মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০১৩

জরুরি অবস্থার নতুন কৌশল

গণতন্ত্রের পায়ে আগেই ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়েছিল। এবার মুখ বন্ধ করা হলো, যাতে কান্নার আওয়াজও কেউ শুনতে না পায়। বাংলাদেশের বন্দী গণতন্ত্রের আহাজারি এখন থানার বারান্দায় আর জেলখানার ফটকে শোনা যাচ্ছে। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাজপথে গণতন্ত্রের আর্তচিৎকার থেমে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন চট্টগ্রামে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেন, তখন ঢাকার প্রেস কাবের সামনে সাভারে ভবনধসে স্বজন হারানোরা সমবেত হয়েছিলেন। এখানে যারা হাজির হয়েছিলেন তাদের কেউ হারিয়েছেন সন্তান আবার কেউ হারিয়েছেন স্বামী, ভাইবোন বা আপনজন। উদ্ধারকাজ শেষ হলেও তারা এখনো খুঁজে পাচ্ছেন না স্বজনদের। লাশটি পর্যন্ত মিলছে না। নিজ নিজ স্বজনের ছবি নিয়ে তারা মানববন্ধন করতে জাতীয় প্রেস কাবের সামনে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাদের সেখানে দাঁড়াতেই দেয়নি। সভা-সমাবেশের ওপর ঢাকা মহানগর পুলিশের বিধিনিষেধ থাকায় সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা স্বজনের সন্ধান করতে আসা লোকজনকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেন। তারা স্থান ত্যাগ না করলে পরে তাদের সাভারগামী বাসে তুলে দেয়া হয়। কান্না বুকে চেপে হয়তো তারা আবার সাভারের ধ্বংসস্তূপের কাছে ফিরে গেছেন। কিন্তু সেখানেও তারা সমবেত হতে পারবেন না। এভাবেই রাজপথে কান্নার আওয়াজ থেমে যাবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে জানিয়েছিলেন এক মাসের জন্য সারা দেশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরে জানা গেল কেবল রাজধানী ঢাকায়ই এই নিষেধাজ্ঞা। রাতে আবার বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ নিষেধাজ্ঞা অনির্দিষ্টকালের জন্য জারি করা হয়েছে। ধারণা করা যায়, এ নিষেধাজ্ঞা সহজেই উঠবে না। নিষেধাজ্ঞা জারির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, সব সময় সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করা যায় না। তার মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এ ধরনের অধিকারের লঙ্ঘন দোষের কিছু না। ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের কারণে এ নিষেধাজ্ঞা এমন কথা তিনি বলতে চেয়েছেন। সভা-সমাবেশ করলে মহাসেনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণতৎপরতা কিভাবে বাধাগ্রস্ত হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। অথচ এই ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক কোনো ক্ষতি হয়নি বলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশের মসজিদ-মন্দিরে দোয়া ও প্রার্থনা হয়েছে। এখন ঘূর্ণিঝড়ের দোহাই দিয়ে সভা-সমাবেশের জানাজা পড়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের ভণিতার আশ্রয় নেননি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, জনগণের জানমাল রক্ষার কথা বিবেচনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সারা দেশে সভা-সমাবেশ বন্ধ থাকবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রিয় দুটি শব্দ হচ্ছে দমন দুর্বৃত্ত। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে তিনি সব সময় দমন করতে চান। তার চোখে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা হচ্ছেন দুর্বৃত্ত।
বিবিসিকে তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করবে এমন নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত রাজধানীতে কোনো দলকেই সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তিটা হলো এইÑ আমাদের সংবিধানে আছে যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেে সবাইকে সমাবেশের এবং সংগঠনের অধিকার দেয়া আছে। এখন এই যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ আরোপ করার অর্থ হলো যারা সমাবেশ করবেন তারা জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করবেন না। পরিবহনে আগুন দেবেন না। বাস পোড়াবেন না। রেলে আগুন দেবেন না। কুরআন শরীফ পোড়াবেন না। যতণ না পর্যন্ত আমরা নিশ্চিন্ত হচ্ছি যে, এ ধরনের দুর্বৃত্তরা সমাবেশের নাম করে এ ধরনের কাজগুলো করবে না, ততণ পর্যন্ত ওই যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধের আওতায় আমরা এগুলো করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা বলেছি, অনির্দিষ্টকালের জন্য। তিনি আরো বলেন, ঢাকায় ৪৮ ঘণ্টায় নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক আবেদন পর্যন্ত জানিয়েছে। কাজেই যতণ না পর্যন্ত তারা গণতান্ত্রিক বিশ্বাসে ফিরে না আসে, যতণ না পর্যন্ত দেশের আইন মান্য করতে শেখে বা তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়; ততণ পর্যন্ত তাদেরকে তো সে পর্যায়ে রাখতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল বিরোধী দল যাতে সভা-সমাবেশ করতে না পারে সে জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। এ জন্য চমৎকার এক যুক্তি দিয়েছেন যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত না হবেন যারা সমাবেশ করবেন তারা জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করবেন, ততক্ষণ তিনি এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখবেন। মজার ব্যাপার হলো, এই নিশ্চয়তা তাকে কে দেবে? সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কেউ যাতে রাষ্ট্রের সম্পত্তি ধ্বংস করতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা। যদি কেউ করে তা হলে তাকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা। একই সাথে সরকারকে সভা-সমাবেশ করার শান্তিপূর্ণ পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু তা না করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হচ্ছে কেন?
জনস্বার্থের কথা বলে তিনি সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করছেন। অথচ এই জনস্বার্থবিরোধী কাজের সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা জড়িত ছিলেন। ১৯৯৩ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কত বাস পুড়িয়েছিলেন তার কি কোনো হিসাব আছে? সেই সময় চট্টগ্রামে নতুন রেলস্টেশনটি কারা পুড়িয়েছিলেন, সচিবালয়ের সামনে অফিসগামী সরকারি কর্মকর্তাকে কারা উলঙ্গ করেছিলেন? আর প্রেস কাবের সামনে রাস্তা বন্ধ করে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে জনতার মঞ্চ যখন বানানো হয়েছিল, তা কী গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল? তখন যদি সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন না হয়ে থাকে, তা হলে এখন প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে কেন? সম্প্রতি বাস পোড়ানো, কুরআন পোড়ানোর দায় দেয়া হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের ওপর। হেফাজতে ইসলাম তা অস্বীকার করে বলেছে, এসব ঘটনার সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জড়িত ছিলেন। হেফাজতে ইসলামের ভাবমর্যাদা ধ্বংস করার জন্য কুরআন পুড়িয়ে তার দায় চাপানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথায় কথায় সব কিছু দমন করতে চান। কিন্তু যারা সেই দিন জ্বালাও-পোড়াও করেছেন, তাদের কাউকে কি তিনি দমন করতে পেরেছেন? যদি না পারেন সে ব্যর্থতার জন্য দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু তা না করে তিনি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করার নীতি গ্রহণ করেছেন। এসব পদক্ষেপ যে বিরোধী রাজনীতি নির্মূলের লক্ষ্যকে সামনে রেখে করা হচ্ছে, তা বোঝা খুব কঠিন বিষয় নয়।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সভা-সমাবেশ করা নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নাগরিকের কথা বলার অধিকার নিশ্চিত করা। যে রাষ্ট্রে নাগরিকেরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে না, সে রাষ্ট্রকে আর যা-ই হোক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যায় না। বাংলাদেশ এখন কোন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীন, তা বলা দুরূহ হয়ে পড়েছে। স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সব পথ এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকার যেন চাইছে সবাই এক সূরে এক ভাষায় কথা বলবে। মনে রাখতে হবে একটি সংবাদপত্র ও দুটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দেয়ার পর এবার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। এর মধ্যে তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকও নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা সরকারের আছে।
সরকার এমন এক সময় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখন বিরোধী দল মাঠের রাজনীতির বদলে সংসদে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংসদের চলতি অধিবেশনে নির্বাচনকালীন সরকারের একটি ফর্মুলাও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সংসদে তুলে ধরা হবে বলে জানা গেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য শুনলে মনে হবে তারা যেন চাইছে না বিরোধী দল সংসদে আসুক। বিরোধী দলের সামনে বড় ধরনের রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি নেই। বর্ষা মওসুম ও রমজানের কারণে বড় কোনো কর্মসূচি পালন করা সম্ভব হবে না।
জাতিসঙ্ঘসহ বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা সংলাপের উদ্যোগ নিলেও তাতে সফলতার কোনো লক্ষণ নেই। আওয়ামী লীগ অনির্বাচিতদের হাতে মতা না দেয়ার যুক্তি দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার বিরোধিতা করলেও সরকার চলছে মূলত অনির্বাচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে। অনির্বাচিত সাত উপদেষ্টা মতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছেন। এই উপদেষ্টারা গোপনীয়তার শপথ না নিয়েও মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত থাকছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ৬৫ সদস্যের মন্ত্রিপরিষদের মন্ত্রী মর্যাদার সাতজন উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার ছয়জন ছাড়াও রয়েছেন তিনজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন আইন ও শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বিভক্ত দুই ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ দেশের ৬১টি জেলা পরিষদও পরিচালিত হচ্ছে অনির্বাচিতদের দিয়ে। সর্বশেষ উপমহাদেশের শত বছরের ঐতিহ্য ভেঙে জাতীয় সংসদের স্পিকার পদে বসানো হয়েছে একজন অনির্বাচিত ব্যক্তিকে।
প্রধানমন্ত্রীর সাত উপদেষ্টা হচ্ছেন ড. তৌফিক-ই-ইলাহী, সাবেক আমলা ও জনতার মঞ্চের নেতা এইচ টি ইমাম, আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক নেতা ও বঙ্গবন্ধু পরিষদ নেতা ড. আলাউদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসক নেতা ডা: সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিকী, জনতার মঞ্চ নেতা ড. মশিউর রহমান ও গওহর রিজভী।
শুধু উপদেষ্টারা নন জেলা পরিষদ, ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দণি সিটি করপোরেশন চলছে অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা আছে, কিন্তু অনির্বাচিতদের সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছুসংখ্যক চলছে নির্বাচিতদের দিয়ে, বাকি সব চলছে অনির্বাচিতদের দিয়ে। অথচ স্থানীয় সরকার সরাসরি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে পরিচালিত হওয়ার বিধান রয়েছে। তারপরও আওয়ামী লীগের যুক্তির কোনো অভাব নেই।
প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলের সাম্প্রতিক কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে নয়, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এক মাসের জন্য এ সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়তো আর কখনো তোলা হবে না। হোসনি মোবারক যেমন ক্ষমতা গ্রহণ থেকে ক্ষমতা ত্যাগের আগ পর্যন্ত জরুরি অবস্থা বহাল রেখেছিলেন, তেমনভাবে এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করার অংশ হিসেবে সভা-সমাবেশ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এ অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
স্বাধীনতার পর বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বাকশাল নামে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল। তখন এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। ফলে ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়টি ঘুরেফিরে আবারো আলোচনায় আসছে। একদলীয় শাসন কায়েমের এই ঝোঁক ক্ষমতাসীন দলের অনেকের মধ্যে রয়েছে। ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছিলেন, বাকশালের আদর্শ তারা এখনো ধারণ করেন। তার দল বাকশালের চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে  সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। তিনি আরো বলেন, এ ক্ষেত্রে সব দলকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি প্লাটফর্মের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে চাই। (যুগান্তর ৬ সেপ্টেম্বর ২০১০) এই ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম হচ্ছে ১৪ দলীয় জোট। নিশ্চয়ই ১৮ দলীয় জোট নয়। বিএনপি-জামায়াত যে এ ধরনের প্লাটফর্মে থাকছে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এ ধরনের চিন্তা থেকে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচনের কৌশল প্রবলভাবে কাজ করছে বলে অনেকে মনে করেন। এ কারণে বিরোধী দল নির্বাচনকালীন সরকারের ফর্মুলা নিয়ে যত বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল তত বেশি অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বা মতামত কোনো কিছুকেই সরকার পাত্তা দিচ্ছে না। ১৯৭২-৭৪ সালের বাকশাল কায়েমের সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে রুশ-ভারত পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়েছিল। এখন রাশিয়ার সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ না থাকলেও ভারতের সমর্থন নিয়ে যেন এই সরকার টিকে আছে। সেই সময় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পাশাপাশি চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারের তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। এ সময়ে এসে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম নতজানু হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীন নয়, সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে সেলফ সেন্সরশিপ এখন প্রধান বাধা। গণমাধ্যমের ওপর নিপীড়নমূলক সিদ্ধান্তের জন্য সরকার যখন নানাভাবে সমালোচনার মুখে, তখন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারের অভিমত হচ্ছে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে বিপ্লব ঘটে গেছে। সম্প্রতি চাঁদপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এ দেশে গত ২০ বছরে গণমাধ্যমে বিপ্লব ঘটেছে। দেশে এখন অনেক টেলিভিশন চ্যানেল চালু রয়েছে এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক প্রকাশিত হচ্ছে। এটি গণতন্ত্র ও দেশ উভয়ের জন্য অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। এখানকার গণমাধ্যম কর্মীদের উন্নয়নে তিনি কাজ করে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। (প্রথম আলো ১২ মে ২০১৩)।
১৯৭২-৭৪ সালের সরকারের সাথে বর্তমান সরকারের আরো অনেক মিল আছে। মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা তখন আওয়ামী লীগকে একদলীয় শাসনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। বর্তমান মন্ত্রিসভায় আবারো সেই আদর্শ বিচ্যুত বামদের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। যারা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত একটি রাজনৈতিক দলকে ইতোমধ্যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। মুসলিম লীগের ঔরসজাত রাজনৈতিক দলটিকে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে এমন এক দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে ইসলাম ও মুসলিম ভাবাদর্শের ওপর আঘাত হানা যেন সরকারের প্রধান কাজ।
সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা ও গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করার জন্য যারা সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। এর মধ্যে গণতন্ত্রের নাড়ি ধরে টান দিয়ে এ দেশকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। লেখক আহমদ ছফা তার বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বইয়ে ১৯৭২-৭৪ সালের পরিস্থিতি তুলে ধরে লিখেছেনÑ সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে জাতীয় মধ্য শ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই রাষ্ট্রীয় চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে ফেলেছিলেন। রেডিও-টেলিভিশনে তোষামোদ, চাটুকারিতা, নির্লজ্জ আত্মপ্রচার, মানুষের সুস্থ কাণ্ডজ্ঞানকে একরকম মুছে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল। সন্ত্রাস, গুম, খুন, ছিনতাই, দস্যুতা, মুনাফাখোরি, কালোবাজারি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বিচার হত্যাÑ এগুলো একান্তই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মানুষের হনন প্রবৃত্তি, লোভ রিরংসার এ রকম নির্লজ্জ আত্মপ্রকাশের সিংহ দুয়ার খুলে দেয়ার ব্যাপারে তৎকালীন সরকার মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। বর্তমান পরিস্থিতির সাথে যদি সেই সময়কে আমরা মিলিয়ে দেখি তা হলে মনে হবে টাইম মেশিনে চড়ে আমরা পেছনে ফিরে যাচ্ছি। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে পেছনে ফেরার গতি যেন আরো বাড়ানো হলো।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads