বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০১৩

রক্তের রঙ লাল, ঝরে বেদনার অশ্রু



বাংলার মানুষ ভালো নেই। ঘরে-বাইরে, দিনে-রাতে সর্বদাই আতঙ্ক আর ভীতির মধ্যে সময় অতিবাহিত হচ্ছে। সুখ-শান্তি, আনন্দ-উল্লাস সবই মানুষের অন্তর থেকে বিদায় নিয়েছে। পত্রিকা আর টেলিভিশনের খবর দেখলে মনে হয় এ দেশে যুদ্ধ চলছে, যার এক পক্ষ সরকার অন্য পক্ষ জনগণ। তবে কঠিন বাস্তব হচ্ছে সরকার যখন প্রতিপক্ষের আকৃতি ধারণ করে, সাধারণ জনগণ তখন অসহায় হয়ে যায়। বাংলাদেশের জনগণের মানবীয় গুণগুলোর মধ্যে কিছু বৃদ্ধি পেয়েছে, কিছু আবার কমেছে। যেমনÑ মানুষের ধৈর্যশক্তি, সহিষ্ণুতা আর সপরিবারে বেঁচে থাকার বাসনা। এই মানবীয় গুণাবলি বৃদ্ধির কারণেই রক্তের নদীতে সাঁতার কেটে সরকার এখনো বহাল তবিয়তে আছে। কমেছে মানুষের দেশপ্রেম, জীবপ্রেম, নীতি-আদর্শ আর সততার প্রীতি। নয়তো যেকোনো কর্মসূচিতে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের ওপর যেমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ কেড়ে নেয়, তাতে মনে হয় আমরা কোনো এক বর্বর সমাজে বসবাস করছি। রক্তের রঙ লাল, তাই ঝরে বেদনার অশ্রু। সে রক্ত যারই হোক না কেন। বিরোধী দলের নেতাকর্মী কিংবা দায়িত্ব পালনরত কোনো পুলিশ সদস্য অথবা কোনো সাংবাদিক, রাজনীতিক পথচারী, খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, নারী-পুরুষ, হেফাজতে ইসলামের সদস্য কিংবা জাগরণ মঞ্চের সদস্য হোক না কেন। সব অপমৃত্যুই আমাদের হৃদয় থেকে রক্ত ঝরায়, চোখ ঝরায় সমবেদনার অশ্রু। অমর সঙ্গীতশিল্পী ভুপেন হাজারিকার সেই কালজয়ী গানের সুরের মূর্ছনায় বর্ণিত আছে, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি এই মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু।
সব হত্যার দায়ভার সরকারের কাঁধে স্তূপাকৃত হয়ে জমা হচ্ছে। একসময় লাশের ভারে নুইয়ে পড়বে সরকারের দাম্ভিক মস্তক। কারণ ইতিহাসের শিক্ষা কখনো মিথ্যা হতে পারে না। ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনা কি এতটাই অপ্রতিরোধ্য যে, নিরীহ মানুষের লাশের ওপর দিয়ে মসনদের সিঁড়ি খুঁজতে হবে? সরকার সম্পূর্ণরূপে গণবিচ্ছিন্ন তাই অনুধাবন করতে পারছে না যে কার্যসিদ্ধি হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বিগত যে দলগুলো এসেছিল, সেটা গণতান্ত্রিক উপায়ে হোক কিংবা সামরিক শাসন জারি করার পরে হোক, এতটা নিরেট, হিংস্র আর অসত্য বলায় পারদর্শী ছিল না। সব এমপি, মন্ত্রীর কথা একই সূত্রে গাঁথা এবং সেগুলো শুনলে মনে হয় বাংলার সব মানুষ যেন আফিম খেয়ে ঝিমোচ্ছে। বিশেষত এ ধরনের কথা শুনে শিশুদের মস্তিষ্কও গরম হয়ে যায়। ১৯ এপ্রিল গণভবনে কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষ হত্যা করাই বিএনপির চরিত্র। এর আগেও তিনি বিরোধী দলের নেত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছেন, আর মানুষ হত্যা করবেন না, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে একদম চোখেমুখে কৃত্রিম বেদনার ছাপ এনে একধরনের অভিনয় করে থাকেন প্রকৃত মানুষ হত্যাকারীরা। হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সঠিক কথাই বলেছেন। এ সরকার চরম মুনাফিক নীতি অনুসরণ করে চলেছে। নয়তো অবুঝ শিশুরাও জানে ক্ষমতার মসনদকে দীর্ঘস্থায়ী করতে বর্তমান সরকারই নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে চলেছে। বিরোধী দলের নেত্রী নন। বরঞ্চ জেল, জুলুম, গুম, খুন, হামলা, মামলা দিয়ে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে মহাজোট সরকার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। তারা চোরকে বলে চুরি করো আর গৃহস্থকে বলে সজাগ থাকো।
দ্বৈতনীতি অনুসরণ করা ব্যক্তিদের কোনো আদর্শ থাকে না। তাই তারা স্বার্থরক্ষায় নির্মমতার শেষপর্যায়ে যেতে পারে। ৬ মার্চ লংমার্চ শেষে হেফাজতের কর্মীরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় জাগরণ মঞ্চের একটি গ্রুপ বাঁশের লাঠি নিয়ে দৌড়ে পার্কের মধ্যে ফেলে পিটিয়ে যেভাবে রক্তাক্ত করেছিল দেখে চোখের পানি ধরে রাখা যায়নি। আক্রমণকারীরা বিকেল থেকেই লাঠি নিয়ে মহড়া দিচ্ছিল। বাঁশের লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত ছেলেটির গ্রুপে আমার এক পরিচিত ভাইও ছিল। তারা দৌড়ে কোনো রকমে আত্মরক্ষা করেছিল। বর্তমানে শিবিরের সভাপতিকে রিমান্ডের পর রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে চলেছে। আমার দেশের  মাহমুদুর রহমানকে দীর্ঘ দিন কার্যালয়ে বন্দী করে অবশেষে ১১ এপ্রিল গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিয়েছে। এই সরকার চায়, মাহমুদুর রহমানের মতো মেধাবী, নিষ্ঠা ও আদর্শবান আর পরিশ্রমী ব্যক্তিকে মেরে ফেলতে, যাতে তাদের নিপীড়ন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কেউ আঙুল তুলতে না পারে। শিবির সভাপতিকে যে দিন গ্রেফতার করা হলো, দেখেছি তার শান্ত, সৌম্য, মার্জিত মুখচ্ছবি। অথচ রিমান্ডের পর তাকে দেখেই বোঝা গেছে কী পরিমাণ পুলিশি আগ্রাসন তার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। অথচ ধোঁকাবাজির বক্তব্য দিয়ে নিজেদের অসততা এবং দেউলিয়াত্বের প্রকাশ করছেন সরকারের উচ্চমহল। রাজশাহীতে পুলিশ কর্মকর্তার থেঁতলানো দেহটি দেখেও মানবতা কেঁদে উঠেছে হু হু করে। এর সব দায়দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। সরকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তীব্র সঙ্ঘাতের মধ্যে পুলিশ, বিজিবিদের পাঠিয়ে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করছে। সাধারণ গণমানুষের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেই তো সব সঙ্কটের নিরসন হয়। কিন্তু তারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা চায় না, সে জন্যই বলেছে কিয়ামত হয়ে গেলেও নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবে না। অর্থাৎ ১৫ কোটি জনগণের মধ্য থেকে নিহত হয়ে সাত কোটি হয়ে যাক, তবুও ক্ষমতার মসনদ কিছুতেই ছাড়বে না।
মহাজোটের প্রভাবশালী নেতা সৈয়দ আশরাফ হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে কী উদ্দেশ্য হাসিল করতে চান বোঝা মুশকিল। হেফাজতের সহনশীল আর উদারতাকে কটাক্ষ করে তিনি বলেছেন, তারা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। তিনি পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষের পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন। সাবেক এমপি এবং বিএনপির জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করে রেখেছে, গত ১৭ এপ্রিল এক বছর পূর্ণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারকে আশ্বাস দিয়েও সে কথা রাখেননি। সে দিন হেফাজতের ওই কর্মীকে চার দিক দিয়ে ঘিরে বাঁশ দিয়ে পেটাতে দেখে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করে তার লাশের ওপর নৃত্য করার পৈশাচিক দৃশ্যটির কথা স্মরণ হয়ে গিয়েছিল। সে দিনের সে আত্মস্বীকৃত খুনি এখনো লম্ফঝম্ফ দিয়ে যাচ্ছে। এদের বিচার করার কেউ নেই। আইন শুধু সরকারি দলের অপরাধের সময় অন্ধ হয়ে যায়, আর বিরোধী দলের দোষ খোঁজার জন্য দৃষ্টিতে লেন্স লাগিয়ে বৃদ্ধি করে নেয়। এমনকি সরকারি দলের সন্ত্রাসী ছাত্রলীগেরা প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিৎকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করল, সে বিচারও ন্যায্যভাবে হচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছেলে ত্বকীকে হত্যা করল যারা, তারা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী বলে পুলিশ তাদের টিকিটিও ছিঁড়তে পারছে না। বরং সকাল-বিকেল স্যালুট দিয়ে তাদের সুরক্ষা করে চলেছে। এত কিছুর পরও সরকারি এজেন্টরা গণতন্ত্রের কথা বলে, মানবাধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর ন্যায়-অন্যায় নিয়ে গালভরা বুলি আওড়ায়। ভণ্ডামির একটা মাত্রা থাকা দরকার। আর নির্লজ্জ বেহায়াপনারও কিছুমাত্র সীমান্ত পরিসীমা থাকা দরকার। আগামীকাল আদালত কী পদক্ষেপ নেবে মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা আগে থেকেই সব বলে দিতে পারেন। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের আগে যুগ্ম মহাসচিব আগেই কিছু আভাস দিয়েছেন। আবার গ্রেফতারের পর বলেছেন, তার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে গ্রেফতার করা হবে এবং প্রয়োজনে পত্রিকাটিতে সিলগালা করে দেয়া হবে। অর্থাৎ সরকারের নির্দেশ ছাড়া আদালত এক ইঞ্চি নড়ে না। এমনিতেই বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপূর্ণ দেশ। কিছু দিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্মরণকালের ভয়াবহ সিডর হয়ে গেল। এখনো মহাসেনের ছোবল শেষ হয়নি। এরপর প্রায় প্রতিদিনই ঝড়, ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে এ জনপদের ওপর দিয়ে। সে দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রƒক্ষেপ না করে কেবল দমন-পীড়ন আর হত্যায় যেন মেতে রয়েছে সরকার। অসহায় এই মানুষদের হত্যার দায়ভার যার ওপরই চাপান না কেন, সরকারপ্রধানকেই এক দিন সব অপমৃত্যুর মূল্য কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে হবে। অত্যাচারীর ঢাল-তলোয়ার যতই শাণিত হোক না কেন, সময় ও সত্যের কাছে তার পরাজয় অনিবার্য।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads