রবিবার, ১৯ মে, ২০১৩

বন্ধ মিডিয়া খুলে দিতে সম্পাদকদের দাবি যথার্থ



গণমাধ্যম আজকের দুনিয়ায় এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। গণমাধ্যম ছাড়া কোনো জাতির সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা এই সময়ে একেবারেই ভাবা যায় না। জাতি, সমাজ তথা সামগ্রিক উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য বলেই স্বীকৃত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত মত-পথ, আলোচনা-সমালোচনা ব্যক্তি-সমাজ তথা জাতিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির পথ বেয়েই গণমাধ্যমকে গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচনা করা হয়। তাই গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কোনো দেশেই ভালো চোখে দেখা হয় না। প্রতিটি দেশের প্রতিটি সরকার তত্ত্বগতভাবে এরই প্রতি স্বীকৃতি জানায় বক্তৃতায়-বিবৃতিতে। এবং সেই সাথে বলে তাদের আমলে গণমাধ্যম স্বাধীন। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন অনেক সময় দেখা যায় না। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অতীত ও বর্তমান অনেক সরকারের আমলে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে দেখেছি।
বর্তমান সরকারের আমলে সরকারের পক্ষ থেকে জোরগলায় গণমাধ্যম পুরোপুরি স্বাধীন বলেই দাবি করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমরা দেখেছি, যখনই কোনো সংবাদপত্রে এমন কিছু সংবাদ লেখা বা ছাপা হয়, যাতে সরকারি দলকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়, তখনই সে সংবাদপত্রকে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। এর একটি জায়মান উদাহরণ হচ্ছে সপ্তাহখানেক আগে দৈনিক প্রথম আলো একটি জনমত জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলল,  দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে পেতে চায়। এবং দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ মনে করে দেশের অবস্থা খারাপ। তখনই সরকারি দলের নেতানেত্রীরা ওই পত্রিকার সম্পাদকের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বললেন, ওই পত্রিকার সম্পাদক তওবা সম্পাদক। আর প্রধানমন্ত্রী বললেন, একটি পত্রিকা (প্রথম আলো) জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ওই সম্পাদকের ভূমিকা কী ছিল, তা আমাদের সবারই জানা।
এ ধরনের বক্তব্য সরকারের ভিন্নমত সহ্য না করতে পারারই পরিচয় বহন করে। ভিন্নমত সহ্য করতে না পেরেই গত ৬ মে ২০১৩ ভোররাত থেকে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয় এক ঠুনকো অজুহাতে। তারও কয়েক দিন আগে সরকার বন্ধ করে দেয় দৈনিক আমার দেশের  প্রকাশনা। তালা লাগিয়ে দেয় পত্রিকাটির প্রেসে। আটক করা হয় এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। অভিযোগ উঠেছে, তাকে বারবার রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। সাংবাদিক মহল থেকে বন্ধ পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল খুলে দেয়ার দাবি তোলা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এমনই প্রেক্ষাপটে এসব বন্ধ গণমাধ্যম খুলে দেয়ার জন্য জাতীয় দৈনিকের ১৫ জন বিবেকবান সম্পাদকের পক্ষ থেকে একটি যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কিত একটি খবর গতকাল বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। খবরে প্রকাশ, জাতীয় দৈনিকের ১৫ জন বিশিষ্ট সম্পাদক এক যৌথ বিবৃতিতে ছাপাখানা খুলে দিয়ে দৈনিক আমার দেশ প্রকাশ, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার চালু এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করেছেন। মিডিয়ার ওপর সরকারের চলমান হস্তক্ষেপকে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আশঙ্কাজনক হুমকি হিসেবে অভিহিত করে এসব সম্পাদক উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মাহমুদুর রহমানের মা ও সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের মামলা প্রত্যাহার করার দাবিও জানান সম্পাদকেরা। বিবৃতিদাতা সম্পাদকেরা হলেনÑ ইনডিপেন্ডেন্ট সম্পাদক মাহবুবুল আলম, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, নিউ এইজ সম্পাদক নুরুল কবীর, কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, নিউ নেশন সম্পাদক মোস্তাফা কামাল মজুমদার, দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম ও যুগান্তরের নির্বাহী সম্পাদক সাইফুল আলম।
আমরা মনে করি, বন্ধ এসব মিডিয়া খুলে দেয়ার ব্যাপারে এই ১৫ জন বিশিষ্ট সম্পাদকের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। এসব মিডিয়ার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সরকার সে অভিযোগ নিয়ে প্রেস কাউন্সিলে মামলা দায়ের করতে পারত। কিন্তু সরকার তা না করে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে এগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, তার মা ও সংগ্রাম সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং মাহমুদুর রহমানকে আটক করেছে। আমরা আশা করব, সরকার দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় এসব সম্পাদকের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে তাদের দাবি পূরণে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য তা অপরিহার্য।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads