শুক্রবার, ২৪ মে, ২০১৩

জামা কেটে মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেন শিকিকা

ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে মানুষ যে কত নিচু কাজ করতে পারে তার আরো একটা উদাহরণ পাওয়া গেল উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। গত ২২ মে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে ৫০ ছাত্রীর ফুল হাতার স্কুল ড্রেস কাঁচি দিয়ে কেটে ছোট করে দিয়েছেন শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দীন রাজুর স্ত্রী ভাইস প্রিন্সিপাল মাহবুবা খানম কল্পনা। তার এই ঔদ্ধত্য এখানেই শেষ হয়নি, তিনি এরপর জামা কাটারও হুমকি দিয়েছেন। মাহবুবা খানম কল্পনার এই আচরণ মেনে নিতে পারেননি শিার্থী ও অভিভাবকেরা। অনেক শিার্থীই ছাত্রদের সামনে এভাবে তাদের অপমানিত করায় কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ হাত কেটে যাওয়ার অভিযোগ করেন। অভিভাবকেরা প্রকাশ করেন ুব্ধ প্রতিক্রিয়া। অভিভাবক সায়মা সুমি জানান, ইভটিজিং প্রতিহত করতে এত প্রচেষ্টা চালানো হয়। আবার ফুলহাতা ড্রেস পরে এলেও তা কেটে দেয়া হবে। তাহলে ইভটিজিং কমবে কিভাবে? আমরা মেয়েদের শালীনতার কথা চিন্তা করে হিজাব ও ফুলহাতা জামা পরতে উৎসাহিত করি সেখানে স্কুল কর্তৃপ বাধা দিচ্ছে। অভিভাবক জহিরুল ইসলাম জানান, মুসলিম দেশে মেয়েরা ফুলহাতা পোশাক পরতেই পারে। যদি এটি তাদের পছন্দ না হয় তাহলে জিন্সের প্যান্ট ও গেঞ্জি পরার নিয়ম করুক। তিনি মন্ত্রীর স্ত্রী বলে যা ইচ্ছা তা-ই করবেন এটা হতে পারে না (দৈনিক মানবজমিন, ২৩.০৫.২০১৩)।

জানি না, এ ঘটনা যদি রাজিউদ্দীন রাজুর স্ত্রী ভাইস প্রিন্সিপাল মাহবুবা খানম কল্পনার বেলায় ঘটত কিংবা তার মেয়ের বেলায় ঘটত, তাহলে তিনি কিভাবে সহ্য করতেন। শত শত ছেলেমেয়ের সামনে নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর মেয়েদের তিনি এভাবে অপমান করলেন কী করে? তার মোটেও বিবেকে বাধল না? মানুষ তো অবুঝ নয়, তার তো সভ্যতা ভব্যতা বলতে কিছু আছে। নাকি মতার দাপট তার মনুষ্যত্ববোধকেও কেড়ে নিয়েছে। তার এই জংলি ও অসভ্য কর্মের আমরা নিন্দা ও ধিক্কার জানাই।
মাহবুবা খানমের শিাগত যোগ্যতা হয়তোবা অনেক। কিন্তু তিনি যে স্বশিায় শিতি হতে পারেননি তা তিনি প্রমাণ দিলেন এই অযাচিত কর্ম করে। তিনি হয়তো জানেন না তিনি যে কাজটি করেছেন তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, Everyone has the right to freedom of thought, conscience and religion; this right includes freedom to change his religion or belief, and freedom, either alone or in community with others and in public or private, to manifest his religion or belief in teaching, practice, worship and observance. অর্থাৎ প্রত্যেকেরই চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের অধিকার রয়েছে। নিজ ধর্ম অথবা বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতা এবং একাই অথবা অপরের সহিত যোগসাজশে ও প্রকাশে বা গোপনের নিজ ধর্ম বা বিশ্বাস শিাদান, প্রচার, উপাসনা ও পালনের মাধ্যমে প্রকাশ করার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সনদে যারা সাইন করেছে তারা এই সনদ মানতে বাধ্য। আমাদের জানা মতে কেবল সৌদি আরবসহ দু-তিনটি রাষ্ট্র বাদে এই সনদ মেনে নিয়েছে। মানবাধিকার সনদের এই ধারা অনুযায়ী যেকোনো ছেলেমেয়ের ধর্ম-কর্ম পালন করার অধিকার আছে এবং তা গোপনে অথবা প্রকাশ্যে সব জায়গায়। এ ঘোষণা অনুযায়ী যে-কেউ তার ধর্ম ও মত পরিবর্তন করারও অধিকার রাখে; যদিও বা এতে ইসলাম ধর্মের আলাদা ব্যাখ্যা রয়েছে। যেসব মেয়ের জামার হাতা কেটে দেয়া হয়েছে তারা জানিয়েছে, তারা হিজাব পরার কারণে স্কুলড্রেসের শুধু হাতা লম্বা করেছে। কেননা হিজাবের সাথে হাতা কাটা ড্রেস বেমানান। স্কুলের প্রিন্সিপাল বলেছেন, কেউ হিজাব বা পর্দা করতে চাইলে তাকে অনুমতি নিতে হবে। তার এ বক্তব্য হিউমান রাইটস বিরোধী কথা। মানবাধিকার সনদের কোথাও ধর্মকর্ম করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করার কথা বলা হয়নি। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪১ ধারার (১)-এর ক ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে; এবং খ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে। উদয়ন স্কুল কর্তৃপ আমাদের দেশের সংবিধানকেও লঙ্ঘন করেছেন। আমাদের সংবিধানেও পর্দা করার জন্য অনুমতি নিতে হবেÑ এমন কথা কোথাও লেখা নেই।
উদয়ন স্কুলের যেসব মেয়ের জামার হাতা কাটা হয়েছে, সেসব মেয়ের পরনে স্কুলের ইউনিফর্মই পরা ছিল। শুধু হাফ হাতার বদলে তারা লম্বা হাতা পরেছে। এটি তারা করেছে পর্দার খাতিরে। এখানে দেখা যাচ্ছে, তারা স্কুলের আইনকে শ্রদ্ধা করে ধর্মীয় বিধান রার করার জন্যও চেষ্টা করছে। যে সময়ে সমাজে ইভটিজিংয়ে ভরে গেছে। চার দিকে অশ্লীলতা আর অসভ্যতার পদধ্বনি, যে সময়ে কিছু মেয়ে শালীনভাবে চলাফেরা করে নিজেকে হেফাজত করতে চাইছে, সেই সময়েই তাদের ওপর নেমে এলো অপমানের খড়গ। এটিকে টিজিং ও নারী নির্যাতনও বলা চলে। যে শিকিা মানবাধিকার জানে না সে আবার কেমন শিক? যে শিকিা নিজ কন্যাতুল্য মেয়েদের এভাবে মানসিক নির্যাতন ও সবার সামনে অপদস্থ করেন তার অ্যাকাডেমিক শিার কোনোই মূল্য নেই। আমরা কি পশুসমাজে বসবাস করছি? যেখানে-সেখানে যার যা ইচ্ছা তা-ই করে যাবে। সেকুলারিস্টদের কেউ কেউ বলেন, দেশ চলছে মদিনা সনদ অনুযায়ী। তাদের বলব, এ কেমন মদিনার সনদ! মাননীয় আদালত রুল দিয়েছে, কাউকে জোর করে হিজাব পরানো যাবে না। কিন্তু কারো পোশাক জোর করে কি কেটে দেয়ার অধিকার কেউ রাখে? আমরা কোন দেশে বাস করছি? এ কর্মটি কেউ যদি কোনো বৌদ্ধদের বেলায় ঘটাত তাহলে আজকের সুশীলসমাজ হতে শুরু করে সব মিডিয়া হইচই করা শুরু করত। মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা তখন বিবৃতির ফুলঝুরি ছাড়তেন। মুসলমানের বেলায় কাজটি সম্পাদন করা গেছে। কেননা মুসলমানের তো আর মানবাধিকার নেই! ওরা বেঁচে থাকবে অন্যের ইচ্ছায়। যে সমাজে এক হাত লম্বা হাতা মেনে নেয়া যায় না সে সমাজ যে কতটা সাম্প্রদায়িক তা একটু হলেও অনুধাবন করা যায়। অথচ এরাই সারা দিন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলেন। তারা মুখে না বললেও কাজ করে প্রমাণ দিচ্ছেন যে, ইসলামকে তাড়িয়ে দিতে পারলেই সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ গড়া যাবে। বাংলাদেশ হবে সেকুলার রাষ্ট্র। বাংলাদেশকে যারা সেকুলার রাষ্ট্র বানাতে চান তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, দুষ্ট ছেলেদের হয়রানি থেকে বাঁচাতে পাশ্চাত্যের কোনো কোনো স্কুলে হাফপ্যান্ট বাদ দিয়ে মেয়েদের ফুলপ্যান্ট পরার বিধান চালু করেছে। আর আমরা কি না ফুলহাতা কেটে হাফহাতার জামা পরাতে বাধ্য করছি!
পরিশেষে বলব, জোর করে এ দেশের ছেলেমেয়েদের ধর্মবিদ্বেষী বানানোর পাঁয়তারা বন্ধ করুন। মানবাধিকার ও সাংবিধানিক আইনকে শ্রদ্ধা করতে শিখুন। এ দেশে যেকোনো ছেলেমেয়ের হাফপ্যান্ট, জিন্স প্যান্ট ও খোলামেলা পোশাক পরার স্বাধীনতা থাকতে পারলে শালীন পোশাক পরে নিজেকে পবিত্র রাখতে বাধা কোথায়? এক দিকে চলে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সভা-সেমিনার, আরেক দিকে চলে শালীন পোশাক পরিধানকারীদের ওপর অত্যাচার। এটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আচরণ। এ আচরণ ত্যাগ করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads