বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৩

আগুন! আগুন!! আগুন!!!


১.
ইসলাম গ্রহণের আগে ইরানের পারসিকরা আগুনকে দেবতা-জ্ঞানে উপাসনা করত। ইসলাম-পূর্ব কালের অগ্নি-উপাসক ইরানীদের অধুনা-প্রায় বিলুপ্ত ধর্মের নাম ছিল জরাথুস্ট্রীয় ধর্ম। তাদের ধর্ম গ্রন্থের নাম ছিল জেন্দা-বেস্তা। সমগ্র ইরান বা পারস্য এবং পারসিক জাতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে অগ্নি-উপাসক সম্প্রদায়টি পালিয়ে ভারতে চলে আসে। বোম্বাই নগরীতে তাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ এখনও রয়েছে। নেহেরু-কন্যা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ ছিলেন এমনই একজন অগ্নি-উপাসক পারসিক।
২.
হাজার বছর আগে আর্য জাতি ভারত আক্রমণ করে এদেশ দখল করে। এই আর্য জাতির সঙ্গে ইরানের প্রাচীন অগ্নি-উপাসক এবং ইউরোপের কিছু কিছু জাতির সম্পর্ক রয়েছে। আর্যরা অগ্নি ও লৌহের ব্যবহার জানত এবং আগুন প্রজ্জ্বলিত করে যাগ-যজ্ঞ-পূজা করত। তাদের ধর্ম গ্রন্থের নাম বেদ। যাতে অগ্নি বা আগুনের মহিমা বর্ণিত হয়েছে। এক অর্থে আর্যরাও অগ্নি-উপাসক। তারা স্থানীয় ভারতীয়দের বেদ পড়তে দেয়নি। তবে তাদের অধীনস্থ রাখে বিভিন্ন আচার-আচরণ ও ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে। আর্যঘেঁষা উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ শ্রেণীর বাইরে ভারতের অধিকাংশই নিম্নস্তরের হিন্দু। চতুর্বর্ণ প্রথায় সমাজ ও ধর্মের নিম্নতর স্তরে সাধারণদের অবস্থান। তারা ব্রাহ্মণ বর্ণিত অনুশাসন কোনও জিজ্ঞাসা ও হেতু ছাড়াই প্রতিপালন করে থাকে। এই হিন্দু ধর্ম নানাভাবে অগ্নি বা আগুনের পূজা করে। অগ্নিকে ঈশ্বর বা দেবতা জ্ঞান করে। তাদের ধর্ম মতে, অরণ্যকে যে আগুন দহন করে তার নাম দাবানল। গৃহস্থের বাড়িতে যজ্ঞ অনুষ্ঠানে যে আগুন উপস্থিত তার নাম হোমাগ্নি। অগ্নিসাক্ষী করে বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়। সে অগ্নির নাম যোজক। বিবাহের পরে বধূকে নিয়ে স্বগৃহাভিমুখে গমনোদ্যত হয়ে, রথারূঢ় অবস্থায় বৃষচর্মে উপবেশন করার পর পর যে আগুন স্পর্শ করা হয়, তার নাম ধৃতি। শ্বশুরালয়ে তিনদিন ব্রহ্মচর্য পালন করার পর চতুর্থ দিবসে পুনরায় যজ্ঞ করে যে আগুনে আহুতি হয়, তার নাম শিখি। যোজক, ধৃতি ও শিখি অগ্নিসমূহের কোনও কর্তব্য-অপরাধ হলে তার প্রায়শ্চিত্তের সময় যে আগুন প্রজ্জ্বলিত করে পূজা করা হয়, তার নাম বিধু। এইসব যজ্ঞকর্ম সম্পূর্ণ করার সময় প্রজ্বলিত অগ্নিনাম মৃড়। যে আগুনে হিন্দু জীবনাবসান ঘটে, তার নাম চিতা।
৩.
বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এনজিও ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সূচনায় অগ্নি প্রজ্জ্বলন করা হচ্ছে। সাধারণত সূচনায় দোয়া, প্রার্থনা ও পূজা করার বিধান। সূচনার এই অগ্নিকে অগ্নিপ্রেমী উদ্যোক্তারা মধুর ভাষায় ডাকেন মঙ্গলপ্রদীপ নামে। বিভীষিকাময় আগুনের মধ্যে তারা কি মঙ্গল পেলেন, সেটা অজানা এবং সেটাকে জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়ে কি মঙ্গল হাসিল করতে চান, সেটাও দুর্বোধ্য। অগ্নি-উপাসক প্রাচীন পারসিক বা বেদের অনুসারী আর্য হিন্দুদের ধর্ম মতে দাবানল, হোমাগ্নি, যোজক, ধৃতি, শিখি, বিধু, মৃড়, চিতা  ইত্যাদি নামধারী আগুন-দেবতার পূজার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রগতিশীল/সেক্যুলার কর্তৃক প্রজ্জ্বলিত মঙ্গলপ্রদীপ-এর মিল-অমিল-সম্পর্কের বিষয়টিও আমাদের অজানা। সাধারণত কোন লজিক বা রিজন ছাড়া কোনও কাজ করা হয় না। অনুষ্ঠানের শুরুতেই অগ্নি-স্তব (বস্তুত পূজা) করার ক্ষেত্রে কি লজিক বা যুক্তি, রিজন বা কার্যকারণ রয়েছে, সেটা প্রকাশিত ও ব্যাখ্যাত হওয়া দরকার। বিশেষ করে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে অন্য ধর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আচার-আচরণের ক্ষেত্রে বিশ্বাসী মানুষদের সতর্কতা জরুরি। দেখা-দেখি বা অভ্যাস বসে এটা-সেটা করা যায়। কিন্তু কিছু না জেনে-বুঝে যার-তার কাছে প্রার্থনা করা যায় না। সৃষ্ট বস্তুর কাছে মঙ্গল কামনা করা, নত মস্তক করা, কর জোড়ে মিনতি প্রকাশ করা অর্থহীন কাজ। গুরুত্বপূর্ণ নানা অনুষ্ঠানের শুরুতেই এহেন অর্থহীন কাজের ব্যবস্থা করার হেতু কি? ক্রমশ এহেন অনুষ্ঠানাদি সর্বস্তরে প্রয়োগ ও সম্প্রচারের ব্যবস্থা করার মানে কি? এহেন অনুষ্ঠানসমূহ সমাজের সর্বস্তরে দ্রুত প্রচার-প্রচার করার মতলব, মকসুদ ও কারণই বা কি?
৪.
অগ্নির আরেকটি ব্যাপক ব্যবহার দেখা যাচ্ছে মোমবাতির শিখা প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে। শোক, প্রতিবাদ ইত্যাদি প্রকাশের সময় নারী-পুরুষের সম্মিলিত মিছিল কর জোড়ে মোমবাতি ধারণ করে সেটার শিখাকে মস্তকের ওপরে উঁচিয়ে মৌনব্রতে পদব্রাজকরূপে প্রদক্ষিণ করছে এবং পরিসমাপ্তিতে সকল মোমবাতির সমন্বিত শিখাকে একত্রে স্থাপন করে বিশাল অগ্নিমঞ্চ নির্মাণ করে নিজ নিজ আকুতি জানাচ্ছে। অগ্নিসাক্ষী করে বা অগ্নিমঞ্চ বানিয়ে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা তৌহিদের পরিপন্থী। এসব অগ্নি-আচারের সঙ্গে অগ্নিপূজক প্রাচীন পারসিক বা হিন্দু-আর্য সম্প্রদায়ের কোনও মিল থাকলেও মুসলমানদের দূরতম সম্পর্ক নেই। এসব আচরণ কে বা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছে? এবং কারা কি উদ্দেশ্যে এমন সব তৎপরতার প্রকাশ-বিকাশ ঘটাচ্ছে, সেটাও বোধগম্য হচ্ছে না।
৫.
অগ্নিপ্রদীপ, অগ্নিসাক্ষী, অগ্নিমঞ্চ ইত্যাদির পথ ধরে অগ্নিময়তা সমাজ ও মানুষের মধ্যে তীব্র গতিতে বিস্তৃতি লাভ করছে। ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের কণ্ঠস্বর এখন অগ্নিকণ্ঠ। বাক্য অগ্নিময়। আচরণ অগ্নিমুখী। প্রতিপক্ষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়ার অগ্নিতৎপরতা প্রকাশ্য। সমাজ ও সংস্কৃতির অগ্নিঘেঁষা নীতি রাজনীতি ও অর্থনীতিকেও আগুনের চিতায় ফেলে দিয়েছে। কিছু হলেই জ্বলছে আগুন। রাজনীতির মাঠ-ময়দান থেমে থেমে আগুনে আক্রান্ত। পোশাক শ্রমিকরা তাদের অধিকার পেতে গিয়ে অগ্নিকু-ে নিমজ্জিত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের জন্য অগ্নি-সদৃশ হয়ে ওঠছে। কথিত মঙ্গলপ্রদীপের আগুন সর্বত্র মঙ্গলের বদলে অমঙ্গলের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে পুরো দেশটাই আস্তে আস্তে রাবণের চিতায় পরিণত হচ্ছে। এমনকি সেই আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে পবিত্র কোরআন শরীফ। বুলেটের অগ্নিবৃষ্টিতে অঙ্গার করা হয়েছে খুদ্দামুল কোরআন তথা আলেম-ওলামাদের। আর নিজেদের অপরাধের দায় চাপানো হচ্ছে কোরআনপ্রেমীদের ওপর। যারা ইসলামী আন্দোলন এবং কোরআন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলন করছে, তারাই কি-না কোরআন পুড়িয়েছে? এমন অকল্পনীয় অভিযোগও শুনতে হচ্ছে।  
৬.
অগ্নি-উপাসকরা আগুনের পূজা করলেও আগুন নিয়ে খেলতে বলেনি। কিন্তু ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজের সর্বত্র কারা আগুন নিয়ে খেলছে? আগুনের ধর্ম অনুযায়ী সে সব কিছুকেই পুড়িয়ে দেবে। তাকে পূজা করা হলেও আগুন স্বধর্ম থেকে বিচ্যুৎ হবে না। আগুন নিয়ে খেলা করলেও ফলাফল একই হবে। আগুন নিজস্ব দাহ্য ধর্মানুযায়ী পুড়িয়ে দেবে সব কিছু। বাংলাদেশে এখন আগুনের পূজা আর আগুন নিয়ে খেলার দ্বিমুখী অগ্নিকা- চলছে। সর্বভূক অগ্নির লেলিহান ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ, ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি। রবীন্দ্রনাথের গানে ও কবিতায় অনেক ধরনের আগুনের কথা আছে। সুরের আগুন, রঙের আগুন সবখানে ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যাশা আছে। কিন্তু চারপাশে এখন এ কোন হিংসার হন্তারক আগুন দেখা যাচ্ছে? যার থেকে কারও নিস্তার নেই।
৭.
ইতিহাসের নানা স্তরে দেখা গেছে ধর্মের আগুন জ্বলে ওঠে। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অন্ধকারে ধর্মের তেমন আলো জ্বলে ওঠেছিল কখনো অধর্মের আগুন জ্বলে ওঠে। প্রায়ই প্রজ্জ্বলিত হয় হিংসার আগুন। রাষ্ট্রবিপ্লবের আগুনও রুশ, ফরাসি, ইরানের বিপ্লবের কালে জ্বলে ওঠেছিল। ইতিহাসের পাতায় আবার কাউকে ধ্বংসের জন্য প্রতিক্রিয়াশীল-জনবিরোধী অপশক্তি কর্তৃক গৃহদাহ ও আত্মধ্বংসের আগুন জ্বেলে দিতে দেখা গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন কোন আগুনের মুখোমুখি?
যখন কোন সম্ভাবনা ও আশাবাদ জেগে ওঠে তখন সেটাকে মাটি চাপা দিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করতে চায় প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিপক্ষ। আজ যখন আরব জগতে ইন্তেফাদার বৈপ্লবিক আলো জ্বলে ওঠেছে; বইছে জেসমিন বাতাস ও আরব বসন্তের দ্যোতনা, তখন সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি জ্বেলে দিয়েছে হিংসা, বিভেদ ও পুড়িয়ে মারার আগুন। সিনাই থেকে সেনেগাল, বেনগাজী থেকে বেনিন পর্যন্ত আরব বিশ্বের সর্বত্র ইসলামী বিপ্লবের দাবানলকে পুড়িয়ে দিতে সিরিয়া, তিউনিসিয়া, লেবানন, লিবিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে আত্মঘাতী-ভ্রাতৃঘাতী আগুন। একদিকে বিপ্লব আর অন্যদিকে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিবিপ্লবের দ্বৈত আগুনে জ্বলছে আরব দুনিয়া।
বাংলাদেশ জ্বলছে কোন আগুনে? জনতার সম্মতিতে গণতন্ত্রের ধারায় বিকশিত ইসলামী বিপ্লবের উত্থানকে থামাতে ষড়যন্ত্র ও হিংসার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা চলছে ইসলামী আদর্শ, নেতৃত্ব ও সংগঠনকে। ব্যাপক ইসলামিক ধর্ম ও সংস্কৃতির হেফাজতের অরাজনৈতিক আন্দোলনকেও অগ্নিদাপটে পুড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। একদিকে বাইরের লেলিহান আগুন আর অন্যদিকে মঙ্গলপ্রদীপ ও মোমের আগুন দিয়ে ভেতর থেকে পুড়ানো হচ্ছে ঈমান, আকিদা, তৌহিদ। এ এক প্রচ- সঙ্কুল পরিস্থিতি। ভেতরের আর বাইরের আগুনের দ্বারা নির্মিত সামগ্রিক চিতা। কিন্তু চিতায় নাস্তিক ব্যক্তির মৃত্যু হলেও জাতির মৃত্যু হয় না। ইসলাম ও মুসলমানদেরকে তো আগুন কিছুই করতে পারে না। ইসলাম মুসলমানদেরকে আগুনকে পূজা করতে বলে না; আগুন নিয়ে খেলতেও নিদের্শ দেয় না। অতএব আগুনে ইসলাম ও মুসলমানদের কোনও ভয় নেই। ভয় তাদের, যারা পূজায় ও খেলায় তাদের আগুন দেবতাকে নিয়ে আছে, তাদের। সাপের হাতেই যেমন সাপুড়ের মুত্যু হয়; আগুনেই অগ্নিপন্থীদের বিনাশ হবে। চারিদিকে আগুন, আগুন আর আগুন জ্বালিয়ে অগ্নিধারীরা নিজেদের দগ্ধতার কালকে ঠেকাতে পারবে না। আগুনের দাহ্যকরণ ক্ষমতা ও স্বধর্মের কাছেই তাদেরকে আত্মসমর্পন করতে হবে। অতঃপর অগ্নিবাদীদের অগ্নিদগ্ধ মহাচিতার ছাই-ভস্ম-জঞ্জাল সরিয়ে আসবে সত্য, প্রবাহিত হবে কল্যাণ, প্রতিষ্ঠিত হবে ইসলাম।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads