই মানুষগুলোর প্রতি।
ইতিহাসের সাক্ষী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পাক-বাহিনীর হাতে ঢাকায় গণহত্যার পর এধরনের বর্বর হত্যার ঘটনা ঘটলো মতিঝিলে। গভীর রাতে বন্দুকের নল গর্জে ওঠায় মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়া হেফাজতের হাজার হাজার নেতাকর্মী ছুটোছুটি করেন এবং গুলীতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গভীর রাতে আলেমদের রক্তে ভেসে যায় শাপলা চত্বর এলাকা। কালো পিচঢালা রাজপথে পানির মতো গড়াতে থাকে নবী (সা.) প্রেমিদের তাজা রক্তের ধারা। গভীর রাতে মহাজোট সরকারের নির্দেশে যৌথ বাহিনী (বিজিবি-র‌্যাব-পুলিশ) হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে নিরস্ত্র আলেম-ওলামাদের ওপর। রাত পৌনে তিনটা থেকে শুরু হয়ে ভোর পর্যন্ত চলা এ তান্ডবে মারা গেছে শত শত মানুষ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্র রাষ্ট্রের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী গভীর রাতে গণহত্যায় ব্যবহার করেছে। মতিঝিল ট্রাজেডিতে কতজন মারা গেছে আর আহতের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। তবে হেফাজতের দাবি রাতের আঁধারে বর্বর হত্যাকান্ডে তিন হাজার আলেম-ওলামা-তৌহিদী জনতার প্রাণ গেছে। বিএনপি বলেছে মতিঝিলে এক হাজারের বেশি আলেমকে হত্যা করা হয়। মিডিয়াকর্মীদের অভিমত প্রায় দুই হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আহতের সংখ্যাও ব্যাপক। গভীর রাতের ‘শাপলা জেনোসাইড’ ২০০২ সালে গুজরাটের নরেন্দ্র মোদীর ‘আহমেদাবাদের মুসলিম নিধন’, সিরিয়ার বাশার আল আসাদ বাহিনীর ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সরকার উত্থান আন্দোলন ঠেকানোর নামে একের পর এক ‘হত্যাযজ্ঞ’ ও পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানের মার্কিন বাহিনীর ড্রোন হামলায় ‘বেঘোরে মানুষ হত্যার বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। ওই সব দেশে ক্ষমতার লড়াই, ভোটের রাজনীতি ও প্রভাবশালী দেশগুলোর আধিপত্য বিস্তারের জন্য ভিনদেশীরা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। কিন্তু নিজ দেশের জ্ঞাতিভাইয়ের হাতে বেঘোরে প্রাণহানির ঘটনা বাংলাদেশেই ঘটলো। গভীর রাতে ‘শাপলা গণহত্যা’ নিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোতে ফলাও করে খবর প্রচার হচ্ছে। রাজনীতি থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকা হেফাজতের ১৩ দফার আন্দোলনকারীদের শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেয়ায় সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তৃপ্তির ঢেকুড় তুলছেন। তবে এ ঘটনা যে ‘ক্ষতের’ সৃষ্টি হয়েছে; নাগরিকদের মধ্যে যে বিভাজনের সৃষ্টি করেছে তার রেশ কতদিন থাকবে তা বলা কঠিন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, গভীর রাতে নিরস্ত্র আলেমদের ওপর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং গণহারে হত্যা করা দেশের ১৬ কোটি মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। সরকারের পুলিশ দিনে শাসকদলের অস্ত্রধারীদের সঙ্গে নিয়ে হেফাজতকে প্রতিহত করেছে। রাতে তারা নিরস্ত্র আলেমদের হত্যা করেছে। অতপর এ ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায় সে জন্য সরকার দুটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। এতে মৃত্যু নিয়ে জনমনে সন্দেহ আরো বাড়ছে। সরকারের বোঝা উচিত হত্যাকা- চালিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যায় না। তার প্রমাণ নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ও চট্টগ্রামের ঘটনা।
জানা গেছে, গভীর রাতে মতিঝিল অভিযানে বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের ১০ থেকে ১৫ হাজার সদস্য অংশগ্রহণ করে। গোটা এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিরীহ তৌহিদী জনতার ওপর হামলা চালানো হয়। হত্যাযজ্ঞের চিত্র যাতে ক্যামেরায় ধারণ করা সম্ভব না হয় সে কৌশল গ্রহণ করা হয়। তারপরও টিভির লাইভ ফুটেজে বহু লোককে রাস্তার পাশে নিথর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। অন্ধকারেই পুলিশ লাশগুলো তুলে নিয়ে যাচ্ছে। প্রাণভয়ে পালানো এবং আহত হেফাজত কর্মীদের লাইন ধরে হাঁটতে দেখা যায়। এখানে সেখানে পালিয়ে থাকা হেফাজত কর্মীদের নামিয়ে আনতেও দেখা যায়। নিহতের রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকায় রক্তে বিভিন্ন স্থানে লেপ্টে যায় তাজা রক্তের দাগ। রাত ৪টার দিকে একুশে টিভি, সময় টিভিসহ কয়েকটি টিভিতে সমাবেশস্থল থেকে অন্তত ৫টি লাশ উদ্ধার ও অর্ধশতজন গুলীবিদ্ধ হওয়ার খবর নিশ্চিত করে তথ্য দেয়া হয়। গ্রেফতার করা হয় অনেক তৌহিদী জনতাকে। গত রোববার সারাদিন মতিঝিল এলাকা ছিল ভুতুরে অবস্থা। অফিস খুললেও সাধারণ মানুষের চেয়ে পুলিশের আনাগোনা ছিল বেশি। এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত মতিঝিলের শাপলা চত্বর পুরোপুরি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মতিঝিল অভিযান নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বললেও সরকারের ‘অফিসিয়ালি’ কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সাবেক প্রেসিডেন্টি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী এ ঘটনাকে ইতিহাসের নজীরবিহীন হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এমন পাশবিক ও বর্বর ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বর ঘটনাকেও হার মানিয়েছে। শেষ রাতের ওই সাঁড়াশি অভিযানে কত লোককে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও বহুলোককে যে হত্যা করা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইসরাইলী সৈন্যের গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মতো মতিঝিলের শাপলা চত্বরের নিয়ন্ত্রণ নিতে বৃষ্টির মতো গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে যায় হেফাজতের মঞ্চের দিকে। প্রথমে নিরস্ত্র হেফাজত কর্মীরা ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে প্রতিহতের চেষ্টা করলেও পরে তারা পিছু হটে যায়। পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির সদস্যরা এ সময় প্রচুর পরিমাণ সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে। সরেজমিন অবস্থান নেয়া সংবাদকর্মীরা জানিয়েছেন,  পুলিশের নির্বিচারে গুলীতে শত শত মানুষ হতাহত হয়েছেন। অনেক লাশ ময়লার গাড়িসহ বিভিন্ন গাড়িতে করে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। অধিকাংশ টেলিভিশন সরকারের অন্ধ সমর্থক হওয়ায় গণমাধ্যমে এ খবর ও দৃশ্য প্রকাশ করা হয়নি। বরং বেসরকারি অধিকাংশ চ্যানেলের খবরে বলা হয় পুলিশ র‌্যাবের ফাঁকা গুলীতে ১০ মিনিটেই ফাঁকা হয়ে যায় শাপলা চত্বর। হেফাজতকর্মীরা শাপলা চত্বর ছেড়ে চলে যান। কিন্তু গত সোমবার সকালে একাধিক চ্যানেলের বিশেষ বুলেটিনে বলা হয় দমকল বাহিনীর লোকজন শাপলা চত্বর এলাকা ধোয়া মোছার কাজ করছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীদেরও মতিঝিল দিলকুশা এলাকা পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। গুলীবর্ষণের আগ পর্যন্ত মঞ্চে অবস্থান নেয়া হেফাজতের এক নেতা জানান, গভীর রাতে জিকির চলছিল। ক্লান্ত অনেক কর্মী ঘুমিয়ে পড়েছিল। পুলিশ চতুর্দিকে ঘিরে রেখেছে এ খবর ছিল। তারা এভাবে বৃষ্টির মতো গুলী ছুঁড়বে সেটা কারো মাথায় আসেনি। ঘড়ির কাঁটা যখন রাত ২টা ৪৫ মিনিট তখন হঠাৎ কেঁপে ওঠলো মতিঝিল-দিলকুশা-আরামবাগ ও আশপাশের এলাকা। অন্ধকার এলাকাটি জুড়ে শুধু পুলিশের গুলী আর গ্রেনেডের আওয়াজ। যৌথ বাহিনীর সাজোয়া যানের সাইরেনে সৃষ্টি হয় একটি একতরফা যুদ্ধের পরিবেশ। বিজিবি, র‌্যাব আর পুলিশের ১০ থেকে ১৫ হাজার সদস্য ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমিয়ে থাকা, জিকিররত নিরস্ত্র হেফাজত কর্মীদের ওপর। মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, ফকিরাপুল, আরামবাগ, ইত্তেফাক-ইনকিলাব মোড়সহ আশপাশের এলাকা পরিণত হয় এক নারকীয় বধ্যভুমিতে। গুলী আর বোমার সামনে টিকতে না পেরে সরে যেতে বাধ্য হন সমাবেশস্থলে বসে থাকা নিরস্ত্র অসহায় লাখো আলেম ওলামা। অনেকে গুলীতে হতাহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। অনেকেই আশ্রয় নেন আশপাশের বিভিন্ন গলিতে। যুদ্ধসাজে সজ্জিত যৌথ বাহিনী এরপর অভিযান চালায় আশপাশের অলিগলিতে। সেখান থেকেও পিটিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয় হেফাজত কর্মীদের। এরপরও চলতে থাকে পুলিশের তান্ডব। গুলী করতে করতে হেফাজতকর্মীদের ধাওয়া করতে থাকে তারা। পুলিশ, র‌্যাব আর বিজিবির পিটুনিতে অনেকেই আহত হন। বাংলাদেশ ব্যাংক, নটরডেম কলেজ, কমলাপুর রোড এবং টিকাটুলির গলিতে আশ্রয় নেয়া মানুষকে পুলিশ টিকাটুলি হয়ে পিছনে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির যৌথ অভিযানে প্রায় তিন হাজার আলেম ও নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন বলে এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শাহ শফীসহ শীর্ষ নেতারা। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খানের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয় দিনব্যাপী কর্মসূচি শেষে তৌহিদী জনতা ও আলেম-উলামাগণ উন্মুক্ত আকাশের নিচে যখন গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন তখন আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার ঘুমন্ত জনতার ওপর পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও দলীয় সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে নির্বিচারে গুলী, বোমা, গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। রাতের অন্ধকারে এমন বর্বরোচিত ও কাপুরুষিত হামলায় তৌহিদী জনতা খালি হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় ও অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের আঘাতে একের পর এক তারা শাহাদাতবরণ করতে শুরু করেন। এতে ঘটনাস্থলেই প্রায় তিন হাজার শহীদ এবং ১০ হাজারেরও বেশি আহত হন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার বলেন, পুলিশ গভীর রাতে সহস্রাধিক আলেমকে হত্যা করেছে। তবে গভীর রাতে মতিঝিল অভিযানে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি দাবি করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, হেফাজতে ইসলামকে রাজধানীর শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দিতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি যে অভিযান পরিচালনা করেছে; তাতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
আমরা বিস্মিত, স্তম্ভিত এবং গভীরভাবে মর্মাহত। আমরা ক্ষুব্ধ, বিচলিত এবং উদ্বিগ্ন। তীব্র প্রতিবাদ, নিন্দা ও ধিক্কারের সঙ্গে আমরা সেই নৃশংস, বর্বরোচিত ও মর্মন্তুদ অভিযানের কথা বলছি যাতে বিপুল প্রাণহানি ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে। হেফাজতে ইসলামের পূর্বঘোষিত ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পরবর্তী শাপলা চত্বরে আয়োজিত মহাসমাবেশ ও অবস্থানকে কেন্দ্র করে সরকারি তরফে যা কিছু ঘটানো হয়েছে তা অভাবিত, অভূতপূর্ব ও নজিরবিহীন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, নবীশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ (সা.) ও ইসলামের বেপরোয়া অবমাননার প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাবেশে আগত আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র এবং আল্লাহ-রাসূল ও ইসলামপ্রিয় সাধারণ মানুষ র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি ও সরকারি দলের অস্ত্রবাজ ক্যাডারদের ব্যাপক হামলা, নির্যাতন ও গুলীবর্ষণের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। রাত দু’টা-আড়াইটার দিকে শাপলা চত্বরে অবস্থানকারীদের হটিয়ে দিতে র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি’র যৌথবাহিনী যেভাবে অভিযান চালিয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্র, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করেছে তার কোনো তুলনা বা নজির নেই। গত রোববার সকাল থেকে রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সরকারি দলের ক্যাডাররা যে তান্ডব ও অভিযান চালিয়েছে তাতে কত মানুষ নিহত হয়েছে, কত মানুষ আহত হয়েছে, কত মানুষ নিখোঁজ হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উৎস ও গণমাধ্যমে হতাহতের যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে, তার একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই। কোনো দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালাতে পারে, নির্বিকারচিত্তে মানুষ হত্যা করতে পারে, তা কল্পনার অতীত। এই অকল্পনীয় দমন-পীড়ন, হামলা ও নিষ্ঠুরতাই গত রোববার লক্ষ্য করা গেছে। মনে হয়েছে, এই হামলাকারী-হত্যাকারীদের কেউই যেন বাংলাদেশের নয়, তারা যেন ভিন দেশী। আগ্রাসীবাহিনী যে আচরণ করে, তারাও সে আচরণই করেছে, যেভাবে হত্যাকা- ঘটায়, সেভাবেই ঘটিয়েছে। এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে বিডিআর হত্যাকান্ডের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। দেশের মানুষ এখনও বিশ্বাস করে না, বিডিআর’র সদস্যরা সেনা কর্মকর্তাদের ওইভাবে হত্যা করে। তখন একথা চাওর হয়েছিল যে, বাইরে থেকে আসা ঘাতক দল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা করে।
বিডিআর’র মতই পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিতে যারা কাজ করছে, তারা বাংলাদেশেরই সন্তান। তারা এরকম নৃশংস হত্যাকা- ঘটাতে পারে একথা বিশ্বাস করতে চায় না দেশের মানুষ। তাহলে কি বাইরের কোনো ঘাতক দল এ কাজ করে গেছে? এর জবাব এ মুহূর্তে কারো কাছে নেই। তবে সত্য কখনই গোপন থাকে না। এরকম কিছু হয়ে থাকলে তাও একদিন জানা যাবে। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, শাপলা চত্বরে অবস্থানকারী হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও ধর্মপ্রাণ লোকদের রাতের আঁধারে ওইভাবে অভিযান চালিয়ে হটিয়ে দেয়া কি এতই জরুরী হয়ে পড়েছিল? এমন কি ক্ষতি হতো যদি অবস্থানকারীরা দু’চার দিন ওখানে থেকেই যেতো? সমাবেশ থেকে হেফাজত নেতৃবৃন্দ বলেছিলেন, তাদের আমীর আল্লামা আহমদ শফী সমাবেশে এসে যে নির্দেশ দেবেন সে নির্দেশই তারা পালন ও অনুসরণ করবেন। কিন্তু আল্লামা আহমদ শফী সমাবেশের উদ্দেশে রওনা দিয়ে নিরাপত্তাজনিত কারণে পুলিশের অনুরোধে ফিরে যেতে বাধ্য হন। অবস্থানকারীরা অতঃপর শাপলা চত্বরেই থেকে যায়। আমরা দেখেছি, ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত শাহবাগ চত্বরে তথাকথিত জাগরণ মঞ্চের লোকেরা অবস্থান করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সরকার একবারও তাদের হটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেনি। উল্টো সর্বপ্রকার সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। অথচ দেশের আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের একদিনের অবস্থানও সরকার সহ্য করতে পারেনি। এই বৈপরীত্য কেন, তার কোন জবাব নেই। সরকার বস্তুত তার আচরণ ও কাজ দিয়ে প্রমাণ করেছে শাহবাগীদের প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। ৯০ শতাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের আবেগ ও দাবির কোনো মূল্য তার কাছে নেই।
সরকারের তরফে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শীরা তা একেবারই মানতে রাজী নয়। হেফাজতের নেতাকর্মীরা তান্ডব চালিয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর আগে হামলা চালিয়েছে একথা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। যখন পল্টনসহ অন্যান্য এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের ক্যাডারদের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, গুলীতে হেফাজত কর্মী ও পথচারীরা হতাহত হয়েছে, তখনো শাপলা চত্বরে অবস্থানকারীরা অপরিসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয়  দিয়ে শান্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে সেখানেই অবস্থান করেছে, বেপরোয়া হয়ে উঠেনি। হতাহতদের জন্য দোয়া-দুরূদ পড়েছে, আল্লাহর জিকির করেছে, অপেক্ষা করেছে। অথচ অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা ব্যাপকভাবে ভাঙচুর করেছে, দোকানপাটে হামলা করেছে, যানবাহন পুড়িয়েছে, কোরআন-কেতাব পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছে। এক কথাতেই এসব অভিযোগের জবাব দেয়া যায়। আর তাহলো, আলেম-ওলামা, যারা কোরআন-কেতাব পড়ান, কোরআন-কেতাবের আলোচনা করেন, বই-পুস্তক লেখেন, কোরআন-কেতাব অনুযায়ী চলেন, তারা বা তাদের অনুসারীরা কোরআন-কেতাবে আগুন দিতে পারেন না। এসব অপকর্ম কারা করেছে বা করতে পারে, তা অনুমানের ঊর্ধ্বে নয়। যারাই তা করুক, তাদের দায় ও অপরাধ এখন হেফাজতের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। নির্বিচার হামলা-গুলীবর্ষণ ও হতাহতের ঘটনা ধামাচাপা দিতে কিংবা তাকে যুক্তিসিদ্ধ করতে এটা করা হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। পুরো ঘটনা প্রবাহে দু’টি টিভি চ্যানেলকে খুবই সক্রিয় দেখা গেছে। তারা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও তান্ডবের চিত্র ও রিপোর্ট তুলে ধরে, তার দায় হেফাজত নেতা-কর্মীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অভিযানে’র ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। একজন প্রবীণ আইনজীবী এক টিভি টকশোতে হেফাজত কারা, তারা কোথা থেকে এলো, এমন প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি এবং তার মত আরও কোনো কোনো টকার হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। বস্তুত ওই দুটি টিভি চ্যানেলসহ এই টকাররা উস্কানি দিয়েছেন, যার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। হতাহত ও নিখোঁজের সঠিক সংখ্যা কত তা আমাদের জানা নেই। জনশ্রুতি রয়েছে, এ সংখ্যা হাজার হাজার। সংখ্যা এখন জানা না গেলেও একদিন জানা যাবে। যারা এ জন্য দায়ী, তারাও নিজেদের গোপন রাখতে পারবেন না। একদিন তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। এই ঘটনায় দেশের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এ মুহূর্তে কারো পক্ষে তা আন্দাজ করা সম্ভব নয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। পরিশেষে, আমরা নিহতদের আত্মার মাগফেরাত এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads