বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০১৩

সংলাপ নিয়ে সংশয় ও অনিশ্চয়তা



রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। সে সরকার যে তত্ত্বাবধায়ক নামেই হতে হবে এমন কথা এখন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোও বলছে না। নিজেদের সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়ার জন্য বেগম খালেদা জিয়া এমনকি নির্দলীয় তথা নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়েও ছাড় দিয়েছেন। বলেছেন, নাম যা কিছুই হোক না কেন, নির্বাচনের সময় যেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় না থাকে- এটাই বিরোধী দলের প্রধান দাবি। অন্যদিকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে পাতি নেতারা তো বটেই, প্রধানমন্ত্রী নিজেও প্রথম থেকে দাবিটি নাকচ করে এসেছেন। এখন তো আরো জোরেশোরে নাকচ করছেন। কেন সে জিজ্ঞাসার উত্তর এতদিনে সাধারণ মানুষও জেনে গেছে। কিন্তু বিষয়টি সংকটকে অনেক জটিল ও ঘনীভূত করেছে। এর ফলে জনমনে উ™ে^গ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এফবিসিআইসহ দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী ও মহল শুধু নয়, বিদেশীরাও মধ্যস্থতা করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। প্রথম থেকে তৎপর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার পর সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠান ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা। গত ৭ মে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে উভয় পক্ষকে তারা জোর তাগিদও দিয়েছেন। অবিলম্বে সংলাপে বসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের পর পর চারদিনের সফরে ১০ মে ঢাকায় এসেছেন জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পাশাপাশি অন্য কয়েকটি দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গেও বৈঠক করে গেছেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল তাদের বক্তব্য। মূল কথায় তারা এই বলে সতর্ক করে গেছেন যে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারে এবং সরকার ব্যবস্থাসহ নির্বাচনের ফর্মুলার ব্যাপারে একমত না হয় তাহলে গণতন্ত্র তো বিপন্ন হবেই, দেশের পরিণতিও ভয়ংকর হওয়ার আশংকা রয়েছে। জানা গেছে, নিউইয়র্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকেও এই কথা বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বানকি মুন। বলার অপেক্ষা রাখে না, কথার মধ্যে কোনো রাখঢাক করেননি তারা। আশাবাদী অনেকে ধারণা করেছিলেন, এসব শোনার ও জানার পর ক্ষমতাসীনরা অবশ্যই কিছুটা সমঝে চলবেন, সাবধান হবেন এবং এমন বক্তব্য দেয়া থেকে অন্তত বিরত থাকবেন, যার ফলে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত প্রত্যেককে বরং উলটো আরো বেশি মারমুখী মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তো বেগম খালেদা জিয়াকে ‘হুকুমের আসামী’ বানানোর ঘোষণাও দিয়েছেন। ওদিকে তাকে অনুসরণ করে অন্য ক্ষমতাসীনরাও যথেচ্ছভাবে হুমকি উচ্চারণ করে চলেছেন। একই সঙ্গে নিজেদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার কথাও জানান দিচ্ছেন তারা। যেমন সর্বশেষ এক উপলক্ষে ইদানীং প্রাধান্যে এসে যাওয়া মন্ত্রী হাছান মাহমুদ পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় যে সরকারই থাকুক না কেন সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী করতে হবে শেখ হাসিনাকে। এটুকু বলেও থেমে যাননি হাছান মাহমুদ। এই ঘোষণাও জারি করেছেন যে, শেখ হাসিনাকে ছাড়া অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধান করা হলে আওয়ামী লীগ তা মেনে নেবে না। বলাবাহুল্য, কথাটার মধ্যদিয়ে ক্ষমতাসীনরা আসলে সেই ‘তাল গাছটি আমার’ প্রবাদ বাক্যই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গত কারণে বিরোধী দলসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সমস্যার মূল কারণ যেখানে বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে তাকে সরকার প্রধান রাখা হলে সংলাপের যৌক্তিকতা কোথায়? তাছাড়া প্রধান একটি সমস্যা হিসেবে রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যে ব্যবস্থাটিকে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা রাতারাতি বাতিল করে দিয়েছেন। আলোচনা তাই সরকারের ধরন নিয়ে হওয়া দরকার। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা সালিশ মানবেন কিন্তু ‘তাল গাছটি’ ছাড়বেন না। অবস্থা তথা তাদের সিদ্ধান্ত এমনটি হলে সংলাপে বসারও কোনো অর্থ থাকতে পারে না। মনে করা হয়েছিল, বিরোধী দলের এই প্রতিক্রিয়ার কথা জানার পর বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী হয়তো সুর কিছুটা নরম করে আনবেন যাতে বিরোধী দলকে অন্তত আলোচনার টেবিলে আনা যায়। কিন্তুু এখানেও শেখ হাসিনা তার অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি। তিনি বরং ১৫ মে’র এক দলীয় অনুষ্ঠানেও বেগম খালেদা জিয়াকে ভয় দেখিয়েছেন। বলেছেন, এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার দুই ছেলেকে দেশছাড়া করেছিল। আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকেও দেশ থেকে বিতাড়িত করবে। সুতরাং ভালো চাইলে বিরোধী নেত্রীর উচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পরিত্যাগ করে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে সম্মত হওয়া। অর্থাৎ শেখ হাসিনার নিজের অধীনে কিভাবে ওই সরকার গঠিত হতে পারে শুধু সে বিষয়েই তারা সংলাপে বসতে চান। বলা দরকার, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত কঠোর ও ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় বলেছেন বলে আশাবাদী হওয়ার পরিবর্তে রাজনৈতিক অঙ্গনে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। এমন এক সময়ে তিনি বিরোধী দলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি বেগম খালেদা জিয়াকে ‘হুকুমের আসামী’ বানানোর হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন যখন এসব বিষয়ে বিদেশীরা জড়িয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে জাতিসংঘের তাৎপর্যপূর্ণ আগ্রহের কথা তো বলতেই হবে। সব জেনেও প্রধানমন্ত্রী যখন এভাবে কথা বলেন ও খালেদা জিয়ার মতো দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীকে নিয়ে ব্যঙ্গ-তামাশা করেন এবং ভয় দেখান তখন আর না মেনে উপায় থাকে না যে, তার মধ্যে আর যা-ই হোক অন্তত সমঝোতা প্রতিষ্ঠার এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্য বা সদিচ্ছা নেই। তিনি বরং সংকটকেই আরও ঘনীভূত করতে চাচ্ছেন। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুসারীদের এ ধরনের বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্য সংলাপ ও সমঝোতা এড়িয়ে যাওয়া। একথা বলাও আমরা জাতীয় দায়িত্ব মনে করি যে, সংলাপের উদ্যোগ নেয়া থেকে আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু ও সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো পর্যন্ত সব ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদেরই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর পাশাপাশি জাতিসংঘও যে খুবই আগ্রহ ও সতর্কতার সঙ্গে সবকিছু লক্ষ্য করছে সে কথাটাও মনে রাখা দরকার। না হলে পরিণতি আসলেও ভয়ংকরই হতে পারেÑ যা শুভাকাক্সক্ষী সকলেই বলছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads