বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৩

মানবাধিকার ও নির্যাতন


সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ চতুর্দিকে উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পোশাক শিল্প, নারী, সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিবরণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কর্মরত মানবাধিকার সংগঠন কর্তৃক প্রকাশিতও হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নানা মাত্রার প্রকাশ্য ও গোপন; শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চিত্রও উদ্ভাসিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও নির্যাতন সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা সময়োপযোগী ও যথার্থ হবে।
মানবাধিকার হলো মানুষের সেই সব একান্ত চাহিদা যেগুলো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি, ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা, উদ্যমশীলতা ও সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে। অর্থাৎ যে সকল একান্ত চাহিদা পূরণ ছাড়া মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না- সেই একান্ত চাহিদাগুলোই হচ্ছে মানবাধিকার। যেমন খাদ্যের চাহিদা, শিক্ষার চাহিদা, বাসস্থানের চাহিদা। অন্যদিকে নিরাপত্তার চাহিদা, ধর্মপালনের চাহিদা, জীবন ধারণের চাহিদা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার চাহিদা, নির্যাতন থেকে মুক্তির চাহিদা, বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের মাধ্যমে মত প্রকাশের চাহিদা ইত্যাদি।
মানবাধিকারের উৎস ও আইনগত ভিত্তি কোথায় আছে, তা-ও স্পষ্ট। মূলত বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ বিশেষত মুসলমানদের জীবন ব্যবস্থা স্বরূপ বিশ্ব মানবের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা প্রদত্ত পবিত্র কুরআন মানব মুক্তি ও মানব অধিকারের উজ্জ্বল সনদ। বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতি ও ইতিহাসেও মানবাধিকারের কিছু দিক-নির্দেশনা রয়েছে। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় মানবাধিকারের স্বীকৃতি বিধৃত।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংবিধান হলো মানবাধিকারের উৎস।
মানবাধিকার বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে যে, নির্যাতন কি? নির্যাতন সম্পর্কে এক কথায় প্রদত্ত কোনও সংজ্ঞা নেই। নির্যাতন তখন হবে, যখন, কোন কাজ যা দৈহিক বা মানসিক ব্যথা বা দুর্ভোগ বৃদ্ধি করে; কোন মানুষ বা তৃতীয় কারো কাছ থেকে কোন তথ্য বের করার কাজে বা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করা হয়; নির্যাতিত ব্যক্তি বা তৃতীয় কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ করে থাকলে বা করেছে বলে সন্দেহবশতঃ শাস্তি প্রদান করা হলে; অথবা ভয় দেখানোর জন্য বা মানবিক আতংক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে; কোন সরকারি কর্মকর্তার নির্দেশে, সম্মতিক্রমে বা অন্যকোন পন্থায় এ ধরনের যন্ত্রণা চাপিয়ে দেয়াকে নির্যাতন বলা হয়, যা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আরও ব্যাপক ব্যাখ্যায় নির্যাতন হলো অতিরিক্ত মাত্রায় ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ঠুর, অমানবিক, অবমাননাকর আচরণ এবং শাস্তি। মানব গোষ্ঠীকে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক  অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তিরোধ কল্পে জাতিসংঘ ঘোষণা রয়েছে।  এছাড়াও  নিয়মতান্ত্রিক বা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে; কোন ব্যক্তির ইচ্ছায় বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে; কোন তথ্য উদঘাটনের জন্য অথবা অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্যে শারীরিক বা মানসিক কষ্ট দেয়াকে নির্যাতন ও মানবাধিকারের খেলাপ কাজ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্য এক ব্যাখ্যায়, কাউকে মারাত্মক ব্যথা বা যন্ত্রণাদায়ক শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দেয়াকে নির্যাতন বলে, যা সংজ্ঞায়িত করেছে ইউরোপিয়ান মানবাধিকার কমিশন। তদুপরি, নির্যাতন-এর ক্ষেত্রে এমন কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করা, যার মাধ্যমে নির্যাতিতের ব্যক্তিত্ব ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়া হলে এবং তার শারীরিক অথবা মানসিক শক্তিকে লুপ্ত করা হলে মানবাধিকারের চরম অবমাননা হয়। মানবাধিকার আর নির্যাতন এক সঙ্গে চলতে পারে না। কারণ, নির্যাতনের ফলে দৈহিক অঙ্গহানি ঘটে; মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়; অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি হয়; নির্যাতিত ব্যক্তি নিজের/ পরিবারের/ সমাজের কাছে বোঝা হয়।
সাধারণত নির্যাতন কিভাবে সংঘটিত হতে পারে, তারও বহুবিধ চিহ্নিত ক্ষেত্র  রয়েছে। যেমন: নির্যাতন শারীরিক অথবা মানসিক দিক থেকে হতে পারে; পুলিশ বা সরকারি বাহিনীর হেফাজতে হতে পারে; অথবা বিশেষ কারও নিয়ন্ত্রণেও হতে পারে ।
ফলে নির্যাতন আধুনিক আইন ও মানবতায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ধারা-৫ অনুযায়ী কাউকে নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক অথবা অবমাননাকর আচরণ অথবা শাস্তি ভোগে বাধ্য করা চলবে না। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি ১৯৬৬-এর ধারা ৭ অনুযায়ী কাউকে নির্যাতন অথবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানুষিক কিংবা মর্যাদাহানিকর আচরণ করা যাবে না, অথবা অনুরূপ শাস্তি প্রদান করা চলবে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান-এর অনুচ্ছেদ ৩৫(৫) অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দ- দেয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, ২৬ জুন নির্যাতিতের সমর্থনে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক দিবস। কেন এই দিবস, সেটা অনেকেই জানেন না। মূলত ১৯৮৭ সালের ২৬ জুন থেকে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তি বিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তি-ক্যাট, ১৯৮৪ কার্যকর হয় বলে ২৬ জুন নির্যাতিতদের সমর্থনে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক দিবস । ১৯৮৭ সালের ২৬ জুন ২০তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ডেনমার্ক এই চুক্তি অনুমোদন করেন। এক্ষেত্রে কোনগুলি শারীরিক নির্যাতন, সেটাও উল্লিখিত হয়েছে। যেমন, যেটা ক্ষত সৃষ্টি করে, যেটা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ ঘটায়, শরীরের কোন অংশ ভেঙ্গে দেয়া, করোটিতে আঘাত করা, পায়ের তালুতে বেত্রাঘাত করা, বিভিন্ন পদ্ধতিতে শরীর পুড়িয়ে দেয়া, যেমন সিগারেটের আগুনে, ইলেকট্রিক শক দ্বারা, উল্টো করে শরীরটাকে মাটি থেকে অনেক উচুঁতে ঝুলিয়ে রাখা, বিভিন্নভাবে শ্বাসরুদ্ধ করা, নখ ও দাঁত উপড়ে ফেলা, যৌন আক্রমণ, যেমন, ধর্ষণ অথবা যৌনাঙ্গে কোন বস্তু ঢুকিয়ে দেয়া, সাবমেরিন পদ্ধতি ব্যবহার করা অর্থাৎ বন্দীদের মুখোশ পরিয়ে ময়লা পানিতে মুখ চুবানো, শরীরের বিভিন্ন অংশে লাঠি দিয়ে আঘাত করা, লাথি মারা, দম বন্ধ করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো, হাত, পা বেঁধে পুকুরে সাঁতার দিতে বলা, শরীরের বিভিন্ন অংশে সুঁচ ঢুকিয়ে দেয়া, বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দেয়া ইত্যাদি।
বস্তুতপক্ষে, নির্যাতন হচ্ছে একটি ইচ্ছাকৃতভাবে অর্পিত অমানবিক আচরণ, যার মাধ্যমে খুবই মারাত্মক ও নিষ্ঠুর যন্ত্রণাকে বুঝায়। মানবাধিকার প্রসঙ্গে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণভাবে চলে আসে। মানসিক নির্যাতন হচ্ছে যেখানে দেহকে আঘাত করা ছাড়াই একটি যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। এ রকম মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে, ফাঁসি দেয়ার ভান করা, জানালা বা উচ্চস্থান থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার হুমকি প্রদর্শন করা, গালিগালাজ করা ও অপমানজনক ভাষা ব্যবহার করা, মাথায় আঘাত করা বা বমি মেখে দেয়া, জেল অভ্যন্তরে আলাদা সেলে রেখে খাদ্য পানীয় এবং পয়ঃ নিষ্কাশন করা থেকে বঞ্চিত রাখা, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, অথবা বন্ধুদের প্রতি অমানবিক অথবা অন্যায় আচরণ অবলোকন করতে বাধ্য করা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু- বান্ধবের উপর সহিংসতামূলক আচরণ করা হবে বলে হুমকি প্রদর্শন করা, দেহ থেকে অঙ্গ কেটে ফেলার ভান করা, দীর্ঘদিন ধরে নির্জন কারাগারে আটক রাখা, এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে বন্দি অবস্থায় এমন কিছু শুনবে বা দেখবে যেগুলো আসলে বাস্তব নয় এবং ভীতি-উৎপাদনমূলক, মুখের মধ্যে অস্ত্র ধরা, পার্শ্ববর্তী বন্দিকে এমনভাবে নির্যাতন করা যেন সে শুনতে পেয়ে মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠায় নিপতিত হয়, দীর্ঘদিন নির্জন কারাবাস দেয়া এবং হত্যার জন্য হুমকি প্রদর্শন করতে থাকা, দীর্ঘসময় ধরে অনিশ্চিতভাবে আটকে রাখা, আত্মীয়-স্বজনদের নির্যাতন অথবা হুমকি দেয়া, নির্জন জায়গায় ফাঁসির দৃশ্য দেখিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা, আত্মীয়-স্বজন থেকে অদৃশ্য করে ফেলা ইত্যাদি।
এমতাবস্থায় কিভাবে নির্যাতনের প্রতিকার সম্ভব, সেটাও ভেবেছেন মানবতাবাদীরা। এইক্ষেত্রে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে প্রাথমিক প্রতিকার করা হয়। তাছাড়া শারীরিক চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে, মানসিক চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে, আইনগত কাউন্সেলিং প্রদান করে, আইনগত সহায়তা  ও আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা দায়েরের মাধ্যমে, সামাজিক সম্মান প্রদান করে, পেশা পরিবর্তনের দ্বারা সম্মানিত করে, প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে, ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে, সম্মান ফিরিয়ে দেয়ার দ্বারা, নির্যাতনকারীর শাস্তি বিধান ও প্রকাশ্যে জন সম্মুখে মাফ চাওয়ার মাধ্যমে, পুনরায় এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, তার নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে প্রতিকারের চেষ্টা করা হয়, যদিও শারীরিক ও মানসিক প্রতিকার পুরোপুরি পাওয়া একটি অসম্ভব ব্যাপার।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে গুয়ানতানামো নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগারে নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি বন্দিদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দিদের বিনাবিচারেও আটক রাখা হত এবং তথ্য আদায়ের নামে বিভিন্ন আইন বহির্ভূত নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের তীব্রতার কারণে এটাকে ‘দুনিয়ার নরক’ নাম দেয়া হয়। বর্তমানে বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত মানুষের প্রতিও ক্ষমতাসীনরা নির্যাতনের নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। মানবাধিকার সেখানে ভুলুণ্ঠিত। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশে-বিদেশে যেসব প্রতিবেদন ও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, সেগুলোও আশাব্যঞ্জক নয়। মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য মানবাধিকারের স্বীকৃতি ও নির্যাতনের অবসান জরুরি। এ ব্যাপারে সকলকে মনোযোগী হতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads