শনিবার, ১৮ মে, ২০১৩

রাজনৈতিক মীমাংসার সংলাপ ও রূঢ় বাস্তবতা


সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে পৌঁছে মতাসীনেরা আখের গোছাতে যারপরনাই মরিয়া হয়ে উঠেছে। হবু নির্বাচনের আগে সরকারপরে নেতা পাতিনেতা হাকিম আমলা ষণ্ডাপাণ্ডা ফেউ আর পোষ্যদের আখেরি সেলামি রিশ্বৎ আদায় দখলবাণিজ্য ভোগলালসার খোরাক মেটাতে জনসমাজের প্রাণ ওষ্ঠাগত। গদি রা আর আবারো মতা দখলের নীলনকশা বাস্তবায়নে সরকারের পুলিশরাজ রাষ্ট্রের দমন মতার মাত্রাহীন অপব্যবহার করে চলেছে। গণগ্রেফতার, পৌনঃপুনিক মামলা-হামলা হয়রানির কৌশলে রাজনৈতিক বিরোধিতা খর্ব না হওয়ায় সরকার জনমনে ত্রাস সৃষ্টির জন্য রাজপথে বিােভ দমনে গণহত্যার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে শুরু হয়েছে বিপ্তি রাজনৈতিক সহিংসতা। তার সাথে নানা জায়গায় যুক্ত হয়েছে গ্যাস বিদ্যুৎ সার পানিসহ নানা অব্যবস্থা ও শ্রম অসন্তোষজনিত সহিংস গণপ্রতিরোধ। প্রশাসন অচল। মফঃস্বল এলাকায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ এক রকম নেই বললে চলে। মতাসীনদের প্রশ্রয়েই গড়ে উঠেছে মাদক আর অস্ত্রচালান, চুরি, খুন, ডাকাতি, ছিনতাই ও অপহরণ বাণিজ্যে লিপ্ত অপরাধবৃত্তের অভয়ারণ্য। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। শেয়ার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক তহবিল লুট, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি ইত্যাদি আর সর্বশেষ সাভারে ফাটল ধরা বহুতল ভবনে জবরদস্তি পোশাকশ্রমিক ঢুকিয়ে ভবন ধসের গণকবর রচনার দুর্ঘটনার পেছনে সরকারের প্রশাসন ও মতাসীন নেতাদের যোগসাজশের খবর ফাঁস হয়ে দেশে বিদেশে সরকারের ভাবমর্যাদা এখন ভূলুণ্ঠিত। অর্থনীতি অবরুদ্ধ। রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা দলীয়করণের বিষক্রিয়ায় অবশ। এসব পর্বতপ্রমাণ অপকীর্তি ও রাষ্ট্রনৈতিক ব্যর্থতার দায় এড়াতে সরকার একটা ফন্দি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানোর নামে শাহবাগ প্রজন্মকে শিখণ্ডী দাঁড় করিয়ে উগ্র ধর্মনিরপেতা ও ইসলামি প্রভাব বর্জনের ব্যয়বহুল জলসা মঞ্চস্থ করেছিল টানা মাসদুয়েক । প্রতিক্রিয়ায় সমসময়ে একটা ইসলামি গণজাগরণ ঘটেছে। জনসমাজ থেকে দেশজুড়ে সেই ইসলামি জনজাগরণের দ্বিতীয় দফা ঢাকামুখী মহাসমাবেশ শেষে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘটে রত ঘুমন্ত বা অর্ধজাগ্রত সরল মানুষদের ওপর আকস্মিকভাবে গভীর রাতে সাউন্ড গ্রেনেড টিয়ারশেল নিপে আর সরাসরি শটগানের গুলি চালিয়ে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিভীষিকা সরকার সৃষ্টি করল, তাতে ইসলামের হেফাজতের সংকল্প জনমনে আরো সহমর্মিতা অর্জন করেছে, সরকারের প্রতি ধিক্কার দানা বেঁধেছে দেশব্যাপী। রাজনৈতিক বিভাজনের পাশাপাশি স্বল্পবিত্তদের লোকজ মূল্যবোধ ও বিত্তবানদের আধুনিকতার সংস্কৃতির মধ্যে ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠা সমাজনৈতিক বিভাজন তীব্র আকার ধারণ করেছে।
অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত ও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতায় কাতর বাংলাদেশ ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধাবস্থার শিকার হতে পারে কি না, দণি এশিয়ার আরেকটি উপদ্রুত এলাকা হয়ে দাঁড়াতে পারে কি নাÑ এই আশঙ্কায় টনক নড়েছে বিশ্ব শান্তির মুরুব্বিদের। প্রথমে মার্কিন দূতসহ ঢাকার কূটনীতিবিদেরা অনেকে মুখ খুলেছেন, মূলধারার রাজনীতির দুই পকে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক-সাংবিধানিক সঙ্কটের জটমুক্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তারপর চিঠি এসেছে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুনের স্বারে। সশরীরে বান কি মুনের দূত এসেছেন চার দিনের বাংলাদেশ সফরে। এসেছিলেন সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মীমাংসার তাগিদ দিতে সরকার ও বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সুশীলসমাজ ও প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিকে সক্রিয় ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করতে। তবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও জাতিসঙ্ঘ দূত উভয়েই বলেছেন, কোনো মধ্যস্থতায় তারা লিপ্ত হবেন না, বাংলাদেশের নেতাব্যক্তিদেরই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সর্বজনগ্রাহ্য একটি পন্থা খুঁজে বের করতে হবে।
অনেকেরই প্রশ্ন, রাজনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি সমাজনৈতিক যে বিভাজন পাকিয়ে উঠেছে, তারও সাংবিধানিক মাত্রাযোগ ঘটেছে; সমাজনৈতিক বিভাজনের প্রতিপকেও সংলাপের অন্তর্ভুক্ত না করলে কার্যকর কোনো মীমাংসা সম্ভব হবে কি? বস্তুত সরকারের তরফে প্রধানমন্ত্রীর মুখে সংলাপের মামুলি আহ্বান প্রথম উচ্চারিত হয়েছে বিগত সংসদ অধিবেশনের শেষ দিকে, যানবাহন বন্ধ ও পুলিশি বাধা সত্ত্বেও হেফাজতে ইসলামের ঢাকা-চলো লংমার্চের অভূতপূর্ব ব্যাপ্তি ও বিশাল মহাসমাবেশের বিস্ময়ের জেরে। আর্থ-সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য বিরোধী জোট নেত্রীকে দোষারোপ করে হলেও নির্বাচনসংক্রান্ত সংলাপে তিনি আহ্বান জানান সংসদের ভেতরে কিংবা বাইরে। জবাবে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসহ আলোচনার সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা স্থির করার জন্য। এসবই ছিল যেন বাত কে বাত। কাজ এগোয়নি।
জাতিসঙ্ঘ দূত আসার আগেভাগে হেফাজত নেতাকর্মীদের দমনে ৫ মে মধ্যরাত পরবর্তী রক্তাক্ত উচ্ছেদ অভিযানের সাফল্য প্রধানমন্ত্রীকে আবারো উৎসাহিত করেছে সংসদীয় বিরোধী দলনেতাকে কটা করে সংলাপের আহ্বান জানাতে। ৪ মে ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে খালেদা জিয়া ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম বেঁধে দিয়েছিলেন সরকারকে দমননীতি বন্ধ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে সমঝোতায় আসার জন্য। হেফাজত কর্মীদের ঢাকার মতিঝিল এলাকা থেকে উচ্ছেদের ফলে ১৮ দলীয় জোটের দৃশ্যমান খুঁটির জোর শেষ হয়ে গেছে সাব্যস্ত করে শেখ হাসিনা ব্যঙ্গোক্তিসহকারে ডাক দিলেন, জনগণ ইতোমধ্যে গত কয়েক মাস আপনাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড প্রত্য করেছে এবং তারা এ ধরনের ঘটনা আর দেখতে চায় না। এসব সহিংস কর্মকাণ্ডের জবাব দেয়ার সামর্থ্য আওয়ামী লীগের আছে। কিন্তু তারা সঙ্ঘাতের পথে যায়নি, জনগণের স্বার্থে ধৈর্য ধারণ করছে। আমরা সঙ্ঘাত নয়, শান্তি চাই। কাজেই হরতাল ডেকে জনগণকে আর কষ্ট দেবেন না। বেগম খালেদা জিয়ার আলটিমেটাম ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তিনি এখন বিপর্যস্ত বিুব্ধ। আমি বিরোধীদলীয় নেতাকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আর তিনি ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে বললেন, এ সময়ের মধ্যে তার দাবি না মানলে আওয়ামী লীগ পালানোর পথ পাবে না। আমি বিরোধী দলের নেতার কাছে জানতে চাই, কে পথ হারাল? আওয়ামী লীগ না হয়ে অন্য কোনো দল হলে বিএনপি সমুচিত জবাব পেত। সমস্যা সমাধানে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই বলেই বিরোধীদলীয় নেতার প্রতি আমাদের আলোচনার প্রস্তাব অব্যাহত থাকবে। সুতরাং চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে সংসদে বা সংসদের বাইরে আলোচনায় বসুন।
একই সাথে দলীয় নেতাদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থেকেই নির্বাচনানুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়ালেন। ১৪ দলীয় সিদ্ধান্তে বলা হলো, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হলেও এতে অন্যান্য দলেরও অংশগ্রহণ থাকবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শুধু দাফতরিক কাজ করবেন; নির্বাহী বিভাগ থাকবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে।
বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু প্রতিক্রিয়া দিলেন, আমরা সংলাপের বিপে নই। তবে সেজন্য পরিবেশ থাকতে হবে। নেতাদের আটক রেখে সংলাপ হবে কিভাবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলব, পরিবেশ ঠিক করে আপনি সংলাপের কথা বলুন। আমাদের আপত্তি থাকবে না। কিসের জন্য সংলাপে যাবো, তা স্পষ্ট করে বলুন। আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া তার বাসায় প্রধানমন্ত্রীকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সংলাপের কথা বলছেন। কোথায় কিভাবে সংলাপ হবে, জানাতে হবে। বিয়ের দাওয়াতে যাবো, পথে যদি চোর-ডাকাত থাকে তাহলে সব কিছু নিয়ে যাবে। তাই আগে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দলের নেতারা সব কারাগারে। সভা-সমাবেশের কোনো অধিকার নেই। কথা বলার অধিকার নেই। এরকম অবস্থায় সংলাপ হবে কিভাবে?
প্রধানমন্ত্রীর ওই আহ্বানকে পুঁজি করেই জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো তার দৌত্যকর্ম শুরু করে একাধিকবার সংসদীয় বিরোধী দলনেতা, সরকারপরে নেতারা ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথে সাাৎ করেছেন। সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সঙ্ঘাত ও সহিংসতায় জাতিসঙ্ঘ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এখনই সংলাপ শুরু করতে হবে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের একটি গ্রহণযোগ্য পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। আসন্ন নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হতে হবে। আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ, যা দারুণভাবে জনগণকে বিপন্ন করবে। দেশের অর্থনীতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ল্েয সংলাপে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও সাংবিধানিকভাবে টেকসই একটি প্রক্রিয়া খুঁজে বের করতে হবে। তবে এই সংলাপে কোনো ধরনের মধ্যস্থতা করবে না জাতিসঙ্ঘ।
তারানকো আরো বলেছেন, যে দেশের সৈন্যরা দেশে দেশে শান্তি রার কাজ করছেন, তাদের নিজ দেশে অশান্তি কেউ দেখতে চান না। এ কথাকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভেতরকার উদারপন্থরা সম্ভাব্য সামরিক হস্তেেপর ইঙ্গিত মনে করে রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। মিডিয়ারও আশাবাদী ভাষ্য, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নিজ নিজ অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে নির্বাচনকালীন একটি গ্রহণযোগ্য সরকারপদ্ধতি নির্ধারণে জাতিসঙ্ঘের তাগিদে সংলাপে রাজি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। দুই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য সংলাপের প্রধান এজেন্ডা হবে সব দলের অংশগ্রহণের ল্েয সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন একটি সরকারপদ্ধতি খুঁজে বের করা। নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচিত হবে, না অনির্বাচিত হবে, এর প্রধান কে হবেন তা আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ফয়সালা হবে।
ঢাকার কূটনৈতিক মহল, আরামকেদারার রাজনীতিবিদ ও সুশীলসমাজের রাঘব-বোয়ালেরা সবাই মনে করছেন, সংলাপের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করছে সরকার ও বিরোধী দলের ইতিবাচক মনোভাবের ওপর। আগামী নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে দুই পকেই ছাড়ের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে; অন্যথায় সংলাপের মাধ্যমে কার্যকর সমঝোতায় পৌঁছতে না পারলে দেশে ভয়াবহ রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে ছাড় না দিয়েও প্রধানমন্ত্রী যেমন বিকল্প সর্বদলীয় সরকারের একটি প্রস্তাব দলীয়ভাবে আলোচনায় এনেছেন, তেমনি বিরোধী নেত্রী জাতিসঙ্ঘের দূতকে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারই হতে হবে, তা নয়। নির্দলীয় ও নিরপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যেকোনো নামেই ডাকা যেতে পারে। সংলাপের প্রস্তুতির জন্য সরকারের একজন উপদেষ্টা বিএনপির একজন উদারপন্থী নেতার সাথে দুই দফা কথা বলেছেন। দুজনই দল থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু প্রস্তুতির পাঁয়তারা ছাড়া কার্যকর ফল ছিল শূন্য। ছিল আনুষ্ঠানিক পত্রের অপো।
সংলাপের বিষয়বস্তু বা আমন্ত্রণপত্রের ভাষা কেমন হবে, তা নিয়েও সরকারপ সতর্ক অস্পষ্টতার কৌশল অবলম্বন করেছে। বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপায় নিয়ে আলোচনার কথা চিঠিতে থাকলে বিএনপি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলে বিরোধী জোটের সিদ্ধান্ত। আর নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার রূপরেখা নিয়ে আলোচনার কথা থাকলে বিএনপি পুরোপুরি ইতিবাচকভাবে সংলাপ প্রস্তাব গ্রহণ করবে। এখন ১৪ দলের বৈঠকে ১৬ মে প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হবে না। সংলাপ যা হবে, সংসদের ভেতরেই হবে। তথা বিতর্ক হতে পারে, সংলাপ হবে না। তবু বিএনপি সংসদে যাবে বলে জানান সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
অন্য দিকে প্রায় দেড় মাস আগ থেকে হেফাজতের ঢাকা-চলো লংমার্চের বিশাল বিােভ সমাবেশের পরপরই ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ঢাকার দূতাবাস পাড়ায় একটি সমঝোতার ফর্মুলা আলোচিত হচ্ছিল; যার মোদ্দা কথা, সরকার চায় আগাম নির্বাচন। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জোট থেকে পাঁচজন করে প্রতিনিধি থাকবেন অন্তর্বর্তী সরকারে। এমন সরকার শুরু হবে শেখ হাসিনাকে রেখেই। তবে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে তিনি পদত্যাগ করবেন।
সরকার বিরোধীদের ধারণা, জনপ্রশাসনে যাতে বড় ধরনের রদবদল করার সময় না থাকে, সে জন্যই এ পরিকল্পনা। তাদের আরো প্রশ্ন, এরপর কে আসবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান? নির্দলীয় ব্যক্তি উভয়সম্মতভাবে নিয়োগের কথা আলোচনার জন্য রাখা হয়েছে কি? জল্পনা : সরকারের তরফে বর্তমান স্পিকারের নাম আসবে। বলা হবে, তিনি নির্বাচিত ছিলেন না। পরো ভোটে নির্বাচিত হয়ে তিনি স্পিকার হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন ঢেলে সাজানোর বিষয়ে আলোচনার পথ খোলা থাকবে।
সংশয়বাদীরা মনে করছেন, সরকারপ বিরোধী জোটের সরকার পতনের আন্দোলনকে নির্বৃত্ত করতে সময় পেণের কৌশল অবলম্বন করেছে মাত্র। উদ্দেশ্য, সংলাপের দীর্ঘসূত্রতায় বিরোধী জোটকে আবদ্ধ করে রমজানের মধ্যে শেখ হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনী মোতাবেক সাধারণ নির্বাচনের আগাম ঘোষণা দিয়ে দেবেন। ঈদের মওসুমে বিরোধী জোট কোনো শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না।
অন্য দিকে সমাজনৈতিক বিভাজনপ্রক্রিয়ায় উদ্ভূত সাংবিধানিক অমীমাংসা থেকেই যাচ্ছে। শাপলা চত্বরে অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমণের মর্মাঘাত আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে হেফাজতের প্রতিরোধ থমকে গেলেও তার প্রতিবাদের ভাষা এখনো বজ্রকণ্ঠ, দেশবাসীর সহানুভূতিও প্রবলভাবে তাদের প।ে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতের নেতাকর্মীদের উচ্ছেদে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ হয়নি বলে সরকারের প্রদত্ত সাফাই স্যাকে প্রত্যাখ্যান করে হেফাজত নেতৃবৃন্দ বিবৃতি দিয়ে বলেছেনÑ শাপলা চত্বরে ইতিহাসের বর্বরোচিত, নিকৃষ্টতম গণহত্যার পাঁচ দিন পর বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে সরকার একটি দায়সারা গোছের প্রেসনোট দিলেও এতে বস্তুনিষ্ঠ কোনো তথ্য, গ্রহণযোগ্য বক্তব্য কিংবা ইতিবাচক কোনো কথা স্থান পায়নি। সত্য, স্বচ্ছতা ও দায়বোধবর্জিত এই প্রেসনোটে সরকারের ধারাবাহিক মিথ্যাচারের প্রতিফলন ঘটেছে। সরকারের একেকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি পরস্পরবিরোধী নানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে প্রকৃত সত্য আড়াল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। সঙ্গতকারণে জনগণ এই প্রেসনোট প্রত্যাখ্যান করেছে। সম্পূর্ণ দলীয় বিবৃতির আদলে লেখা এই প্রেসনোটে সে দিনের অভিযানে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি বলে যে মিথ্যা দাবি করা হয়েছে; তার জবাবে আমরা বলতে চাই, যদি যৌথবাহিনীর অভিযানে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা না হয়, তা হলে দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টে ৫৬ জন, দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার খবর মতে ১৩ জন লোকের মৃত্যু কিভাবে হলো? মিডিয়ার সামনে ডিএমপি কমিশনার ১১টি লাশ পাওয়ার স্বীকারোক্তি কিভাবে দিলেন?
হেফাজতে ইসলামের কোনো নেতাকর্মী এসব কর্মকাণ্ডে কোনোভাবেই জড়িত ছিল না। বরং হেফাজতের ঈমানি আন্দোলনকে জাতির সামনে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য একটি মহল পুলিশের সামনে এসব অপকর্ম ঘটিয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে প্রতিহত করেনি। ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা সম্পর্কিত প্রেসনোটের বক্তব্য মিথ্যা, কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের প্রশ্ন, গোয়েন্দাদের কাছে যদি ব্যাংক লুটের সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে তা হলে এত নিরীহ, নিরস্ত্র আলেমের ওপর সরকারি গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণ, হত্যা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যে নৃশংসতা ঘটানো হলো এ বিষয়ে কোনো তথ্য কেন ছিল না? সরকার কী জবাব দেবে, সেই দিন রাতে কেন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল? কেন পুরো এক মাইল এলাকায় কয়েকটি চিহ্নিত মিডিয়া ছাড়া সংবাদকর্মীদের ঢুকতে দেয়া হয়নি? পুলিশের পোশাক পরে ঘুমন্ত আলেমদের ওপর এই বর্বরোচিত আক্রমণ কারা করেছিল? এদের পরিচয় কী, সরকারকেই জানাতে হবে? হেফাজতে ইসলাম যদি সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে থাকে তা হলে সেই দিন রাতে শাপলা চত্বরে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হলো না কেন?
অভিযানের আগেই কেন এত ট্রাক, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি জমায়েত করা হয়েছিল? হাজারো আলেম ও নবীপ্রেমী তৌহিদি জনতার রক্তে যখন মতিঝিল-শাপলা চত্বর রঞ্জিত হয়েছিল মিডিয়া ও দেশবাসী দেখার আগেই ভোররাতে কোন উদ্দেশ্যে তা পরিষ্কার করা হলো? তড়িঘড়ি করে শহীদদের লাশ কোথায় সরিয়ে নেয়া হলো? সরকারকে জনগণের কাছে এসব প্রশ্নের জবাব অবশ্যই দিতে হবে। হেফাজতে ইসলামের ৮৭ বছর বয়সী আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী স্বয়ং বলেছেন, সরকারের মধ্যরাতের অভিযানে শাপলা চত্বরে অনেক নিরীহ জীবননাশ সত্ত্বেও হেফাজত দমেনি। আমাদের আন্দোলন ঈমান-আকিদা রার আন্দোলন। ১৩ দফা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। ৫ মে মধ্যরাতের আক্রমণের পর আরো অনেক বেশি লোক এখন আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন।
এ ছাড়া সরকার-বিরুদ্ধ মতপ্রকাশের সুযোগ রুদ্ধ করতে সরকার বাহাদুর আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা আর দিগন্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করতে পারলেও ইন্টারনেটের সামাজিক মাধ্যমকে কাবু করতে পারেনি। ৫ মে সমাবেশ শেষে শাপলা চত্বরে অবস্থানরত হেফাজত কর্মীদের ওপর পুলিশের রক্তয়ী অভিযান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় চলছেই। ফেসবুক, টুইটার, বিভিন্ন সাইট ও ব্লগে ওই দিন রাতের অভিযানের স্থিরচিত্র এবং ভিডিও ফুটেজে ছেঁয়ে গেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ভিডিও ফুটেজ আসছে। এসব মাধ্যমে পুলিশের অভিযানকালে হেফাজত কর্মীদের আত্মরার চেষ্টা ও পুলিশের অ্যাকশনের নতুন নতুন দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে মানুষ। এসব ছবি ও ভিডিও ফুটেজ মোবাইল ফোনে ফোনে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, ওপরতলায় একটা মিটমাটের রাস্তা তৈরি করতে পারলেও জনসমাজে দেশব্যাপী সরকারের প্রতি ধিক্কারের সাউন্ড গ্রেনেড ক্রমেই গণবিস্ফোরণের উপকরণ জড়ো করে চলেছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads