সোমবার, ১৩ মে, ২০১৩

রাষ্ট্রের অধিকার বনাম নাগরিকের অধিকার


এ বিষয় নিয়ে আমি এর আগেও অনেকবার লিখেছি। আজ আবার লিখছি। চলমান সরকারের আমলে বিগত কয়েক মাসে রাজনৈতিক কারণে কয়েক শ’ নাগরিক নিহত হয়েছেন। বিশেষ করে ৫ মে গভীর রাতে বা ৬ মে রাত আড়াইটায় মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে তাতে একজন নাগরিক হিসেবে আমার মনটা একেবারেই ভেঙে গেছে। ২৫ মার্চ রাতে আমি অবজারভার হাউজে ছিলাম। রাত ১১টার দিকে কন্টিনেন্টাল থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে আবদুল গনি রোড হয়ে অবজারভারে  ফিরে আসি। রাত ১২টার দিকে সম্ভবত পাক সেনাবাহিনী অপারেশনে নামে। মধ্যরাত হলেই পাক সেনারা অপারেশনে নামবে, এটা আগে থেকেই তাদের পরিকল্পনা ছিল। ফলে ২৪ মার্চের পরে ২৫ মার্চ সারা দিন জেনারেল ইয়াহিয়া বা তার সহকর্মীরা কেউ বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ করেননি। ভুট্টো তখন কন্টিনেন্টালে অবস্থান করছিলেন। তিনিও বঙ্গবন্ধুর সাথে কোনো যোগাযোগ করেননি। আমার দায়িত্ব ছিল ভুট্টোর সাথে কথা বলা। একটি শব্দ হলেও চলবে। কথা বলেছিলাম, কিন্তু সে কথা আর প্রকাশ করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু সারা দিন নিজ বাসভবনেই অপো করছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া বা তার লোকের কাছ থেকে ফোন পাওয়ার জন্য। সেই ফোন আর আসেনি। ২৫ মার্চ রাতে অবজারভারে  আটকে পড়ার পর বের হতে পেরেছি ২৭ মার্চ সকালে যখন দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল। বাসায় ফেরার পথে এখানে-সেখানে বিপ্তি লাশ ছিল। সবচেয়ে বেদনাদায়ক একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে। তা হলো ফকিরাপুল পানির ট্যাঙ্কের মাথায় একটি স্বাধীন বাংলার পতাকা ছিল। সেটা নামানোর জন্য পাকিস্তানি সৈনিকেরা এক কিশোরকে ওপরে পাঠিয়েছিল। কিশোরটি পতাকা খুলে হাতে নেয়ার পর সৈনিকেরা তাকে গুলি করে চলে যায়। সে রাতে রাজধানী ঢাকার কোথাও আলো দেখতে পাইনি। আমরা ছাদে উঠে দেখছিলাম যা দেখা যায়। খুব হুঁশিয়ারে। সৈনিকেরা টের পেলেই গুলি করবে। তাদের মনে সব সময় প্রতিরোধের ভয় ছিল। এদিক ওদিক পাতা নড়লেও ওরা গুলি করত। ছাদে দাঁড়িয়েই আমরা দেখেছি, ঢাকা শহরের কোথায় সেনাবাহিনী আগুন দিয়েছে। বস্তিগুলো ছিল তাদের প্রধান টার্গেট। বস্তিগুলো তারা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তাই চার দিকে গভীর অন্ধকারে শুধু আগুন দেখছিলাম। রাজারবাগ আর পিলখানার দিক থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে অনেকেই বাজার-সদাই করার জন্য বেরিয়েছিলেন। সবাই পেটের তাগিদেই বের হয়েছিলেন। দু-একটা রিকশাও দেখা গেছে। সময় ছিল খুবই কম। মাত্র দুই ঘণ্টা। তাই সবার মাঝেই ছিল প্রচণ্ড তাড়াহুড়া। যাক ২৫ মার্চ রাতের কথা এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। ওই রাত বা পরের রাত বা দিনের কথা বলতে গেলে পুরো একটা বই হয়ে যাবে। কিন্তু সে সময় এখন হাতে নেই।

এখন ৫ মে গভীর রাত বা ৬ মে অতি ভোরের কথা বলতেই কলম হাতে নিয়েছি। সে সময়টা ছিল ১৯৭১ সাল। এ সময়টা হচ্ছে ২০১৩ সাল। সে সময় মানে ’৭১ সালের ২৫ মার্চ মতায় ছিল বাঙালি মুসলমান বৈরী পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী। ২০১৩ সালের ৫ মে মতায় আছে খাঁটি বাঙালি সরকার। তাও আবার নির্বাচিত। তার ওপরও আছে বঙ্গবন্ধুর প্রাণের দল আওয়ামী লীগ ও তার কন্যার সরকার। মুসলমান কথাটা উল্লেখ করলাম না এ কারণে যে, এই সরকার নিজেদের সেকুলার ধর্মহীন ভাবতে ভালোবাসে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজনীতি দুটো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসে গেছে। মতায় আরোহণের জন্য নির্বাচনপদ্ধতি। বিরোধী দল চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। মতাসীন দল চায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। অপর বিষয়টা হঠাৎই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। হওয়ার কথা ছিল না। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে কিছু তরুণ সমাবেশ বা জমায়েত করতে শুরু করল। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি বা দেখেনি তাদেরই আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিল শাহবাগের মিলনমেলা। পরে নামকরণ হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। সরকার দেখল, এই মঞ্চকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। শুরু হয়ে গেল সরকারি তোড়জোড়। সমর্থন। টাকা-পয়সার জোগান। পানি ও খাওয়া-দাওয়া, নাচগান সারা রাত সারা দিন। এমন রমরমা জাগরণ নিয়ে ছোটগল্প লিখে আওয়ামী ঘরানার প্রখ্যাত আমলা ও লেখক হাসনাত আবদুল হাই পড়লেন মহাবিপদে। গল্পের প্রকাশক সাবেক কমিউনিস্ট নেতা মতিও বিপদে পড়লেন। উভয়েই মা চেয়ে জীবন রা করলেন। হঠাৎ শোনা গেল গণজাগরণ মেলা বা মঞ্চের কিছু নেতা ও ব্লগার নাস্তিক এবং তারা কয়েক বছর ধরে আল্লাহ, রাসূল সা: ও কুরআনের বিরুদ্ধে অশালীনভাবে গালাগাল করে যাচ্ছে। তাদের নাস্তিকতা নিয়ে লিখতে গিয়ে এখন দৈনিক আমার দেশ বন্ধ এবং এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বন্দী অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন। তার মায়ের বিরুদ্ধেও সরকার মামলা দিয়েছে। গণজাগরণের নাস্তিক নেতাদের শাস্তির দাবিসহ আরো কিছু দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে ধার্মিক মানুষদের অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। এর নেতা বা আমির হলেন আল্লামা আহমদ শফী সাহেব। তিনি দেওবন্দি সিলসিলার মানুষ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হজরত মাওলানা আল্লামা মাদানী সাহেব ছিলেন শফী সাহেবের ওস্তাদ। বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো হলো দেওবন্দ সিলসিলার। এসব মাদরাসা সরকারি সাহায্য গ্রহণ করে না। জনগণের সাহায্যে এসব মাদরাসা চলে। বয়সের ভারে শফী সাহেব এখন একেবারেই কান্ত। এ বয়সে এত বড় ঝুঁকি নেয়ার কথা নয়। শুধুই প্রাণের দাবিতে, দ্বীনের ভালোবাসায় তিনি নাস্তিকবিরোধী আন্দোলনে নেমেছেন। তিনি বারবার ঘোষণা দিয়েছেন, হেফাজতের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। কাউকে মতায় বসানোর জন্য বা মতা থেকে নামানোর জন্য তারা আন্দোলন করছেন না। ১৩ দফা সংবলিত কিছু ধর্মীয় দাবি নিয়ে তিনি আন্দোলন করছেন। এ জন্য ইতোমধ্যেই তাকে নানা ধরনের গালাগাল শুনতে হয়েছে।
বিগত কয়েক মাসে হেফাজত সারা দেশে শান্তিপূর্ণভাবে ৪০টির বেশি সমাবেশ করেছে। কোথাও কোনো অঘটন ঘটেনি। ৫ মে ঢাকায় সমাবেশ হবে, সে ঘোষণা তারা ৬ এপ্রিলের মহাসমাবেশে দিয়েছেন। সরকার কোনো প্রকার বাধা দেবে না বলেও ৬ এপ্রিলের সমাবেশ পণ্ড করার জন্য নানা ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করেছিল। ঘোষণা মোতাবেক হেফাজতের নেতাকর্মীরা ৫ মে ভোর থেকেই রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান শুরু করেন এবং খুবই সুশৃঙ্খলভাবে বিকেলে শাপলা চত্বরের সমাবেশের দিকে মিছিল করে রওনা দেন। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। হঠাৎ দেখা গেল পুরানা পল্টনের রাস্তায় পুলিশ ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। কেন পুলিশ হঠাৎ করে এ কাজ করেছে তা এখনো জানা যায়নি। ব্যস, শুরু হয়ে গেল ধস্তাধস্তি, ধাক্কাধাক্কি, মারামারি, প্রচণ্ড গোলাগুলি, টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। পুলিশই এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। রাত অবধি আর অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। গুলিস্তান দিয়ে হেফাজতের কর্মীরা সমাবেশের দিকে যেতে চাইলে আওয়ামী লীগ ও একই ঘরানার নিবেদিত কর্মীরা হেফাজতের মিছিলকে বাধা দেয়। দ্বিতীয় স্থানে শুরু হলো মারামারি। হেফাজত কর্মী বনাম পুলিশ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ। পরিস্থিতির অবনতি হতে লাগল। এ সময় সরকার উদ্যোগ নিলে ঘটনার ওখানেই সমাপ্তি হতো। না সরকার উদ্যোগ নেয়নি। হয়তো কোনো কারণে অপো করছিলেন। এক দিকে লাখ লাখ ধর্মীয় মানুষের সমাবেশ চলছে, অন্য দিকে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও অজানা লোকদের দাঙ্গা চলতে থাকল। কারা আগুন লাগাচ্ছে, কারা দেকানপাট লুট করছে; কিছুই বোঝা গেল না। আমরা দেখলাম, এখানে ওখানে আগুন জ্বলছে আর সীমাহীন গুলির আওয়াজ চলছে। শব্দ গ্রেনেডের হামলা চলছে। রাত আস্তে আস্তে ভারী হতে লাগল। সমাবেশও চলছে, পুলিশের গোলাগুলিও চলছে। আল্লামা শফী সমাবেশে আসছেন বলে ঘোষণা দিলেও তিনি শেষ পর্যন্ত আসেননি। আর মঞ্চে ঘোষিত হলো আমিরের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সমাবেশ চলতে থাকবে। তখন মনে হয়েছে, অদৃশ্য কোনো শক্তি সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সৈয়দ আশরাফ সাহেব ঘোষণা দিলেন ৬টার মধ্যে সমাবেশ বন্ধ করে চলে যেতে হবে। তখন ৬টা পেরিয়ে গেছে। তখনই তিনি ঘোষণা দিলেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। মানে ২৫ মার্চ বা ওই ধরনের কিছু ঘটবে না। অন্যরকম কিছু ঘটবে। আবার বিএনপি নেত্রী ঘোষণা দিলেন তার দলের কর্মীরা যেন হেফাজতের কর্মীদের সহযোগিতা করে। ২৫ মার্চ রাতে রাস্তায় কোনো সমাবেশ ছিল না। শহরের অবস্থা ছিল থমথমে। যদিও রাস্তায় নানা ধরনের ব্যারিকেড দেয়া চলছিল। ৫ মে গভীর রাতে শাপলা চত্বরে ছিল লাখ লাখ মানুষ। ২৫ মার্চ পাক বাহিনীকে সারা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে অপারেশন চালাতে হয়েছে। ৫ মে যৌথ বাহিনীকে শুধু এক জায়গায় এক ল্েয অপারেশন চালাতে হয়েছে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশে যারা ছিলেন তারা সবাই ছিলেন ধর্মজ্ঞানী ও ধর্মছাত্র এবং গ্রামের মানুষ। জীবনে ল্য একটাই, তা হলো ধর্মকে রা করা, ধর্মীয় জীবনযাপন করা। শাপলা চত্বরে তারা যুদ্ধ করতে আসেনি। এসেছিল মুরব্বিদের ডাকে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে। সেই ধর্মজ্ঞানী ও ধর্মছাত্রদের ওপর অপারেশন চালাল ১০ হাজার সদস্যের এক যৌথ বাহিনী। যারা রাস্তায় বসেছিল, কেউ বা ঘুমাচ্ছিল। আগেই অন্ধকার জারি করা হয়েছিল, পানি সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছিল। চার দিক ঘেরাও করা হয়েছিল।
অবাক হয়ে দেখলাম, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার কত নিষ্ঠুর হতে পারে। রাষ্ট্রের দমনশক্তি কী ও কত প্রকার তাও আমাদের দেখতে হলো। নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্রের দমনশক্তিকে কত নিষ্ঠুর করে তুলতে পারে। আজ আমার মনে প্রশ্ন জেগেছেÑ রাষ্ট্র বড়, না মানুষ বড়। মানুষের জন্য রাষ্ট্র, না রাষ্ট্রের জন্য মানুষ। আমার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি নিজ নাগরিকদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আমি কোন দিকে থাকব, অত্যাচারী রাষ্ট্রের প;ে না মানুষ হিসেবে নিজের মানবিক অস্তিত্বকে রা করব। আমি জানি, এমন নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনার প-বিপ আছে। হিটলারেরা কখনোই নিজের কর্ম ও অবস্থানের কথা বুঝতে পারে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads