বুধবার, ২৯ মে, ২০১৩

কুতর্ক ও নিষ্ঠুর আচরণের দিনলিপি


দেশের রাজনীতি যদি দেশের পক্ষে না থাকে, তবে সেই রাজনীতির কোনো প্রয়োজন আছে কি জনগণের? তারপরও মঞ্চ কাঁপিয়ে আমাদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও রাজনীতিবিদরা উচ্চকণ্ঠে বলে যাচ্ছেন তাদের রাজনীতি নাকি দেশ ও জনগণের জন্য! এমন অদ্ভুত নাটক বোধহয় পৃথিবীর আর কোনো রাজনৈতিক মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় না। ‘দেশের জনগণ’ তো অনেক বড় কথা! যারা সমগোত্রের লোকদের সাথেই ন্যূনতম মানবিক আচরণে অক্ষম, তারা জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সক্ষম হবে কেমন করে?
আমরা জানি রাজনীতিতে পালাবদল আছে। একবার সরকার গঠন করলেই কোনো দল চিরদিন সরকারে থাকতে পারে না। নির্বাচনে পরাজিত হলে দোর্দ- প্রতাপশালী সরকারকেও গদি ছেড়ে বিরোধী দলের আসনে বসতে হয়। এমন চিত্র সামনে থাকলে তো কোনো সরকার বিরোধী দলের সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করতে পারে না। কিন্তু বর্তমান সরকার যেন ইতিহাসের পাঠ ভুলে গেছে। বিরোধী দলের সাথে তারা এমন নির্মম-নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করে যাচ্ছে, যাতে মনে হয় তারা যেন আর কোনকালে বিরোধী দল হবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কেউ ক্ষমতায় চিরকাল থাকতে পারে না এবং ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়াও তাকে ভোগ করতে হয়।
আমাদের রাজনীতি এখন কোন পর্যায়ে অবস্থান করছে তার একটি চিত্র পাওয়া যায় দৈনিক ইত্তেফাকের ২৮ মে তারিখের একটি প্রতিবেদনে। ‘জামিন নেই বিরোধী নেতাদের, পেলেও মুক্তি মিলছে না’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বর্তমানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মামলায় নি¤œ আদালত থেকে জামিন পাচ্ছেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। এমনকি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও নি¤œ আদালতে জামিনের ধারাবাহিকতা থাকছে না। অসুস্থ, বয়ষ্ক বা সংসদ সদস্যের জামিন পাওয়ার বিশেষ অধিকার থাকলেও নি¤œ আদালতে সে অধিকারও লঙ্ঘিত হচ্ছে। এদিকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও বিরোধী দলের নেতাদের মুক্তি মিলছে না। মুক্তি পাওয়া মাত্রই জেল গেটে তাদের অন্য মামলায় শ্যোন-এ্যারেস্ট দেখানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যাচ্ছে সাদা পোশাকের পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, কি মামলায় কোথায় নেয়া হচ্ছে তাও জানা যায় পরে। মামলার এজাহারে নাম না থাকলেও শুধুমাত্র পুলিশের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নি¤œ আদালত ঢালাওভাবে আসামীকে কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন। গত এক মাসে কেন্দ্রীয় নেতাসহ দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে কারা ফটকে আটক করে অন্য মামলায় পুনরায় জেলে পুরেছে পুলিশ। ফলে উচ্চ আদালতের নেয়া জামিনও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য যে, দেশের বিভিন্ন থানায় প্রায় দশ হাজার মামলায় বিরোধী দলের কয়েক লাখ নেতা-কর্মী হয় কারাগারে, না হয় ফেরার জীবন কাটাচ্ছেন। ইত্তেফাকের এই প্রতিবেদনে যে চিত্রটি উঠে আসলো, তা যে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য কোনো সুখকর বিষয় নয় তা আমরা জানি, কিন্তু যারা এখন ক্ষমতায় আছেন বিষয়টি কি তাদের জন্যও সুখকর? পরিণামের কথা চিন্তা করলে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এখন দমন-পীড়ন, জুলুম-নির্যাতনের যেসব কলাকৌশল চলছে তার অনুমোদন সরকার দিতে পারতো না। কারণ ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া বলে একটা কথা আছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক (!) সরকারের আমলে বিরোধী দলের প্রতি যেসব মন্দ আচরণের উদাহরণ সৃষ্টি করা হচ্ছে, ক্ষমতায় গেলে তারাও যদি ঐসব মন্দ আচরণ পরবর্তী বিরোধী দলের প্রতি ফিরিয়ে দেয়, তাহলে তাদের বলার কিছু থাকবে কি? বিশেষ করে এখন সরকারি দলের মধ্যে যারা অসুস্থ ও বয়ষ্ক আছেন তারা তখন কি করবেন? দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এখন আমাদের যেসব কথা লিখতে হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের জন্য শোভা পায় না। কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থে এবং গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তিক্ত কথাও তুলে ধরতে হয়। শুধু ব্যক্তি মানুষের জন্য নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও রুচিবোধ, মূল্যবোধ ও উচ্চতর মানবিক চেতনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসবের অভাব ঘটলে রাজনীতির সাথে সাথে রাজনীতিবিদরাও মর্যাদা ও গুরুত্ব উভয়টাই হারান। এখন অপরাধী ও সন্ত্রাসীরাও তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পায়। এমন পরিস্থিতিতে অপরাধ জগতকে নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনের’ একটি প্রতিবেদনে তেমন একটা চিত্রই যেন ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সারাদেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা, শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই কাজেও অবৈধ অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে যে ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র শোভা পাচ্ছে, এলাকার উঠতি কিশোর অপরাধীর কাছেও মিলছে সেই অস্ত্র। বৈধ অস্ত্রও এখন অবৈধ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে পুলিশের কাছ থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্রগুলো এখন চলে গেছে অপরাধীদের হাতে। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় অবৈধ অস্ত্রের চাহিদাও বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক ক্যাডার ও শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীরা নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান ধরে রাখতে অস্ত্রের মজুত ধরে রাখছে। অস্ত্র ব্যবসায়ীরাও ভীষণ তৎপর। নজরদারি না থাকায় অন্তত ১৫০টি সিন্ডিকেট দেশের ৬০টি পয়েন্ট দিয়ে অস্ত্রের অবৈধ চালান আনছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারাদেশে। এমনকি দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র তৈরির কারখানাও গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের ২৪ মে সংখ্যায় অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি ও এর ব্যবহারের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতো কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্র হতে পারে না। গণতান্ত্রিক সমাজে তো অস্ত্রের প্রতিযোগিতা হয় না, সেখানে প্রতিযোগিতা হয় জ্ঞান, মেধা, সৃজনশীলতা, সহিষ্ণুতা ও কর্মের। গণতান্ত্রিক সমাজে গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে সৃজনশীল কর্মতৎপরতার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে হয়। এমন তৎপরতায় তো অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসীদের কোনো প্রয়োজন হয় না। তাই কোনো সমাজে যদি এসব আবর্জনার কদর বাড়তে থাকে তাহলে সেই সমাজকে কি গণতান্ত্রিক সমাজ বলে অভিহিত করা যায়? জানি না, আমাদের সরকার এবং রাজনীতিবিদরা এ প্রশ্নের কী জবাব দেবেন? আসলে আমাদের সমাজের গণতন্ত্রের বহুল উচ্চারণ আছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক আচরণ নেই। বাকসর্বস্ব এমন রাজনীতি যেমন দেশের জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারে না, তেমনি রক্ষা করতে পারে না জাতীয় মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব। রাজনীতিবিদরা যদি অষ্টপ্রহর ক্ষমতার লোভ ও কুতর্কে ব্যস্ত থাকে, তাহলে তারা দেশের স্বার্থরক্ষা করবেন কেমন করে? কোনো দেশের রাজনীতি এমন মন্দ অবস্থায় থাকলে বাইরের শক্তি সে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কোনো গরজ অনুভব করে না। এমন একটি চিত্রই যেন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সংগ্রামের ২৪ মে সংখ্যায়। ‘টার্মিনাল পোর্ট নারায়ণগঞ্জে, নির্মাণের টেন্ডার দিয়েছে ভারত সরকার দিল্লীতে শিরোনামের রিপোর্টে বলা হয়, সরকারের অগোচরে নারায়ণগঞ্জে অভ্যন্তরীণ নৌ-কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত সরকার। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জ শহরে খানপুরের কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ৪৬ একর জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে এই টার্মিনাল। এরই মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণে কারিগরি ও বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য দরপত্রও আহ্বান করেছে। দরপত্র জমা দেয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৭ জুন বিকেল ৫টা পর্যন্ত। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, সমুদ্র, পরিবহন অধিদফতর (ডিজিশিপিং) ও বিনিয়োগ বোর্ড কারো অনুমোদন নেই। এমন কি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখাসহ বন্দর শাখাও এ বিষয়ে কোনো কিছুই জানে না। এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ বোর্ডেও এ বিষয়ে কোনো আবেদন জমা পড়েনি। এ ধরনের ঘটনাকে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। আসলে হুমকির মধ্যেই যেন এখন আমাদের বসবাস। গণতান্ত্রিক চেতনা ও আচরণের অভাবে বিরোধী দলের রাজনীতি এখন দমন-অবদমন ও নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট। বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়ামূলক সহিংস আচরণের ফলে রাজপথে লক্ষ্য করা যায় ভাংচুর ও ককটেলের ধোঁয়া। আর আশাভঙ্গের কারণে জনগণ এখন ¤্রয়িমাণ। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশৃঙ্খলা ও উদ্দামহীন জনগণের দেশে আগ্রাসন চালাতে বাইরের শক্তির তো ভয় পাওয়ার কথা নয়। এমন চিত্রই তো এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা এখনও বিশ্বাস করতে চাই, আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেম আছে। তবে এখন সময় এসেছে কথার বদলে জনগণের স্বার্থ ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার বাস্তব উদাহরণ পেশ করার। এ ক্ষেত্রে সরকারের সাথে সাথে বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও আমরা যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ আশা করছি। তবে শপথের মাধ্যমে সরকার যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে, তাতে উদাহরণ সৃষ্টির দায়িত্বটা প্রথমে সরকারের ওপরেই বর্তায়। সরকার সে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads