বুধবার, ২২ মে, ২০১৩

সংলাপ ও চলমান রাজনীতি

ইতিহাসের নজিরবিহীন দমন-পীড়নের মুখেও প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরপর দুটি হরতাল প্রত্যাহার করে বিএনপি রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। বিএনপির এই সিদ্ধান্তে দেশবাসীও আশ্বস্ত হয়েছিল। অতঃপর জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত হয়ে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনে ঢাকা সফরে আসেন। বিরোধীদলীয় নেতাও জাতিসঙ্ঘের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান। রাজনৈতিক সংলাপের একটা আবহ তৈরি হয়; কিন্তু প্রধান বিরোধী দলের উদারতাকে দুর্বলতা মনে করে সব কিছুর যবনিকাপাত ঘটিয়ে সরকার এখন কঠোর অবস্থানের পথে হাঁটছে এবং ছদ্মবেশী জরুরি অবস্থা জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলাচ্ছে। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল মন্ত্রী আঙুল উঁচিয়ে বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে তারা শেখ হাসিনাকে ছাড়া অন্য কাউকে মেনে নেবেন না। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করে বিদ্যমান কাঠামোয় নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগই তো মতায় থাকল, তাহলে আর সংলাপের প্রয়োজন কী? এই সংলাপ করে লাভই বা কী? মতাসীনদের মনোভাব পরিবর্তন না হলে, সংলাপের নামে সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হবে না। ল্য যদি হয় পপাতহীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, তাহলে সরকারপ্রধান কে হবেন; সেটি বড় করে দেখার অবকাশ নেই। সুতরাং শর্তহীন আলোচনার কথা বলে, মতাসীন দলের পে শর্ত জুড়ে দেয়া প্রকারান্তরে সংলাপের উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা। যুবলীগের এক নেতার কুকীর্তিতে সাভারের ভবনধসে কয়েক হাজার মানুষ হতাহত, শাপলা চত্বরে ১৮ দলীয় জোটের মহাসমাবেশ ও হেফাজতের ঢাকা অবরোধ এবং শাপলা চত্বরে ক্র্যাকডাউনের পর রাজনীতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও জটিল সমীকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই জটিল সমীকরণে বিরোধী জোটের যেমন প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে আবার হারানোরও ভয় আছে। সুতরাং বিরোধী দলকে অত্যন্ত কৌশলের সাথে অগ্রসর হতে হবে।
কোন কাজটি এখন, এই মুহূর্তে করতে হবে আর কোনটির জন্য করতে হবে অপোÑ রাজনীতিতে এটি নির্ধারণ করা অনস্বীকার্য। রাজনীতিতে কোনো ভুল বা হঠকারী সিদ্ধান্তের ফল সুদূরপ্রসারী খারাপ হয়। যুবলীগের দুর্বৃত্ত নেতার কুকীর্তিতে, সাভারের ভবনধসের সাথে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার এমনিতেই ধসে যাচ্ছিল। এই ধস থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার রাজনীতিতে ধূম্রজাল তৈরির অজুহাত খুঁজছিল। ঠিক এমনই এক টালমাটাল মুহূর্তে সরকারকে সেই পথটি তৈরি করে দেয় বিরোধী জোট। এসব ভাবলে প্রতীয়মান হয় দুর্বল, পতনোন্মুখ সরকারের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ও মহাসমাবেশ করে শক্তি প্রদর্শনের আয়োজন ছিল নিষ্প্রয়োজন। এখান থেকে শক্তি সঞ্চয় করে সরকার নতুন করে প্রভাব বিস্তারের একটি মওকা পেয়ে গেছে।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিরীহ মানুষ হত্যার পেছনে বিপজ্জনক রাজনৈতিক খেলা কাজ করছে। আমরা মনে করি, তাতে কোনো অশুভ শক্তির ইন্ধন রয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, ধর্মের ওপর আঘাত, কুরআন-হাদিস ও নবী-রাসূলকে নিয়ে কটূক্তি করা এবং অশালীন ভাষায় গালমন্দ করা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক খেলা। এ খেলা খেলে সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষকে উত্তেজিত করে তোলা হচ্ছে। এই উত্তেজিত মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে, যা বাংলাদেশে আগে কখনো দেখা যায়নি।
গত কয়েক মাসে প্রচুর সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, প্রচুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একই জাতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে এই আত্মঘাতী ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে বোঝা যায়, সুকৌশলে জাতিকে ভয়ানক বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে; যাতে এই জাতি বিপন্ন জাতিতে পরিণত হয়। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ; জনগণকে বিপন্ন করে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না, এর ফলে এক সময় এই রাষ্ট্রও বিপন্ন হবে।
হত্যা সমস্যা সমাধানের পথ নয়। এভাবে কোনো সমস্যার সমাধান হয়েছে পৃথিবীতে এমন নজিরও নেই। সমস্যা কেন সৃষ্টি হয়, সে দিকে নজর দিতে হবে। কোনো সামাজিক শক্তিকে বিপথে ঠেলে দেয়া অপরিণামদর্শী কাজ।
এখন সংবাদ সম্মেলন করে ও প্রেসনোটে বলা হচ্ছে, অপারেশন ফাস আউটে কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি; হেফাজতের কর্মীদের ওপর কোনো নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণও করা হয়নি। অথচ আমরা ৫ তারিখ রাত ২টার পর থেকে ফজর পর্যন্ত, ঘোর সরকার সমর্থক টিভি চ্যানেলে প্রত্য করেছি; রক্তে লাল হয়ে আছে শাপলা চত্বরসহ পুরো মতিঝিল এলাকা। সুতরাং ডিএমপি কমিশনারের সংবাদ সম্মেলন ও সরকারের প্রেসনোটের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা আছে বলে মানুষ মনে করে না।
ঘটনার জন্য অনুশোচনা না করে ডিএমপি কমিশনার সংবাদ সম্মেলনে আরো বলেছেন, হেফাজত কর্মীদের নাকি ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রশ্ন, শাপলা চত্বরে একজন হেফাজত কর্মীর কাছেও কি কোনো অস্ত্র পাওয়া গেছে? যদি না পাওয়া যায়, তাহলে তাদের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগ কি যুক্তিযুক্ত? তারা কি জায়নামাজ ও তসবিহ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে ডাকাতি করবেন? সুতরাং সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন করা বা বিপথের দিকে ঠেলে দেয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ নয়। যে ছাত্রলীগ কর্মীরা অস্ত্র হাতে হেফাজত কর্মীদের ওপর গুলি চালিয়েছে, যাদের ছবি যুগান্তরসহ বিভিন্ন দৈনিকে ৬ মে প্রকাশিত হয়েছে; তাদের কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করেছে? মানুষ মনে করে ওই দিন ছাত্রলীগ কর্মীদের উসকানির কারণেই হেফাজত কর্মীরা উত্তেজিত হয়েছেন। নয়তো তারা ৬ এপ্রিলের মতো শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করে যার যার বাড়ি চলে যেতেন।
বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও তাৎণিক দুটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল বন্ধ করে এবং গভীর রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজত কর্মীদের ওপর সাঁড়াশি অভিযান চালানোয় হতাহতের প্রকৃত ঘটনা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে জানার প্রবল আগ্রহ, হেফাজত কর্মীদের ভাগ্যে ওই দিন আসলে কী ঘটেছিল। এর সহজ-সরল জবাব হলো, শাপলা অভিযানে প্রকৃত হতাহতের ঘটনা হয়তো কোনো দিনই জানা যাবে না। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, এ ঘটনায় প্রকৃতি কাউকে রেহাই দেবে না। সুতরাং হতাহতের সংখ্যা যতই হোক, তারা একটি আদর্শের জন্য জীবন দিয়েছেন। আল্লাহপাক তাদের আত্মদান কবুল করে নিয়েছেন।  রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মতাসীনেরা দমন-পীড়ন ও হত্যার পথ বেছে নেয় এবং অযাচিত শক্তি প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার শেষ চেষ্টা চালায়। বর্তমান মতাসীন দলও তা-ই করছে। তারা রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলার করতে ব্যর্থ হয়ে প্রশাসনিক শক্তির ওপর ষোলআনা নির্ভরশীল হয়ে হয়ে পড়েছে। এটি তাদের জন্য ভবিষ্যতে নিঃসন্দেহে অশনিসঙ্কেত হয়ে আবির্ভূত হবে। আগামীতে ভোটের রাজনীতিতে মতাসীনেরা এর ফল দেখতে পাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
শক্তি প্রদর্শন বা ভায়োলেন্সের পথ বিএনপির জন্য কণ্টকাকীর্ণ। কেননা গোড়া থেকেই বিএনপি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ভায়োলেন্স আওয়ামী রাজনীতি জন্য একেবারে ষোলআনা মানান সই। আওয়ামী লীগ ভায়োলেন্সের পথে হেঁটেই বারবার মতায় এসেছে। আর বিএনপি এসেছে জনগণের ভালোবাসা নিয়ে, তাদের ভোটের মাধ্যমে।
চলমান রাজনীতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আছে। এই দাবির সাথে সবাই একমত না-ও হতে পারে, কিন্তু নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি একটি নিরেট গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন দাবি। এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষ এ দাবির সাথে একমত। জনগণের এই দাবি মেনেই সরকারকে নির্বাচনে যেতে হবে। তা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। আমরা চাই অর্থবহ সংলাপে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নেয়ার মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের উত্তরণ ঘটুক। দেশে একটি পপাতহীন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম হোক। বন্ধ হোক হিংসাবিদ্বেষ, হানাহানি ও রাজনীতি নিয়ে বিপজ্জনক খেলা। অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে; আর যাতে কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads