মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০১৩

বেআইনী অস্ত্রের মহড়া



ছবিটি গত পরশুর অনেক জাতীয় দৈনিকেই প্রকাশিত হয়েছে। এর ঘটনাস্থল সিলেটের এমসি কলেজ। বিরোধী কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে নয়, ছাত্রলীগ সেখানে ছাত্রলীগেরই পাল্টা গ্রুপের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। লাঠি ও রড-চাপাতি ধরনের দেশীয় অস্ত্র প্রায় সবার হাতেই দেখা গেছে। কিন্তু একজন ছিল একেবারে আলাদা রকম। তার মাথায় ছিল র‌্যাব-পুলিশের মতো হেলমেট। আর হাতে ছিল ছোট বন্দুক আকারের আধুনিক একটি আগ্নেয়াস্ত্র। কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সে প্রতিপক্ষের ওপর গুলী চালিয়েছে বলে খবরে বলা হয়েছে। তার গুলীতে কতজন নিহত বা আহত হয়েছে এবং তার নাম-পরিচয়ই বা কি এসব সম্পর্কে অবশ্য কিছুই জানা যায়নি। এসবের আসলে দরকারও পড়ে না। কারণ, নাম তার যা-ই হোক না কেন, সে যে ক্ষমতাসীন দলের একজন দুর্ধর্ষ ক্যাডার, একজন ‘সোনার ছেলে’ এ কথাটাই মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছে। আলোচনায় আসছে অন্য কিছু কথাও। এগুলোর মূলকথা হলো, সিলেটের ওই কলেজেই প্রথমবার নয়, এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের সব অঞ্চলেও ছাত্রলীগের ‘সোনার ছেলেদের’ একই ধরনের কর্মকা-ে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। মাত্র কিছুদিন আগে, প্রথমে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা প্রচ- গণআন্দোলনের সময় এবং তার পরপর হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ ও ঢাকা অবরোধকে উপলক্ষ করে দেশব্যাপী যে দমন-নির্যাতন চালানো হয়েছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে লালিত ‘সোনার ছেলেদের’ দেখা গেছে অগ্রবর্তী ভূমিকায়। দেশের এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে দলটির সন্ত্রাসী-ক্যাডাররা সশস্ত্র হামলা না চালিয়েছে। হামলার শিকার হয়েছেন জামায়াত-শিবির ও হেফাজতের নিরীহ নেতা-কর্মীরা। তারা এমনকি মিছিল করারও সুযোগ পাননি। তাদের সঙ্গে পুলিশও যথারীতি যোগ দিয়েছিল। ফলে গুলীরও যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় শত শত নেতা-কর্মী গুরুতরভাবে জখম হয়েছেন, অনেকে নিহতও হয়েছেন। খোদ রাজধানীতেও জামায়াত-শিবির, হেফাজত ও বিএনপি সদস্যদের বাধাহীনভাবে তৎপরতা চালাতে দেয়া হয়নি। র‌্যাব ও পুলিশের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘সোনার ছেলেদের’কেই দেখা যাচ্ছে। তাদের ছবিও মাঝে-মধ্যেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে এমনকি বেসরকারি টেলিভিশনের খবরেও। যেমন হেফাজতের লংমার্চ ও ঢাকা অবরোধের আগে-পরে চট্টগ্রামের কিছু ছবিতে দেখা গেছে, ‘সোনার ছেলেরা’ এমনকি র‌্যাবের পোশাক পর্যন্ত গায়ে চাপিয়েছে। মাথায় তো হেলমেট ছিলই। তাদের হাতে থাকা অস্ত্রগুলোও ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ, সেগুলো সাধারণত র‌্যাব ও পুলিশের হাতেই দেখা যায়। একই ধরনের ঘটনা দেখা গেছে গত ৫ মে, হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধের দিনটিতে। সেদিন বায়তুল মোকাররম ও পল্টন এলাকায় যারা গাড়ি ভাংচুর করেছে এবং নির্বিচারে ফুটপাতের শত শত দোকানে আগুন দিয়েছে তাদের অনেকের হাতেই নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। সাধারণ মানুষও সেসব দৃশ্য দেখেছেন। শোনা যায়, গভীর রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যে অভিযান চালানো হয়েছে, সে অভিযানেও নাকি শত শত ‘সোনার ছেলে’ অংশ নিয়েছিল। এভাবেই ক্ষমতাসীনদের উদ্যোগে ও প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ‘সোনার ছেলেরা’। র‌্যাব, পুলিশ বা সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হচ্ছে না বলে তাদের বাড়াবাড়িও সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রকাশ্য দিনের বেলায় তো বটেই, এমনকি টিভি সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনেও তারা বীর দর্পেই অস্ত্রের প্রদর্শনী ও ব্যবহার করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতান্ত্রিক কোনো দেশে এমন অবস্থা কোনো রকমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আমরা দেশজুড়ে র‌্যাব-পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের সশস্ত্র হামলা ও অস্ত্রের প্রদর্শনীর তীব্র নিন্দা জানাই। সরকারের উচিত সময় থাকতে তার ‘সোনার ছেলেদের’ নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদের হাত থেকে সকল অস্ত্র ফেরত নেয়া। এসব অস্ত্র তারা কিভাবে কোথায় পেয়েছে, কারা তাদের হাতে অস্ত্র এবং মানুষ খুনের ওপেন লাইসেন্স দিয়েছে এসব জিজ্ঞাসারও জবাব দেয়া দরকার। কারণ, ‘সোনার ছেলেরা’ যদি অনিয়ন্ত্রিতই থেকে যায় তাহলে সংঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে দেশজুড়ে। এর ফলে সমাজেই শুধু বিশৃঙ্খলা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে না, শান্তি বিঘিœত হওয়ার পাশাপাশি গণতন্ত্রও বিপন্ন হয়ে পড়বে। বলা বাহুল্য, তেমন অবস্থায় সবকিছুর দায়ভারই সরকারকে বহন করতে হবে। আমরা তাই আশা করতে চাই, সরকার দেরি না করে এমন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেবে জনগণকে যাতে বায়তুল মোকাররম, পল্টন ও সিলেটের এমসি কলেজের মতো সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের ছবি দেখতে না হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের যাতে যেখানে-সেখানে প্রাণ হারাতে বা গুলীবিদ্ধ হতে না হয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads